পার্থেনিয়াম বা গাজর ঘাস ক্ষতিকর আগ্রাসি প্রজাতির বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া উদ্ভিদ

বাংলাদেশ এবং ভারতে গত দশ বছরে ছড়িয়ে পড়া একটি উদ্ভিদ পার্থেনিয়াম। এটি এক ধরনের বিষাক্ত আগাছা, যা মানুষ ও প্রাণীদের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি করে। এই গাজর ঘাস ক্ষতিকর আগ্রাসি প্রজাতির বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া উদ্ভিদ।

বিবরণ: গাজর ঘাস পার্থেনিয়াম গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতি। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Parthenium Hysterophorus. এই বিষাক্ত উদ্ভিদটি সাধারণত উচ্চতায় ১ থেকে ১.৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। পার্থেনিয়াম শাখা বিস্তারের মাধ্যমে গম্বুজ আকৃতির অথবা ঝোপ আকারের হয়। পাতা শাখাযুক্ত ত্রিভুজের মতো। নির্দিষ্ট বয়সে ফুল ফোটে। একটি গাছ বাঁচে তিন থেকে চার মাস। এই সময়ের মধ্যেই তিনবার ফুল ও বীজ দেয়। গোলাকার, সাদা, আঠালো এবং পিচ্ছিল হয়ে থাকে এর ফুল। পার্থেনিয়ামের একটি গাছ ৪ থেকে ২৫ হাজার বীজের জন্ম দিতে পারে।

বাড়ির আশপাশে, রাস্তার ধারে, বন-জঙ্গলে বা ফসলের ক্ষেতে পার্থেনিয়াম জন্ম ও বিস্তার লাভ করে। এদের বীজ এতই ছোট যে সাধারণত গবাদিপশুর গোবর, গাড়ির চাকার কাদামাটি, পথচারীদের জুতা-স্যান্ডেলের তলার কাদামাটি, সেচের পানি ও বাতাসের সঙ্গে এর বিস্তার ঘটে। রাস্তা ও ক্ষেতের চারপাশে এগুলো প্রচুর পরিমানে দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলো যে কোনো ফসলের পক্ষে খুবই খারাপ।

পার্থেনিয়ামে রয়েছে Sesquiterpene Lactones নামক টক্সিন বা বিষ, যা গঠিত হয় Caffeic acid, Vanillic acid, Ansic acid, P-anisic acid, Chlorogenic acid, Ges Parahydroxy benzoic acid দ্বারা। এই বিষ মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়াও এই বিষাক্ত আগাছা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে যা কীটপতঙ্গ ও ফসল উভয়েরই ক্ষতি করে। পার্থেনিয়াম আগাছা ফসলি জমিতে থাকলে ফসলের উৎপাদন প্রায় চল্লিশ শতাংশ কমিয়ে দেয়। পার্থেনিয়াম আগাছাযুক্ত মাঠে গবাদিপশু চরানো হলে পশুর শরীর ফুলে যায়, তীব্র জ্বর, বদহজমসহ নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। এ ছাড়া পার্থেনিয়াম মানুষের হাতে-পায়ে লাগলে প্রাথমিক অবস্থায় হাত-পা চুলকায়, লাল হয়ে যায় এবং পরে ত্বকক্যান্সারের সৃষ্টি করতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির ঘনঘন জ্বর, অসহ্য মাথাব্যথা ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগতে পারে। খারাপ খবর হল ভারতের পুনেতে পার্থেনিয়ামজনিত বিষক্রিয়ায় এ পর্যন্ত ১২ জন মারা গেছে।

আরো পড়ুন:  গাদা-বানি বা লাবুনী একটি মসৃণ, ভূশায়ী বহুবর্ষজীবী বিরুত

মানুষের উপর পরাগের মাধ্যমে প্রভাব ফেলে। হাওয়ার মাধ্যমে এটি মানুষের সংস্পর্শে আসে এবং ডার্মাটাইটিস, জ্বর, হাঁপানি, এবং ব্রঙ্কাইটিসের মতো বিভিন্ন বড় বড় রোগ ও এলার্জির সৃষ্টি করে। এই আগাছাতে পাওয়া সাধারণ অ্যালার্জেনগুলি হল- পার্থিনিন, করোনোপিলিন, টিট্রেনানিরিস এবং এমব্রোসিন। পার্থিনিয়াম গাছ খাওয়ার ফলে পশুদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রোগের সৃষ্টি হয় এবং তা গরু, মোষ, ছাগলের দুধের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং বেশি মাত্রায় খেয়ে ফেললে গবাদি পশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে ।

ক্ষতিকর দিকগুলো পর্যালোচনা করে কৃষিবিদগণ গাছটি পুড়িয়ে ফেলতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন : এটি কেউ কাটতে গেলে ব্যক্তির হাতে-পায়ে লাগতে পারে। পোড়াতে গেলে ফুলের রেণু দূরে উড়ে বংশবিস্তার ঘটাতে পারে। আবার ব্যক্তির নাকে, মুখেও লাগতে পারে। তাতে করে তিনি মারাত্মক বিষক্রিয়ায় পড়তে পারেন। এ ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সঙ্গে প্রথমে গাছটিকে কাটতে হবে। হাতে গ্লাভস, চোখে চশমা থাকলে ভালো হয়। পা ভালোমতো ঢেকে রাখতে হবে। মোটা কাপড়ের প্যান্টের সঙ্গে বুটজুতা পরা যেতে পারে, সঙ্গে মোটা কাপড়ের জামাও পরতে হবে।

পার্থেনিয়াম দমন করার পদ্ধতি

রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আগাছানাশক ব্যবহার করে এ গাছ দমন করা যায়। সেক্ষেত্রে ডায়ইউরোন, টারবাসিল, ব্রোমাসিল ৫০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে হেক্টরপ্রতি প্রয়োগ করতে হবে। আবার প্রতি হেক্টরে দুই কেজি ২.৪ সোডিয়াম লবণ অথবা এমসিপি ৪০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করেও এ আগাছা দমন করা যেতে পারে।

সহজভাবে বললে শুধু লবণ-পানি স্প্রে করেও এই গাছ ধ্বংস করা যায়। ব্যবহৃত চিত্রে পার্থক্য দেখুন, বাঁদিকে কিছু স্প্রে করা হয়নি, ডানদিকে নুন জল স্প্রে করার ২৪ ঘন্টা পর। তাই লবন জল স্প্রে করুন, পার্থেনিয়াম ধ্বংস করুন। গাছের গায়ে কেরোসিন স্প্রে করলে গাছ খুব তাড়াতাড়ি মারা যায়। তবে এতে অনেক অসুবিধা আছে, যেমন- পদ্ধতিটি ব্যয়সাপেক্ষ, কেরোসিন জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়লে জল নষ্ট হবে। তাই খুব কম খরচে এটি বিনাশ করার সবচেয়ে ভালো ঘরোয়া উপায় হলো ৪ থেকে ৫ লিটার জলে ১ কেজি নুন ভালো করে মিশিয়ে গাছের পাতায় ও গোড়াতে স্প্রে মেশিনের সাহায্যে স্প্রে করলে ২ দিনের মধ্যে সব মারা যাবে।

আরো পড়ুন:  স্বর্ণলতা দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এক ঔষধি ও আগ্রাসি লতা

কিছু সাবধানতা : ১. গাছে কোনো ভাবেই হাত দেবেন না এবং বাচ্চাদের দূরে রাখুন। ২. পার্থেনিয়াম সাফাই অভিযানে সবসময় মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস পরে থাকবেন। এছাড়া ফুলহাতা জামা ও ফুলপ্যান্ট বা ট্র‍্যাকসুট পরে থাকা ভালো। ৩. সাফাইয়ের পর জামাকাপড় ভালো করে ধুয়ে ফেলবেন ও নিজে স্নান করে বাড়িতে ঢুকবেন। সাধারণ মানুষের প্রতি অনুরোধ আপনার নিজেদের চারপাশ পার্থেনিয়াম মুক্ত রাখুন ও নিজে সুস্থ থাকুন ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!