কুশ ঘাসের ৮ ধরনের ঔষধি ব্যবহার, বহুবিধ উপকারিতা এবং গুণাগুণ

কুশ (বৈজ্ঞানিক নাম Desmostachya bipinnata stapf.) হচ্ছে গ্রামিনি বা Gramineae পরিবারের এক ধরনের ঘাস। কিন্তু আমরা সচরাচর যেগুলি দেখতে পাই সেগুলি হচ্ছে কাশ (বৈজ্ঞানিক নাম: Saccharum spontaneum)। কুশ দেখতে হবে নিটোল গোল, তার পাতার গায়ে কোনো ধার নেই। এই কুশ ভারতের উষ্ণ ও শুষ্ক অঞ্চলে পাওয়া গেলেও বিহারের গয়া এবং দ্বারভাঙ্গা জেলার অঞ্চলবিশেষে কোশী নদীর ধার বরাবর প্রচুর জন্মে। এইজন্যই এই নদীর নাম কোশ বা কুশ।

কুশ গাছের লোকায়তিক ব্যবহার

প্রথমেই বলে রাখি কুশের ব্যবহার করা হয় পিত্তবিকারে, তার সঙ্গে বায়ু অনুগামী হলে ব্যবহার করার বিধি।

১. রক্তপ্রদর রোগ: যে প্রদারের স্রাব পিচ্ছিল, মাছ, মাংস ধোয়া জলের মতো লালচে, দুগন্ধ, তার সঙ্গে শরীরে দাহ করে; এই প্রকার রক্তপ্রদারের ক্ষেত্রে ক্ষত হয়, তবে দ্রুত ছড়িয়ে দেয় না। এক্ষেত্রে ৫ থেকে ৭ গ্রাম বা ১০ গ্রামের মধ্যে কাঁচা কুশমূল বেটে, সেটা ছেঁকে নিয়ে সেটা অন্ততঃ এক কাপের মতো হতে হবে, এইভাবে ৪ থেকে ৫ দিন খেলে স্রাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে, তার সঙ্গে অন্যান্য উপসর্গেরও উপশম হবে। যদি সম্ভব হয়, তাহলে এই কুশমূল ২০ থেকে ২৫ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সেই জল দিয়ে প্রত্যহ একবার ডুস নিতে হবে। এর দ্বারা আরও তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।

২. জ্বালামেহ রোগ: এই রোগ সম্পর্কে বলা যায় এটা যৌবনকালে হয়, প্রৌঢ়ে আসে না। এর প্রধান লক্ষণ হচ্ছে এদের কোঠবদ্ধতা আসে, দাস্তের সময় কোঁথ দিলে সাদা সর্দির মত খানিকটা পড়ে যায়, মনে হয় শুক্রপাত হলো; না, তা নয় এটি প্রোটেষ্ট, গ্লান্ড থেকে ক্ষরণ  হলো, তখন বুঝতে হবে এই গ্রন্থি রোগাক্রান্ত হয়েছে। এই ক্ষরণের সঙ্গে জ্বালাও থাকে, আবার প্রস্রাব করার সময় জ্বালাও করে। এক্ষেত্রে কুশমূলে ১০ গ্রাম একটু থেঁতো করে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে একটু চিনি বা মিছরি দিয়ে খেতে হবে। এর দ্বারা ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য উপকার হবে।

আরো পড়ুন:  Diversity of the Medicinal Plants of Bangladesh.

৩. পিপাসায়: এ পিপাসাটা আসে যখন রসবহ স্রোত বিকারগ্রস্ত হয়, অল্প একটু পরিশ্রমেই তাঁর পিপাসা হয়, ঘামও বেশি; এই ক্ষেত্রের আর একটি উপসর্গ হলো কোঠবদ্ধতা, তাঁরা দাস্ত পরিষ্কারের জন্য ২ থেকে ৩ গ্লাস জলও খেয়ে ফেলছেন। এক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২ গ্রাম কুশমূল ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে সকালে বিকালে দুবারে খেতে হবে। ৪ থেকে ৫ দিন খাওয়ার পর যদি উল্লেখযোগ্য উপকার না হয়, কুশের মাত্রা দেড়গণ নিয়ে সিদ্ধ করে দুই বেলায় খেতে হবে।

৪. পিত্ত পাথুরীতে (Gall-stone): পিত্তথলিতে পাথুরী হয়েছে এটা নিশ্চিত হয়েছেন-এক্সরে ফটো তুলে নতুবা অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অভিমতে এটা পাথুরী, সেক্ষেত্রে অস্ত্রপচার করার পূর্বে কুশমূল ১২ গ্রাম গোক্ষুর (Tribulus terrestris) ৬ গ্রাম ও বরুণছাল  (Crataeva religiosa) ৬ গ্রাম এক সঙ্গে থেঁতো করে করে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে ঐ জলটা সকালে অর্ধেকটা ও বিকালে অর্ধেকটা পর পর ১০ থেকে ১২ দিন খেতে হবে। পিত্তথলিতে যেসব পাথর কঠিনীভূত (hard) হয়নি, সেগুলি এর মধ্যেই দ্রবীভূত হতে থাকবে, আর যেগুলি শক্ত হয়ে গিয়েছে, সেগুলি আস্তে আস্তে ক্ষয় হতে থাকবে। এইভাবে অন্তত ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ ব্যবহার করার পর পুনরায় এক্সরে করে দেখতে পারেন। এটির ব্যবহারে অপারেশনের হাত থেকে বেচে যাওয়ার সম্পূর্ণ সম্ভবনা থাকবে। এসব ব্যবস্থা সেই আয়ুর্বেদ ভাস্কর গঙ্গাধরের আমল থেকে চলে আসছে।

৫. অর্শ্বরোগে: এই কুশমূলের প্রয়োগক্ষেত্র কেবল বিকৃত পিত্তাশ্রিত অর্শরোগে। এদের অর্শের বলি দিয়ে রক্ত প্রায়ই পড়তে থাকে, সে বলি ভিতরে বা বাইরে যেখানেই হোক, একটু মল কঠিন হলে তো আর কথাই নেই। এই রক্ত পড়ার প্রধান কারণ এই পিত্তদোষাশ্রিত অর্শের বলির মুখের ক্ষত শুকোয় না, যেহেতু পিত্তের স্বভাবধর্ম ক্ষতিকারক, সেইজন্য এই বিপর্যয়। এক্ষেত্রে কুশমূল ১০ গ্রাম আতপ চাল ধোয়া জলে চন্দনের মতো করে বেটে, পাতলা ন্যাকড়ায় বা ছাঁকনিতে ছেঁকে নিতে হবে সেটা যেনো কমপক্ষে এক কাপ হয়; এরপরে সকালে ও বিকালে ঐ জলটাকে দুইবারে খেতে হবে। ৩ থেকে ৪ দিন ব্যবহারের পর উল্লেখযোগ্য উপকার হচ্ছে না বুঝলে কুশমূলের মাত্রা ১৫ গ্রাম করে নিতে হবে।

আরো পড়ুন:  লাক্ষা কীট এর বহুবিধি ব্যবহার

বাহ্য প্রয়োগ  

৬. ঘা বা ক্ষত:  ঘা বা ক্ষত হয়েছে দেখলেই যে কুশমূল ব্যবহার করা যাবে, সেটা নয়। কেবলমাত্র যে ক্ষতের প্রকৃতিটা দেখা যাচ্ছে যে, বহুমুখী ক্ষত অথচ সেখানে পুঁজের ভাগ কম এবং সারতে বা পুরতেও চাচ্ছে না, সেখানে বুঝতে হবে এখানে বিকৃতপিত্তের প্রভাব বর্তমান, কেবল সেই ক্ষেত্রেই কুশমূল সিদ্ধ জল দিয়ে ধুয়ে দেওয়া, আর কুশমূল চন্দনের মতো করে বেটে ওখানে লাগানো এই প্রক্রিয়া করলে কয়েক দিনের মধ্যেই ওটা সেরে যাবে।

৭. গায়ের দুর্গন্ধে: এটা সকলের গায়ে যে হয়, তা হয় না। এরা গেঞ্জি গায়ে দিলে বগলের গেঞ্জির কাছে হলুদ দাগ হয়। আর এই প্রকৃতির লোকের যৌবনটা তাড়াতাড়ি আসেও যেমন আবার সরে যায়ও তাড়াতাড়ি। অল্পতেই এরা রেগে ওঠেন। এই ধরনের লোকের প্রকৃতি পিত্তপ্রধান। এখন এই দুর্গন্ধ ও দাগটা চলে যায়, যদি কুশমূল বাটা মাঝে মাঝে চন্দনের মতো গায়ে মাখেন। আপাত দৃষ্টিতে এটা সারানো হলো বটে, তবে প্রকৃতি বদলায় না, সুতরাং মাঝে মাঝে মাখতে হবে।

৮. ফোড়া বসাতে: যাঁদের ফোড়া উঠতেও দেরি আবার পাকতেও দেরি বুঝতে হবে এখানে বায়ু, ও শ্লেষ্মা যোগ আছে। আবার এটা যদি কোমলস্থানে হয়, এক্ষেত্রে কুশমূল বেটে সামান্য গরম করে ঐ ফোঁড়ায় প্রলেপ দিলে ওটা বসে যায়। তবে সেটা কোমল জায়গায় না হয়ে অন্য জায়গায় হলে সেখানে সেক দিতে হবে।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ  

১. আয়ুবেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ২০৫-২০৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!