করাঙ্কুশ ঘাস-এর নানাবিধ ভেষজ প্রয়োগ

অতি সুগন্ধযুক্ত ঘাস, ৫/৬ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। মূল গুচ্ছবদ্ধ। পাতা ২ ফুট পর্যন্ত লম্বা ও মসৃণ এবং সাধারণতঃ ০.২ ইঞ্চি চওড়া হয়ে থাকে। গরু-ছাগলেও এই তৃণটিকে খায়। বর্ষজীবী/ বহুবর্ষজীবী তৃণ, কাণ্ড সরল ও মোটা, নিচের দিকটা লোমযুক্ত। পুষ্পদণ্ড সরল ও সরু, আয়তাকার, শীতকালে ফুল ও ফল হয়।

এ ঘাসটি হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল বরাবর কাশ্মীর, আসাম প্রভৃতির ১১,০০০ ফুট উঁচু পর্যন্ত স্থানে জন্মে। এছাড়া ভারতের উত্তর-পশ্চিম সমতল ভূমি, রাজপুতনার শুষ্ক মরুভূমি অঞ্চল, উত্তর হিমালয় প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের অঞ্চল বিশেষে এই তৃণটিকে পাওয়া যায়।

সংস্কৃতে লামজ্জক, বাংলায় করাঙ্কুশ, মহারাষ্ট্রে লাহানুরোহিষ্ণু এবং হিন্দী ভাষাভাষী অঞ্চলে লামজ্জক, ইভারাঙ্কুশ, বুর, ঘাত্যারি প্রভৃতি নামে এটি পরিচিত। বোটানিক্যাল নাম Cymbopogon jwarancusa Schult., পূর্বে এর নাম ছিল Andropogon jwarancusa Jones, এবং এটি Gramineae ফ্যামিলীভুক্ত। ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ: মূল সমেত ঘাস, ফুল।

করাঙ্কুশ ঘাস-এর প্রয়োগ:

ঘাসের রস/ ক্বাথ: সৌরভযুক্ত, উদ্দীপক, রক্ত পরিষ্কারক, পিত্তনিঃসারক, ঘর্মকারক, সংকোচক, তিক্ত, শীতল, অগ্নিদ্দীপক; জ্বর, সর্দি, কাসি, পুরাতন বাত, কলেরা, গেঁটে বাত, মূত্রকৃচ্ছ্র, ধাতুদৌর্বল্য, আধ্মান নাশক। বাতরোগে বিরেচক। আমাশয়ের পক্ষে হিতকর। বাতে এই ঘাসের প্রলেপ উপকারী। এছাড়া এটি দাহ, তৃষ্ণা, বমি ও মোহনাশক।

মূল: মূল বেটে পেটে প্রলেপ দিলে পেট ফোলা/ ফাঁপা কমে।

ফুল: রক্তরোধক।

ইউনানি মতে: এ ঘাস উষ্ণ, শুষ্ক, প্রস্রাবকারক,ঋতুস্রাবকারক, বায়ুনাশক এবং ফুল রক্তরোধক।

১. জ্বর: জ্বর, সেইসঙ্গে সর্দি ও কাসি, অক্ষুধা, বমি বমি ভাব, এইসব ক্ষেত্রে মূলসহ শুকনা করাঙ্কুশ ঘাস ২০/২৫ গ্রাম নিয়ে ৫/৬ কাপ জলে সিদ্ধ করে, ২ কাপ থাকতে হেঁকে, সেটিকে সারাদিনে ৪/৫ বারে খেতে হবে। জ্বর কমে গেলে তারপর ২/১ দিন অল্প মাত্রায় খাওয়া উচিত।

২. মূত্রকৃচ্ছ্রতা: যেক্ষেত্রে মূত্রপাথুরীর জন্য মূত্রকৃচ্ছ্র নয়, অথবা কোন দুরারোগ্য ব্যাধির জন্যও মূত্রকৃচ্ছ্র হয়নি, সেক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা ক্বাথ কয়েকদিন খেলে ঐ অসুবিধেটা চলে যাবে।

আরো পড়ুন:  পুষ্কর মূল গুল্মের সাতটি ভেষজ গুণাগুণ

৩. দাহে: শরীরে পিত্তধাতুর বৃদ্ধিটাও দাহ সৃষ্টি করে। পিত্তধাতুর বৃদ্ধি নানা কারণে হতে পারে। পিত্তবর্ধক দ্রব্যাদি সেবন, পিত্তবৃদ্ধির ঋতুতে পিত্তনাশক দ্রব্যাদি না খাওয়া, অনিয়মিত আহার ও বিহার প্রভৃতিও পিত্তবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। কারোর আবার পিপাসাও থাকে, সঙ্গে বমি বমি ভাবও। এক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা ক্বাথ সারাদিনে ৪/৫ বার করে সপ্তাহখানিক খেলে উপকার পাবেন।

৪. ধাতুদৌর্বল্যে: অতিরিক্ত শুক্রক্ষয়ের ফলে শুক্র ধাতুর ক্ষীণতা এসেছে, সেইসঙ্গে মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ, প্রায় ক্ষেত্রে অগ্নিমান্দ্য, আধমান; কারো কারো বিবাহিত জীবনে তো ভয়ানক অশান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ১০/১২ গ্রাম মূল সমেত শুকনা ঘাস ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে, সেটিকে সকালে অর্ধেকটা ও বৈকালে অর্ধেকটা সম পরিমাণ দুধ ও সামান্য চিনির সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে। ধৈর্য ধরে কিছুদিন খেতে হবে। এটি সেবনকালে কয়েকটি দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে—প্রথমতঃ যাতে শুক্রক্ষয় অতিরিক্ত না ঘটে, দ্বিতীয়তঃ উত্তেজক খাদ্য যেন না খাওয়া হয়। আর কোন কুস্নগের ফেরে পড়ে যদি এটি হয়ে থাকে, তবে সে সঙ্গ ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে হবে। এসব যদি করা সম্ভব না হয়, তাহলে কেবল এই ঘাস সিদ্ধ জল খেয়ে বিশেষ কিছু লাভবান হওয়া সম্ভব হবে না।

৫. আধমানে: নানা কারণে পেটে বায়ু জমে গেলে পেটফাঁপা বা আধান হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে এই ভেষজটির ক্বাথ তৈরী করে কয়েকবার খেলেই ওটা চলে যাবে। তবে সেইসঙ্গে মূল বেটে পেটের উপর প্রলেপ দিলে আরও তাড়াতাড়ি কাজ হয়।

৬. রজঃকৃচ্ছ্রতায়: এটি অল্পবয়সী মেয়েদেরও হতে পারে, আবার বিবাহিতা মেয়েদেরও হতে পারে। বিবাহিতাদের মধ্যে কারো দীর্ঘদিন সন্তানাদি না হলেও, আবার কারো ২/১টি হবার পরেও মাসিক ঋতুর স্বল্পতা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে রক্তহীনতা আছে কিনা প্রথমেই জানা প্রয়োজন এবং থাকলে সে রকম ঔষধের ব্যবস্থা করতে হয়। এর কারণ হিসেবে অন্য কোন রোগ না থাকলে সেক্ষেত্রে মূল সমেত শুকনা ঘাস ১০/১২ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে, এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে, সেটিকে সকালে ও বৈকালে দু’বারে খেতে হবে। ২/৩ মাস খাওয়া প্রয়োজন।

আরো পড়ুন:  আশশেওড়া বা মটকিলা গাছের আটটি ভেষজ ব্যবহার

৭. বাতে: পুরাতন বাতে, বিশেষ করে গেঁটে বাতে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে তৈরী ক্বাথ দিনে ২ বার করে খেতে হবে এবং সেইসঙ্গে মূল সমেত ঘাস বেটে বেদনাস্থানে প্রলেপ দিলে আরও তাড়াতাড়ি উপশম হয়। যেক্ষেত্রে কোষ্ঠবদ্ধতা থাকলে, সেটা চলে যায়।

৮. রক্তপিত্তে: এক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে প্রস্তুত ক্বাথ, সকালে ও বৈকালে দু’বার দুধ ও চিনির সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে। এ সময় কোন প্রকার উত্তেজক খাদ্য খাওয়া উচিত নয়।

৯. ক্লান্তিতে: রোদে ঘোরাঘুরির ফলে, অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য অথবা অত্যধিক গরমের ফলে (বিশেষতঃ গ্রীষ্মকালে) ক্লান্তি এসে দেখা দেয়। এই ক্লান্তির হাত থেকে নিজেকে মুহূর্তের মধ্যে মুক্ত করতে চাইলে ১০/১২ গ্রাম মূল সমেত শুকনা ঘাস ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে, তার সঙ্গে এক কাপ দুধ ও ৩/৪ চা-চামচ। চিনি মিশিয়ে সরবত করে খেতে হবে।

১০. খোস-পাঁচড়ায়: ঘাস বেটে পাতলা করে কয়েকদিন লাগালে কমে যায়। অতিরিক্ত হলে তখন অবশ্য এইসঙ্গে অন্য ঔষধ সেবনের ব্যবস্থা করতে হয়।

CHEMICAL COMPOSITION

Cymbopogon jwarancusa Grass contains: essential oil 1% (d-piperitone and ketones).

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৯, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৫, পৃষ্ঠা, ২৮১-২৮৩।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি flowersofindia.net থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম:  Gurcharan Singh

Leave a Comment

error: Content is protected !!