গম খাওয়ার উপকারিতা ও আটারবহুবিধ ব্যবহার

গম বা গহম (বৈজ্ঞানিক নাম: Triticum aestivum, ইংরেজি নাম: Bread Wheat, Common Wheat)  পোয়াসি পরিবারের Triticum  গণের তৃণ। এটি সকল পরিবেশে জন্মাতে পারে। বাংলাদেশে গমের আটা খুব জনপ্রিয়। গম মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় ধানের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গম প্রায় সারা দুনিয়ার মানুষের প্রধান খাদ্য।

শরীরের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে গম

প্রতিদিনের খাদ্য হিসেবে যে শস্য খাবার তালিকায় ব্যবহার করা হয় অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘স্টেপল ফুড’ সেগুলোর মধ্যে অনেকের মতে গম সর্বশ্রেষ্ঠ। সেজন্য নির্দিধায় গমকে শস্যের রাজা বলা হয়। এতে জীবনধারণের জন্য সব উপযোগী উপাদানই আছে বলে মনে করা হয়। এটি একটি অন্যতম পূর্ণ খাদ্য।

আয়ুর্বেদের মতে গম মধু, বায়ু ও পিত্ত নাশ করে, গুরুপাক অর্থাৎ হজম করতে দেরি হয়, শুক্রবৃদ্ধি করে, স্নিগ্ধ, শরীরে বল আনে, ভাঙাকে জোড়া দিতে সাহায্য করে। শরীরের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে, গায়ের রং পরিষ্কার করে ও রুচি বৃদ্ধি করে। নতুন গম কফ সৃষ্টি করে ও গুরুপাক বা হজমে সমস্যা হয়।

গমের ওপরে লাল খোলায় পৌষ্টিক তত্ত্ব বেশি থাকে। মেশিনে বা মিলে পিষে ওপরের লাল খোসা ও অংকুর নষ্ট হয়ে যায় সেই সঙ্গে নষ্ট হয়ে নানা রাসায়নিক তত্ত্ব যা শরীরের পক্ষে উপকারী। অঙ্কুরের সঙ্গে নষ্ট প্রটিন এবং খোসার সঙ্গে অর্থাৎ ভূমির সঙ্গে নষ্ট হয়ে যায় ভিটামিন এবং তার পক্ষে উপকারী উপাদান।

আজকাল তো জাঁতায় পেষা আটা গ্রামেও পাওয়া যায় না। মেশিনে পেষা বেশি গরমের জন্যে সত্ত্বহীন হয়ে পড়ে। জাঁতার পেষা লাল মোটা লাল আটার রুটি ও লাপসি (আটা ও দুধ দিয়ে তৈরি হালুয়ার তো খাবার) বাজারের কেক, বিস্কুট, পাউরুটির চেয়ে খাদ্য হিসেবে অনেক ভালো ও অনেক বেশি উপকারী।

লাল আটা কোষ্ঠ শুদ্ধি করে। কোনো কোনো চিকিৎসকের মতে সাদা মিহি মায়দা এক ভাগ মাত্র পুষ্টিকর উপাদান থাকে। মোটা আটায় থাকে তিন থেকে চার ভাগ এবং বেশি মোটা আটা থেকে পাঁচ ভাগ, গমের ভুসিতে সাত ভাগ। আটা দিয়ে তৈরি হয় রুটি, পরোটা। ময়দা দিয়ে লুচি, কচুরি। গম ভাঙিয়ে তৈরি করা হয় সুজি, দালিয়া । পাউরুটি, কেক, বিস্কুট সব কিছুরই প্রধান উপাদান ময়দা।

আরো পড়ুন:  গম বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ খাদ্যশস্য

রুটি তৈরি করবার অনন্য আটা কয়েক ঘন্টা আগেই ভাল করে জল দিয়ে ঠেসে মেখে রাখা উচিত। এইভাবে আটা আগে মেখে রাখলে আটার ভেতরের বিবি এনজাইমের (জীর্ণক) পরিপাকক্রিয়া আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। তারপরে রুটি বেলে আগুনে সেঁকে নিলে নরম হয়, সহয়ে হজম হয় এবং খেতে বেশি ভাল লাগে। আটা আগে থেকে নুন দিয়ে না মাখাই ভাল। আগে থেকে নুন দিয়ে মাখলে রুটির মিষ্টতা কমে যায় অর্থাৎ রুটি খেতে মিষ্টি লাগে না।

আটার মোটা রুটির তত্ত্বগুণ

গুরুপাক বা সহজে হজম হয় না, পুষ্টিকর ও শরীরের বল বৃদ্ধি করে, ধাতু ও কফ বৃদ্ধি করে এবং বায়ু নাশ করে।

আটার পাতলা রুটির তত্ত্বগুণ: লঘুপাক বা সহজে হজম হয়, মলরোধ করে, শরীরের বল বৃদ্ধি করে, পুষ্টিকর, শুক্র বৃদ্ধি করে, কষ, বাত, পিত্ত অর্থাৎ ত্রিদোষ নাশ করে।  

লাল আটার রুটি বা ভুসিশুদ্ধ: লাল আটার রুটির পাতলা ও মোটা রুটির সব গুণই আছে এবং তার সঙ্গে আর একটি বিশেষ গুণ এই রুটি খেলে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়।

সুজি বা ময়দার রুটি: সুজি ময়দা জলে মেখে কিছুক্ষণ রেখে অল্প সেদ্ধ করে রুটি তৈরি করলে বেশি পুষ্টিকর হয়, সহজে হজম হয় এবং এই রুটি খেলে অম্বল হয় না। যারা অসুখে ভুগছেন এবং যাদের শরীর দুর্বল তাদের পরে এই রুটি খাওয়া ভাল।

যাঁদের শরীর সুস্থ তারা অবশ্য যাঁতা বা হাতকলে ভাঙা লাল আটার রুটি খেলেই বেশি উপকার পাবেন। এই রুটিরই খাদ্য সবচেয়ে বেশি।

লুচি : ময়দায় ঘিয়ের ময়ান দিয়ে ঘিয়ে ভেজে তৈরি করা হয় লুচি। খাদ্য হিসেবে লুচি গুরুপাক, স্নিগ্ধ, ধাতুক, বাত ও পিত্ত নাশক। সব সময় গরম গরম টাটকা লুচি খাওয়া উচিত। কারণ অনেকের মতে ঠাণ্ডা বা বাসী লুচি দুষ্পাচ্য বা সহজে হজম হয় না।

আরো পড়ুন:  যব খাওয়ার ১২টি উপকারিতা, রেসিপি ও নিয়ম

কচুরি ঘিয়ে ভাজা ও তেলে ভাজা: যে কচুরি ঘি দিয়ে ভাজা হয় তা স্নিগ্ধ ও শরীরে বল দেয়। তেলে ভাজা কচুরি রক্তপিত্ত প্রকোপ করে।

স্বাস্থ্য রক্ষায় গমের ব্যবহার

১. গমের চারা গাছের আছে অনেক গুণ। গমের বীজ বপন করে এক বিঘৎ মাপের যে চারা গাছ বেরোয় তার রস খেলে পিত্তের কারণে যে সব রোগ হয় তা সেরে যায়। অস্লপিত্ত, রক্তপিত্ত, দাহ, বাতরক্ত, রক্তক্ষয়, শুক্রক্ষয়, গর্ভস্রাব, মূত্রারোধ অর্থাৎ প্রস্রাব আটকে যাওয়া, গরমের জন্যে যে কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্ত বমন, নাক থেকে রক্তপড়া, শরীর গরম হয়ে যাওয়ার জন্যে ওজন বৃদ্ধি না হওয়া, পিত্তর, পুরোনো জ্বর প্রভৃতি অসুখে বা অসুবিধেতে এই রস খেলে উপকার পাওয়া যায়।

২. দেড় টেবিল চামচ আস্ত গম এক গ্লাস জলে এক রাত ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালবেলা মিহি করে পিষে কাপড় দিয়ে ছেকে চিনি মিশিয়ে সাত দিন ধরে এইভাবে ও এই পরিমাণে জল পান করলে প্রমেহ বা যৌনব্যাধি সেরে যায়।

৩. অল্প পরিমাণ গমের আটায় চিনি ও দুধ মিশিয়ে খেলে নাক থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়।

৪. গমের আটার পুলটিস বাঁধলে ফোড়া পেকে যায়।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা, ২০-২২।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Thamizhpparithi Maari

Leave a Comment

error: Content is protected !!