বাংলাদেশে বিদেশি প্রজাতির গাছ অহরহ রোপন করা হয়, এবং সাম্প্রতিককালে এসব গাছের প্রজাতিকে ক্ষতিকর গাছ হিসেবে বলা হচ্ছে। বাংলাদেশে যেসব আগ্রাসি, ক্ষতিকর, নিষিদ্ধ, পরিবেশবিধ্বংসি গাছ লাগানো হয় তা দেশের ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনছে। বাংলাদেশের জীববৈচিত্রের অর্ধেক প্রজাতিই আগামী দশকের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। দেশের পরিবেশ ধ্বংস করে পাহাড়ে ও সমভূমিতে এসব আগ্রাসি প্রজাতির বিদেশি গাছ লাগানো হচ্ছে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে। সামাজিক বনায়নের নামে বন বিভাগ এসব অপকর্ম করছে। এছাড়া এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনি গ্রুপ দুই হাজার একুশ সালের মধ্যে সারা দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রায় এক কোটি পাউলোনিয়া গাছ লাগানোর কাজ শুরু করেছিল ২০১২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে।
উদ্ভিদবিদ, প্রাণীবিদ ও কৃষিবিদরা বহুদিন ধরেই বলছেন এমন আগন্তুক গাছের ব্যাপক বনায়নের ফলে স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত এবং কৃষিশস্যের পরিস্থিতি আরো নাজুক হবে। তাদের মতে, আলাদা করে গাছ লাগিয়ে বন তৈরি করা যায় না; বনভূমি মহাকালের সৃষ্টি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ হলো প্রাকৃতিক বন রক্ষা করা এবং তাকে ছড়িয়ে পড়তে দেয়া।
এছাড়া ২০১৩ সালের ১৫ মে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের আঘাতে বাংলাদেশে যে ১৪ জন মারা যান তার ৭ জনই মারা যান গাছের নিচে চাপা পড়ে বা ডাল ভেঙ্গে। এক্ষেত্রেও দায়ি বহিরাগত প্রজাতির গাছ লাগানো। যেসব গাছের নিচে চাপা পরে মানুষ মরল সেইসব গাছগুলো কোস্টাল এরিয়ার জন্য উপযুক্ত নয় বলে অনেক পরিবেশবিদ ও উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের অভিমত।[১]
সাধারণত রেইনট্রি, একাশিয়া ও ইউক্যালিপটাস জাতীয় গাছে ছেয়ে গেছে আমাদের বনায়ন। এইসব গাছগুলো স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর; এলারজি জাতীয় রোগের উপসর্গকারী হিসেবেও এদের চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশে বহিরাগত প্রজাতির গাছ রোপণের জন্য কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদি কোম্পানি মনসান্তোসহ আরো বেশ কিছু কোম্পানি জড়িত। হাপানি ও এলার্জির ওষুধ বেচার জন্য এনজিওর মাধ্যমে একাশিয়া, সেগুন, মেহগনি, ইউক্যালপ্টাস ও আকাশমণি গাছ লাগানো, ৭২-৭৫ সালে হেলিকপ্টার দিয়া হাওরাঞ্চলে বিশ ছিটিয়ে সব পাখি হত্যার কাজটি এই কোম্পানিগুলোর মারফতই ঘটে থাকে। এখনো বিষ কোম্পানিগুলা বিষ বিক্রেতাদের পাখি হত্যা করার প্রশিক্ষণ দেয়।
বাংলাদেশে ৮০-এর দশকের শেষের দিকে ‘বিশ্ব ব্যাংক’ বাংলাদেশ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে কৃষিক্ষেত হতে ‘ব্যাঙ’ ধরে দেয়ার জন্য। সেই সময় কৃষিক্ষেত হতে কোটি কোটি ব্যাঙ ধরা হয়। কিছু দিন পর দেখা যায়, ধানক্ষেতে পোকার আক্রমণ মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং হাজার হাজার ধানক্ষেত পোকার আক্রমণে ধানশূন্য হয়ে পড়ে। এমতাবস্হায় বিশ্বব্যাংক পরামর্শ দেয় উন্নত সার ও কীটনাশক জমিতে ব্যবহার করতে। সরকার বাধ্য হয়ে এগুলো কেনে আর এই খাতে বিশ্ব ব্যাংক অতিরিক্ত শর্তসাপেক্ষে সমস্ত বিনিয়োগ করে এবং চুক্তি সম্পাদন করে।[২]
এখন আমার প্রশ্ন হোল আমাদের দেশে এত নানা রকমের জলবায়ু উপযোগী গাছ থাকতে দ্রুত বর্ধনশীল গাছের বনায়ন কেন? এ প্রসঙ্গে আমরা প্রকৃতি বিষয়ক লেখক মোকারম হোসেনের মত দেখতে পারি, তিনি ২৪ এপ্রিল, ২০১৩ প্রথম আলোতে লিখেছেন,
“প্রাকৃতিক বনের ধ্বংসাবশেষের ওপর ভিনদেশি বৃক্ষের ক্ষতিকর আচ্ছাদন চরমআত্মঘাতী একটি কাজ। অথচ আমাদের প্রাকৃতিক বনভূমিগুলোয় এই দৃশ্য এখন সবচেয়েপীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। এখন প্রতিযোগিতা, কত দ্রুত প্রাকৃতিক বন পরিষ্কার করে সেখানে সামাজিক বৃক্ষের নামে কতগুলো বৃষবৃক্ষ রোপণ করা যায়। আসলে এর কোনো প্রয়োজনই নেই। বিরক্ত না করা হলে বনগুলো স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃত রূপে আবারফিরে আসতে পারে। তাই আমাদের উচিত বনকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে না দেখে মূল্যবানপ্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা। কারণ, বনভূমিগুলোই মূলত আমাদের পরোক্ষভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে।”[৩]
বন বিভাগের দ্বারা পাহাড় ধ্বংস করা বন্ধ করতে হলে বন বিভাগের কর্মিদের জীববৈচিত্র সম্পর্কে জ্ঞানদান করতে হবে। এক প্রজাতির বন পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর। সমস্ত এক প্রজাতির বনকে অনতিবিলম্বে বহুপ্রজাতির বনে রূপান্তরিত করতে হবে। বাংলাদেশে গাছ বলতে শুধু বৃক্ষকে বুঝানো হয়। শুধু বৃক্ষ রোপন করে দেশের পরিবেশ রক্ষা যাবে না। বৃক্ষ, লতা ও গুল্ম রোপন করে নানা প্রজাতির গাছের সমন্বয়ে বাংলাদেশে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কৃত্রিম বনভূমি সৃজন করতে হবে। তবে ব্যবসায়িক বা লাভজনক খাত হিসেবে বনভূমি সৃজন করা যাবে না।
স্বল্পমেয়াদি মুনাফা ও লোভ সাময়িক সুবিধা দিলেও পরিণামে তা ভয়ংকর। আজ যে বাংলাদেশের সব প্রজাতি হুমকির সম্মুখীন তার জন্য বন বিভাগের ভূল পদক্ষেপ প্রধানত দায়ী। এখনো সময় আছে ভুল শোধরানোর। আমরা যদি শুধু কাঠের কথা বিবেচনা করি তবে পরিবেশ রক্ষা হবে না। কাঠের জন্য শুধু লাভজনক বৃক্ষ নয়, রোপন করতে হবে পরিবেশ, প্রকৃতি এবং উদ্ভিদ ও প্রাণির জন্য খাদ্য ও আবাস সরবরাহকারী নানা প্রজাতির দেশি গাছ। গাছ লাগালেই পরিবেশ বাঁচবে না, দেশি গাছ লাগাতে হবে; আমাদের নতুন শ্লোগান, “দেশি গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান”। এদেশে যেসব আগ্রাসি প্রজাতির ক্ষতিকর গাছ রোপন করা হয় সেগুলোর একটি তালিকা নিম্নে প্রদান করা হচ্ছেঃ
১. মেহগনি (Swietenia macrophylla),
২. সেগুন (Tectona grandis),
৩. আকাশমনি (Acacia auriculiformis),
৪. একাশিয়া,
৫. একাশিয়া হাইব্রিড (Acacia hybrid),
৬. শিশু (Dalbergia sissoo),
৭. ইউক্যালিপটাস (Eucalyptus camaldulensis),
৮. ইপিলইপিল (Leucaena leucocephala),
৯. রাবার (Havea brasiliensis),
১০. পার্থেনিয়াম, Parthenium Hysterophorus.
১১. তেল পাম (Elaeus guinensis),
১২. চা (Camellia sinensis)
১৩. রেইনট্রি,
১৪. লম্বু,
১৫. পাউলোনিয়া, Princess tree (Paulownia tomentosa)
১৬. পাইন,
১৭. ম্যালালুকা
১৮. স্যাফিয়ান
১৯. কচুরিপানা, Common Water Hyacinth, Eichhornia crassipes,
ড. মো. আলী রেজা খান তার বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী[৪] গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে চট্টগ্রাম বিভাগের বিস্তীর্ণ চিরসবুজ বনে বেড়ে চলেছে কিছু অপকারী গাছ তার তালিকা দিয়েছেন যেগুলো হলোঃ
১৮. চোতরা, Lantana camara,
১৯. Eupatorium odoratum,
২০. Clerodendrum infortunatum
২১. Melostama এবং
২২. Osbeckia প্রজাতিসমূহ।
বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গাছের এই তালিকাটি অসম্পূর্ণ একটি তালিকা। এদেশে আরো অনেক প্রজাতির বহিরাগত আগ্রাসী গাছে গত চারশ বছরে এসেছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে ছড়িয়ে পড়া গাছ হচ্ছে কচুরিপানা, যা দেশের সাথে কিছুটা মানিয়ে নিলেও এখনো জলের পরিবেশের জন্য হুমকি। এরকম আরো অনেক প্রজাতি প্রতি বছরই এদেশের উদ্ভিদের তালিকায় আমাদের অজান্তে যুক্ত হচ্ছে। ফলে বিদেশি বহিরাগত প্রজাতির গাছ এদেশে আনার সময় অনেক বিবেচনা করবার প্রয়োজন আছে।
তথ্যসূত্রঃ
১. ইত্তেফাক রিপোর্ট, “মহাসেনের আঘাতে নিহত ১৪, আশ্রয়হীন বহু মানুষ”, ১৭ মে, ২০১৩; দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা; আর্কাইভ: http://archive.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDVfMTdfMTNfMV8xXzFfNDEyNTM=
২. ড. মাহবুবা নাসরীন, পরিবেশের রাজনীতি, ঢাকা।
৩. মোকারম হোসেন, “পরিবেশ: সামাজিক বৃক্ষের মৃত্যুপরোয়ানা” দৈনিক প্রথম আলো, ২৪ এপ্রিল ২০১৩, আর্কাইভ: http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2013-04-24/news/347203
৪. ড. মো. আলী রেজা খান, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী, ৩য় খণ্ড; বাংলা একাডেমী, ঢাকা, জানুয়ারি, ১৯৮৭; পৃষ্ঠা- ৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।