ভূমিকা: সোয়া বা সালফা (বৈজ্ঞানিক নাম: Anethum graveolens, ইংরেজি নাম: Dill) একবর্ষজীবী বিরুৎ। এটি আগাছার মতো হলেও; এটি মসলা হিসাবে যেমন খাওয়া যায় তেমনি ঔষধ হিসাবেও ব্যবহৃত হয়।
সোয়া বা সালফা-এর বর্ণনা:
লম্বভাবে অবস্থিত, একবর্ষজীবী, নীলাভ-সবুজ, মসৃণ বীরুৎ, অনুর্ধ্ব ১ মিটার লম্বা, প্রধান মূল ব্যাস এ অনুর্ধ্ব ১২ মিমি, গাছের সকল অংশ বিশেষতঃ চূর্ণ করার পরে কড়া গন্ধ যুক্ত। কাণ্ড প্রস্থচ্ছেদ উপ-গোলাকার, অতি শাখান্বিত, দৈর্ঘ্য বরাবর খাঁজকাটা, পর্বমধ্য প্রায়শঃ ফাঁপা। পত্র একান্তর, বহু যৌগিক, আবরণ যুক্ত, আবরণগুলি একটি উন্মুক্ত মোচক তৈরী করে কাণ্ডের নিম্নাংশকে অন্তর্ভূক্ত করে, ১-৩ (বিরলক্ষেত্রে ৫) সেমি লম্বা, দৈর্ঘ্য বরাবর খাঁজ কাটা, পত্রবৃন্তক প্রস্থচ্ছেদ উপ-গোলাকার, আবরণের সমান দীর্ঘ বা অনুর্ধ্ব ১৩ সেমি দীর্ঘতর, নিম্নাংশের পত্রসমূহ দীর্ঘ পত্রবৃন্তবিশিষ্ট, উপরের গুলি প্রায় পত্রবৃন্তবিহীন (অবৃন্তক), ফলকের সীমারেখা ত্রিকোণাকৃতি বা ক্ষুদ্রতর, পক্ষলভাবে ২-৬ জোড়ায় বিভাজিত বা মুখ্য পত্রক-এর আর্বতে এবং একটি শীর্ষ পত্রক, প্রতি পত্রক আবার ২-৪ বার রৈখিক বা সূত্রাকার খণ্ডে বিভক্ত, খন্ড ১-৬০ X ০.১-১.০ মিমি।
পুষ্পবিন্যাস যৌগিক ছত্রমঞ্জরী, মঞ্জরীদণ্ড অনুর্ধ্ব ৩০ সেমি লম্বা, প্রতি ছত্রমঞ্জরীতে প্রাথমিক-রে ৫-৩৫টি, ১-১০ সেমি লম্বা, দৈর্ঘ্যে অসমান, দীর্ঘতমটি ছত্রমঞ্জরীর প্রতিটিতে ৩-৩৫ টি গৌণ-রে উপস্থিত। পুষ্প উভলিঙ্গ, বহুপ্রতিসম। বৃতি লুপ্তপ্রায়, কখনও গর্ভাশয়ের শীর্ষে ৫টি দন্ড উপস্থিত। দলসমূহ ৫টি, স্পষ্ট, অর্ধ-বিডিম্বাকৃতি সীমারেখা বিশিষ্ট, প্রায় ১.৫ X ১.০ মিমি, শীর্ষ স্পষ্টভাবে অধোমুখী ও খাঁদকৃত, হলুদ। পুংকেশর ৫টি, পুংদন্ড প্রায় ১.৫ মিমি লম্বা, গর্ভাশয় হলুদ, অধোমুখী, দ্বি-প্রকোষ্ঠী। গর্ভদন্ডপদ শাঙ্কব, মাংসল, গর্ভদণ্ড ২টি, পরিব্যাপ্ত, প্রায় ০.৫ মিমি লম্বা।
আরো পড়ুন: সোয়া বা শুলফা বিরুৎ-এর ভেষজ গুণাগুণ ও ব্যবহারবিধি
ফল লেন্স আকৃতির ভেদক ফল, ২.৫-৬.০ X ২.০-৪.০ মিমি, হালকা বা গাঢ় বাদামি, প্রান্ত সাদাটে বা ফ্যাকাশে বাদামি, পূর্ণতা প্রাপ্তির পর ২টি ফলাংশে বিভক্ত হয়ে শীর্ষদেশ দ্বারা একটি লম্বভাবে অবস্থিত, পাতলা কার্পোফোরের সাথে সংযুক্ত থাকে, ফলাংশক চ্যাপ্টা, সাধারণত ৩টি লম্বভাবে অবস্থিত, স্পষ্ট শিরা এবং কমিসারের পার্শ্বে ২টি পক্ষ-সদৃশ কমিসার শিরা, সাধারণত ২টি গাঢ় বাদমি লম্বভাবে অবস্থিত ভিটি এবং পৃষ্ঠীয় পার্শ্বে ১টি শিরার মাঝে ১টি ভিটি, স্থায়ী স্টাইলোপোডিয়াম ও গর্ভদণ্ড দ্বারা মুকুটিত, ফলাংশক ১-বীজবিশিষ্ট। বীজ বহিঃসাইম ফলাংশের লগ্ন। ফুল ও ফল ধারণ প্রায় সারা বছর জুড়ে।[১]
ক্রোমোসোম সংখ্যা: ২n = ২২ (Fedorov, 1969)।
চাষাবাদ:
বসত বাড়ীর বাগানতে চাষ করা হয়। শীতকালে রবিশস্যের সাথে আগাছা হিসাবে জন্মায়। তবে ভারতের উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় এর ব্যাপক চাষ করা হয়। আশ্বিন-কার্তিক মাসে বীজ বপন করে ফাল্গুন-চৈত্রে পাকা ফল সংগ্রহ করা হয়।[২]
বিস্তৃতি: ভূমধ্যসাগর থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার দেশজ বলেই ডিল গাছকে ভাবা হয়। বর্তমানে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া সহ বিশ্বের সর্বত্র এর চাষ করা হয়। বাংলাদেশে এটি অতি অল্প পরিমানে চাষ করা হয়।
সোয়া বা সালফা-এর অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:
কাচা গাছ ও ফল মসলা ও ভেষজ ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কাচা বা শুষ্ক পাতা ও কচি পুষ্পবিন্যাস মসলা হিসেবে সুপ, সালাদ ও সস-এ ব্যবহার করা হয়। অজীর্ণ রোগ এর ক্ষেত্রে ডিল ফল স্পমোলাইটিক এবং ব্যাটেরিয়ষ্টাটিক বলে লক্ষণীয়। অস্থি-সন্ধির স্ফীতি রোধে ডিল ফল-এর সংমিশ্রণে বাহির প্রলেপ হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। শশার আচার, পেয়াজ সিরকা, সস, পেষ্টি এবং রুটিকে সুগন্ধি অ্যালকোহলের সাহায্যে নিষ্কাশিত ফলের নির্যাসকে শঙ্ককরণের মাধ্যমে তৈরী ডিল ওলিও রেজিন একটি ঘন সৌরভযুক্ত পাউডার।
এটি বিশেষত কম লবণ বা লবণ মুক্ত খাবার হিসেবে সুপারিশ করা হয়। বাষ্পীয়-ঘনীভবনের মাধ্যমে গাছের সবুজ অংশ থেকে (ডিল হার্ব অয়েল, ডিল উইড অয়েল) এবং ফল থেকে (ডিল সীড অয়েল) উদ্বায়ী তেল পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ডিল (GRAS 2382), ডিল হার্ব অয়েল (GRAS 2382) এবং ডিল সীড অয়েল (GRAS) কে সাধারণতঃ “নিরাপদ রূপে স্বীকৃত’ বলে রেগুলেটরী ষ্টেটাস দেয়া হয়েছে।
খাদ্য কারখানায় খাদ্য দ্রব্য সুগন্ধি এবং মসলা যুক্ত স্বাদ করার জন্য কাঁচা মসলার পরিবর্তে ব্যাপকভাবে ডিল হার্ব অয়েল ব্যবহার করা হয়। সাধারণতঃ ডিল ওয়াটার রূপে প্রাপ্ত (এক ভাগ ফলের সাথে ২০ ভাগ পানির মিশ্রণ থেকে পাতন-এর দ্বারা প্রাপ্ত) ডিল সীড অয়েল পরিপাক সমস্যা কমানোর ঔষধ হিসেবে বিশেষতঃ শিশুদের ক্ষেত্রে দেয়া হয়। ডিল অয়েল একটি তীব্র পচন নিরোধক, ইহা বহু ছত্রাকের কার্যক্রম রোধকারী এবং ইদুরের উপর প্রয়োগকালে ক্যান্সার নিরোধক হিসেবে ক্রিয়াশীল গুণাবলী সম্পন্ন করার জন্য ডিল এর পুষ্পবিন্যাস ও পরিপক্ক ফল ব্যবহার করা হয়। ভারতে কারি পাউডারের উপাদান হিসেবে ফল ব্যবহার করা হয় (de Gugman and Siemonsma, 1999)
জাতিতাত্বিক ব্যবহার:
সাধারণতঃ বায়ুরোগে, পাকস্থলীর উপকার সাধক ঔষধ, কর্মশক্তিদায়ক বস্তু, মূত্রবর্ধক, ফোঁড়া প্রভৃতি মিলিয়ে দেয় এমন ঔষধ, ইমিলাগোগিউল এবং গেলেকনোটগোগিউল-এর কার্যকর গুণাবলী সম্পন্ন বলে ডিল বিবেচিত হয়। ডিল এর নির্যাসিত উপজাত পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সতেজ এবং শুষ্ক পুষ্পবিন্যাস এবং সংযুক্ত ফল ক্রমবর্ধমান হারে শোভাবর্ধক পুষ্প শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে (de GuZman and Siemonsma, 1999)।
অন্যান্য তথ্য:
বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৬ষ্ঠ খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) সোয়া, সালফা প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে সোয়া, সালফা সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির বর্তমানে সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই।[১]
তথ্যসূত্র:
১. এম আমান উল্লাহ (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ১৬৬-১৬৭। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
২. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার), দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ১৩৬-১৩৭।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Bff
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।