ভূমিকা: বাবুই তুলসি বা দুলাল তুলসি (বৈজ্ঞানিক নাম: Ocimum basilicum,ইংরেজি: Common Basil) লামিয়াসি পরিবারের ওসিমাম গণের বিরুৎ। বাংলাদেশে যে পাঁচ প্রজাতির তুলসি পাওয়া যায় এটি তার মধ্যে একটি। অন্যান্য তুলসিগুলি হচ্ছে বন তুলসি, রাম তুলসি, কালো তুলসি এবং শ্বেত তুলসি। সবগুলো তুলসিই ভেষজগুণে অনন্য এবং একটির পরিবর্তে অন্যটি ভেষজ কাজে লাগানো যায়। তুলসির সাবেক বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ ছিলো পবিত্র স্থান।[১]
বর্ণনা: বাবুই তুলসি হচ্ছে বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ, ৩ মিটার পর্যন্ত উঁচু, প্রায় মসৃণ, তরুণ অংশ খর রোমাবৃত। কাণ্ড চতুষ্কোণাকার, আঁজযুক্ত। এদের পত্র সবৃন্তক, পত্রবৃন্ত ১-২ সেমি লম্বা, সূক্ষ্মভাবে রোমশ, উপরের পৃষ্ঠ খাজযুক্ত, পত্রফলক ৩-৫ X ১-৩ সেমি, উপবৃত্তাকার-বল্লমাকার, দীর্ঘা, প্রায় অখণ্ড, মসৃণ, উভয় পৃষ্ঠে শিরা রোমশ, সুগন্ধিযুক্ত।[২]
বাবুই তুলসির পুষ্পমঞ্জরী ১০-৩০ সেমি লম্বা, সরল বা শাখান্বিত, রোমশ, ৬ থেকে ৮ পুষ্পবিশিষ্ট, পুষ্পবৃন্তিকা প্রায় ০.৩ সেমি লম্বা, রোমশ। মঞ্জরীপত্র ১টি, প্রায় ০.৭ সেমি লম্বা, রোমশ, ডিম্বাকার, কিনারা অখণ্ড । এদের বৃত্যংশ ৫টি, ফলে বর্ধিত, পুষ্পের বৃতি প্রায় ০.৩ সেমি লম্বা, ফলে বৃতি ০.৬ সেমি পর্যন্ত লম্বা, বাইরে ও ভেতরে রোমশ, উপরের বৃতি দন্তক গোলাকার, নিচের গুলো দীর্ঘতর, মধ্যের ২টি দন্তক শূকযুক্ত ও সবচেয়ে খাটো।
বাবুই তুলসির পাপড়ি ৫টি, ০.৬-০.৭ সেমি লম্বা, বাইরে সাদা রোমশ, উপরের ওষ্ঠ ৪-দম্ভর, নিচের দীর্ঘতর ওষ্ঠ অপেক্ষা চওড়ায় দ্বিগুণের অধিক। এদের পুংকেশর ৪টি, দলমণ্ডল থেকে লম্বায় বড়, দীর্ঘদ্বয়ী, ০.৭-০.৮ সেমি লম্বা, নিচেরগুলোর পুংদণ্ড হাটু-আকৃতি, রোমশ। গর্ভাশয় ৪ প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট, গর্ভদণ্ড সরু, দ্বিখণ্ডিত। নাটলেট প্রায় ০.২ x ০.১ সেমি, উপবৃত্তাকার, বাদামি-কালো, কূপযুক্ত, আর্দ্র অবস্থায় আঠালো।
ক্রোমোসোম সংখ্যা: ২n = ১৬, ৪৮ (Kumar and Subramaniam, 1986)।
আবাসস্থল ও চাষাবাদ: আর্দ্র স্থান, সমতল ভূমি ও পাহাড়ী এলাকা। বীজ থেকে নতুন চারা জন্মে। বাবুই তুলসির ফুল ও ফল ধারণ ঘটে অক্টোবর থেকে মার্চ মাসে।
বিস্তৃতি: দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র, পূর্বে চীন, ফরমোজা ও পলিনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশে ইহা কদাচিৎ বাসগৃহ সংলগ্ন তরিতরকারির ক্ষেতে পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, ভারত উপমহাদেশে এর পাতা সালাদের সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়।
ঔষধি ব্যবহার: বীজ ঝিল্লির আভ্যন্তরীণ স্ফীতির উপকার সাধক, উদ্দীপক, কামোদ্দীপক, মূত্রবর্ধক, ঘর্ম উদ্রেককারী, বায়ুনাশক এবং উষ্ণ জীবন ও প্রাণধারক। কবিরাজি মতে বাবুই তুলসি আমাতিসার, গণোরিয়া, কফরোগ, প্রসূতিদের পরবর্তীতে বেদনা, জীর্ণ জ্বরের পীতাবস্থায় ও বমি নিবারণের জন্য ব্যবহৃত হয়।[৩] এটি কিডনির আমাশয় ও বিশেষত শিশুদের দাঁত উঠার সময়ে সৃষ্ট ডায়রিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় এবং মাঝে মাঝে ইহা ক্ষতস্থানে এবং ঘা তে ইহা প্রসবের পরবর্তী ব্যথা দূরীভূত করে।
বীজ থেকে সৃষ্ট রস জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। পাতার রস আদা ও গোল মরিচের সাথে মিশিয়ে মাঝে মাঝে থেমে আসা জ্বরে প্রয়োগ করা হয়। দাদের প্রতিষেধক হিসেবেও ইহা ব্যবহৃত হয়। পাতার রস কানের ব্যথা উপশমে কানের ভিতর প্রয়োগ করা হয়। পাতার গুড়া বিছার কামড়ের ব্যথা দূরীকরণে প্রয়োগ করা হয়। মূল শিশুদের অন্ত্র সংক্রান্ত সমস্যায় ব্যবহার করা হয়।[২]
বাবুই তুলসির রস বিন্দু বিন্দু করে কানের গর্তে দিলে কর্ণশূলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। বুকের ব্যথায় আম বা রক্তাতিসারে, রক্তমূত্রে ও কাশরোগে এই তুলসির রসে উপকার হয়।বাবুই তুলসির শিকড় পানের সাথে চিবিয়ে খেলে রক্তামাশয় দ্রুত আরোগ্য হয়।[৩]
জাতিতাত্বিক ব্যবহার: এ উদ্ভিদের গন্ধ নির্দিষ্ট কতিপয় পোকামাকড় অপছন্দ করে এবং ছারপোকা বিতাড়নে ইহা ব্যবহৃত হয়। বিটপের অগ্রভাগ সুগন্ধিময় এবং মাঝে মাঝে সুগন্ধিকারী পদার্থ হিসেবে মাংসের তরকারীতে ব্যবহার করা হয়।
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৮ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) বাবুই তুলসি প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের সংকটের কারণ দেখা যায় মাত্রাতিরিক্ত আহরণ এবং চাষাবাদ না করা। বাংলাদেশে এটি আশঙ্কাজনক হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে কিছু উদ্ভিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক গার্ডেনে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্রস্তাব করা হয়েছে যে এ উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য এক্স-সিটু পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। [২]
তথ্যসূত্র:
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ৭৬-৭৮।
২. মাহবুবা খানম (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৮ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৩০৯-৩১০। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
৩. কবিরাজ বৈদ্যনাথ সেন, আবদুল খালেক মোল্লা সম্পাদিত, লোকমান হেকিমের কবিরাজী চিকিৎসা, মনিহার বুক ডিপো, ঢাকা, অক্টোবর ২০০৯, পৃষ্ঠা ৪৫-৪৬।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Hari Prasad Nadig
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।