দোপাটি ফুল চাষের জন্য জমি প্রস্তুত ও পরিচর্যা পদ্ধতি

দোপাটি ফুল চাষ শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা তিন ঋতুতে হতে দেখা যায়। তবে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে এর ফুল অধিকতর বড় ও সুন্দর হয়। হালকা উর্বর মাটি এবং প্রচুর জল দোপাটি চাষে সহায়ক। আঙ্গিনার জমিতে ও টবে দোপাটির চাষ হয়। আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এর চাষ শুরু করার জন্যে বীজ বপন করা হয়। বাণিজ্যিক মূল্য এ ফুলের তেমন একটা নেই।

দোপাটির জাত:

আমাদের দেশে সাদা, লাল, গোলাপী, বেগুনী প্রভৃতি রঙের সিঙ্গল ও ডবল দোপাটির চাষ আঙ্গিনায় অথবা টবে হতে দেখা যায়। বালসাম এবং ক্যামেলিয়া এ দুটি জাতই চাষ হয়ে থাকে।

জমি প্রস্তুত:

দোপাটি গাছের প্রথমে চারা উৎপাদন করে পরে স্থায়ী বপনের জমিতে লাগাতে হয়। কাজেই চারা উৎপাদনের বীজতলা এবং চারা লাগানোর স্থায়ী জমি হিসাবে প্রস্তুত করতে হয়।

চারা উৎপাদনের বীজতলা প্রস্তুত:

সূর্যালোকিত জায়গায় উচু দো-আঁশ বা বেলে মাটিই দোপাটি ফুল-এর বীজতলার জন্যে উপযোগী। ৭৫ সেঃ মিঃ থেকে ১ মিঃ প্রস্থ, ১.৫ মিঃ থেকে ৩ মিঃ বা তারও বেশি দৈর্ঘ্য এবং ভূমি থেকে ১০-১৫ সেঃ মিঃ উচু জমি বাছাই করে তার চারপাশে ২০-৩০ সেঃ মিঃ চওড়া ও ১০-১৫ সেঃ মিঃ গভীর সেচালা রাখতে হবে। বীজতলা প্রস্তুতির কাজগুলি যথাক্রমে-

১ মাটি কুপিয়ে নরম ও ঝুরঝুরে করতে হবে।

২ কোপানো মাটির সাথে ঝুরঝরে মাটির ১০ ভাগ এর সাথে ১ ভাগ পচা পাতা সার বা শুষ্ক গোবর সার মিটাতে হবে।

৩ উপরোক্ত আয়তনের জমিতে ২০০-২৫০ গ্রাম এস এস পি ও ৫০-৬০ গ্রাম পটাশ প্রয়োগ করে মিশানোর পর মাটি সমান করে দিতে হবে।

৪ এই সময় ব্রাসিকল ৭৫ এবং বি সি ৫০ এর ০.৪% স্প্রে দ্বারা ৪-৬ সেঃ মিঃ গভীর। পর্যন্ত মাটি ভিজিয়ে মাটি শোধন করতে হবে।

৫ এর ৪ থেকে ৫ দিন পর মাটির উপর স্তর আলগা করে জমিতে বীজ বা কাটিং লাগাতে হবে ।

চারা লাগানোর জমি প্রস্তুত:

দোপাটি ফুল চাষের জমি উর্বর, উঁচু, শুষ্ক ও সহজে জল নিষ্কাশন করা যায় এমন জমিই উত্তম। দক্ষিণ খোলা উর্বর হালকা দোআঁশ মাটি মোরগঝুঁটি চাষে উপযোগী। তবে এটেল মাটি আরো ভালো।

১ নির্বাচিত জমি লাঙ্গল বা কোদাল দিয়ে ৪ থেকে ৫ বার গভীর ভাবে কর্ষণ করে মাটিকে ঝুরঝুরে করতে হবে ।

২ আগাছা, ইট, পাটকেল, পাথর, আবর্জনা ইত্যাদি পরিষ্কার করে প্রতি ১০০ মিটার। জায়গায় ২০০ কেজি পাতা-পচা সার বা গোবর সার, ৬-১০ কেজি কাঠের ছাই, ২-৩ কেজি এস এস পি সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।

৩ এটেল মাটির জমিতে চাষের সময় সামান্য চুন মিশাতে হবে যা দো-আঁশ মাটিতে দরকার হবে না। মাটি শোধণের জন্যে সমগ্র মাটিতেই ৩০ গ্রাম অলড্রিন এবং ২৫০ গ্রাম ব্রাসিকল ২০ সামান্য গুড়া সারের সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

৪ এই অবস্থায় মাটি সমতল করে ৩ থেকে ৪ সেঃ মিঃ বীজের ও ৪-৫ টি পাতার কলমের চারা রোপনের ব্যবস্থা করতে হবে।

চারা উৎপাদন ও চারা রোপণ:

১ প্রস্তুতকৃত বীজতলা মাটি যথাযথ ভাবে প্রস্তুত ও ঝুরঝুরে করে এপ্রিল-মে মাসে। মোরগ ফুলের বীজ সামান্য ছাই এর সাথে মিশিয়ে বপন করতে হয়।

২ বপনের পর সামান্য জল ছিটিয়ে মাটি হালকা ভাবে চাপিয়ে সমান করে দিতে হয় এবং পাখি-মুরগী বা ছাগল-গরু যাতে ক্ষতি না করতে পারে সেজন্যে চারদিকে বেড়া দিয়ে দেয়া ভালো।

৩ বীজতলায় যাতে কোনভাবেই জলাবদ্ধতা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে প্রয়োজনে মাটি খুব বেশি শুকিয়ে গেলে পরিমাণ মতো জলসেচ দিতে হবে।

৪ চারায় ৪-৫টি পাতা গজালেই পূর্বে প্রস্তুত করা স্থায়ী বাগানের মাটিতে রোপনের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ১৫-২৫ সেঃ মিঃ এবং লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব হতে পারে ৩০-৪০ সেঃ মিঃ।

পরিচর্যা ও যত্ন:

গাছ লাগানোর সময় থেকে পরিচর্যার ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুবা ভালো ফুল পাওয়া যাবেনা।

১ চারা লাগানোর সময়ই সামান্য ফসফেট সার দিতে হবে এবং সামান্য জলসেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

২ পানি জমে যাওয়া বা পানি শূন্য হয়ে যাওয়া কোনটাই দোপাটি সহ্য করতে পারেনা বিধায় ফুল আহরণ পর্যন্ত প্রয়োজন মতো সেচ দিতে হবে।

৩ গাছ সামান্য বড় হলেই ছোট ছোট চিকন খুটির সাথে গাছগুলিকে বেঁধে দিলে ভালো হবে এবং অপ্রয়োজনীয় ডাল ছেটে দিতে হবে।

৪ গাছের চাহিদার অতিরিক্ত সার দেয়া হলে গাছ ছারিয়ে পাতা বড় হবে ও ডগা দুটি বেঁধে যাবে এবং ফুল ছোট হবে। এ অবস্থায় গাছের ডগা ছেটে দিতে হবে।

৫ চারা লাগানোর ১৫ দিন পর থেকে প্রতি ১৫ দিনে একবার পরিমাণ মতো তরল সার এবং মাসে একবার মাছের গুড় চাপান সার হিসেবে দিতে হবে।

৬ গাছে কুড়ি আসার সময় একবার বা দুইবার অ্যামোনিয়াম সালফেট বা ইউরিয়া বা অন্য কোন নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করতে হবে।

৭ নাইট্রোজেন সার বেশি মাত্রায় দেয়া যাবেনা। কেননা তাতে ফুলের আকার ছোট ও রঙ ফ্যাকাসে হবে।

৮ অতিরিক্ত পর্যাপ্ত পটাশ সার দিলে ফুলের রঙ ভালো হয় এবং অতিরিক্ত ফসফরাস সার দিতে ফলের রঙ খারাপ হয়। তাই ফসফরাস সার বেশি মাত্রায় দেয়া যাবেনা।

৯ গাছের গোড়ার মাটি নিয়মিত আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তবে মাটি সাবধানে খুড়তে হবে যাতে গাছের শেকড় না কাটে।

১০ গাছ বড় হলে প্রতিটি গাছে ৩ থেকে ৪টি বড় শাখা রেখে বাকীগুলি ছেটে দিলে ফুল বড়ো হবে। প্রদর্শনীর জন্যে বড় ফুল পেতে পাশের কুড়ি ছেটে দিয়ে নিয়মিত সার প্রয়োগ, জলসেচ ও রোগ বালাই দমন করতে হবে।

১১ গোবর সার ও সরিষার খইল ভিজিয়ে তরল সার তৈরী করে চারা রোপণের পরের মাস থেকেই দিতে হবে এবং কুড়ি আসার সময় তরল সারে সামান্য ইউরিয়া মিশিয়ে দিতে হবে।

১২ গাছ ২৫ থেকে ৩০ সেঃ মিঃ লম্বা হলে প্রধান শাখাটি কোন বাউনীতে বাড়িলে দিলেও তাতে ছোট ছোট শাখা বের হবে এবং ফুলের উৎপাদন হবে।

ফুল সংগ্রহ:

জুলাই-আগষ্ট মাসে অর্থাৎ চারা লাগানো ২-৩ মাসের মধ্যেই দোপাটির গাছ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। এ সময় নিজস্ব ব্যবহারের জন্যে লম্বা বোটাসহ তুলে এনে সাজানো যায়। এ ফুলের বাণিজ্যিক মূল্য এখনো তেমন একটা সৃষ্টি হয়নি। তবে এর বাণিজ্যিক মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা অচিরেই সৃষ্টি হতে পারে।

তথ্যসূত্র:

১. সিরাজুল করিম আধুনিক পদ্ধতিতে ফুলের চাষ প্রথম প্রকাশ ২০০১ ঢাকা, গতিধারা, পৃষ্ঠা ১১৮-১২০। আইএসবিএন 984-461-128-7

আরো পড়ুন:  বড় বাগান বিলাস বাগান ও বাড়ির শোভাবর্ধক আলংকরিক ফুল

Leave a Comment

error: Content is protected !!