মুক্তাঝুরি মানুষের যত্ন ছাড়াই জন্মাতে পারে; তবে মানুষ পারলে যূথবদ্ধ এ গাছের উপর ঝাপিয়ে পড়ে বংশ নির্মূল করার জন্য। অথচ বাবলা গাছের মতোই এ গাছ মানুষের উপকার করে চলেছে। মুক্তাঝুরি বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। পতিত জমি, পরিত্যক্ত ক্ষেত, রাস্তার ধার, বাগানের কিনারা, জল-ডোবার ধারে যূথবদ্ধ অবস্থায়, আগাছা হিসাবে জন্মে।
মুক্তাঝুরি বিরুৎ-এর অন্যান্য নাম:
এ উপমহাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়া এর আদি নিবাস। এর বেশ কয়েকটি। তাৎপর্যপূর্ণ নাম আছে, যেমন- বিড়ালকানি; বিড়াল এ গাছ দেখলে পাতা খাবেই এবং তার পরই চিল্লাতে থাকে, সেজন্য এ নামকরণ।
তেমনি, বিহার অঞ্চলে এর নাম বিল্লি লোটন সেখানে মুক্তাঝুরির ঝোপ দেখলেই বিড়াল দৌড়ে ঐ ঝোপে ঝাপিয়ে পড়বে, পাতা খাবে এবং কাদতেও থাকবে। এর হলদে-সবুজ রঙের পুষ্পমঞ্জরির জন্যই সম্ভবত এর নাম হরিৎমঞ্জরি।
পরিচয়:
এটি বর্ষজীবী ছোট গাছ কিন্তু ১ মিটার সমানও উঁচু হতে পারে। ছোট ছোট শাখা কাণ্ডের চারদিকে বের হয় প্রচুর পাতা এবং অজস্র মজুরির জন্য এর আসল রূপ অর্থাৎ দৈহিক রূপটা দেখা কষ্ট। পাতা হলদেটে সবুজ, হলদেটে গোলাপি।
পাতা গোলাকৃতি হলেও গোড়ার দিকটা একটু সরু ও লম্বাটে হয়। পাতার কিনারা করাতের দাঁতের মতো খাজকাটা,; পাতার বোঁটা পাতা অপেক্ষা লম্বা এবং নরম। ফলের বোঁটা ফল অপেক্ষা ছোট ও সবুজ; ফুল ক্ষুদ্র তিন অংশে বিভক্ত, অতি সূক্ষ্মভাবে খাঁজকাটা; বীজকোষ ছোট একবীজী, বীজ গোলাকৃতি, হালকা খয়েরী, তীক্ষ্ণ ও মসৃণ। প্রায় সারা বছরই ফুল ও ফল হয়। তবে বর্ষার শেষদিকে বেশি হয়।
প্রাচীন গ্রন্থে:
এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম হলো Acalyphia indica Linn. গোত্র ইউফরবিয়্যাসী। আয়ুর্বেদের কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ, সংহিতা, নিঘন্টুতে এর বর্ণনা পাওয়া যায় না। দ্রব্যগুণ সংহিতা (৩য় খণ্ড ১৯৯৭) এবং চিরঞ্জীব বনৌষধি (৪র্থ খণ্ড ২০০০) গ্রন্থ দুটিতে মুক্তাঝুরির উল্লেখ দেখা যায়। এর গুণ বর্ণনায় দ্রব্যগুণ সংহিতায় বলা হয়েছে- মুক্তাঝুরি তিক্তরস, বমনকারক ও বিরেচক। এটি কাস ও শ্বাস নাশ করে এবং শিশুদের পক্ষে উপকারী।
আধুনিক চিকিৎসায়:
মুক্তাঝুরির উপকারিতা এর রাসায়নিক বিশ্লেষণেও ধরা পড়ে। এর রয়েছে একটি সায়ানোজেনিটিক গ্লুকোসাইড এবং দুটি অ্যালকালয়ড, যথা একালিফাইন এবং ট্রাই এসিটোএমাইন। এ ছাড়া রয়েছে হাইড্রোসায়নিক অ্যাসিড এবং আরও কিছু রাসায়নিক দ্রব্য যার ফলে খরগোশে পরীক্ষামূলকভাবে এ উদ্ভিদের রস প্রয়োগ করার পর সে খরগোশের রক্তের রং গাঢ় চকলেট খয়েরি রঙে পরিবর্তিত হয়। এর শিকড় চেনার উপায় হলো শিকড় খাড়া, কাষ্ঠল, কিছুটা পেঁচানো এবং হালকা ঘিয়ে রঙের এবং স্বাদ অল্প তিতা।
কলিকাতা প্রবাসী ডাক্তার সি. এফ. টনেয়ার প্রথম হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতে মুক্তাঝুরি প্রুভিং করেন। তিনি থাইসিস এবং টিউকারকুলোসিস আক্রান্ত রোগীকে মুক্তাঝুরি থেকে তৈরি মাদার টিংচার সেবন করিয়ে সাফল্যলাভ করেছেন। ডাক্তার হেল বলেছেন মুখ দিয়ে যে-কোনো কারণেই রক্ত উঠলে মুক্তাঝুরি ফলপ্রদ। ডাক্তার এন সি ঘোষ তার মেটেরিয়া মেডিকায় ঘুষঘুষে জ্বর, দিন দিন শরীর শুকিয়ে যাওয়া, কাশি, রক্তোকাশ প্রভৃতিতে এ ওষুধ উপকারী বলে উল্লেখ করেছেন।
মুক্তাঝুরি বিরুৎ-এর ঔষধ হিসাবে ব্যবহার:
মুক্তাঝুরির পাতা এবং সমগ্র গাছটাই ওষুধের কাজে লাগে। অভ্যন্তরীণ অপেক্ষা মুক্তাঝুরির বাহ্য ব্যবহার অধিক।
১. শিশুর মলের সমস্যায়: বয়স ২ থেকে ৪ বৎসর পর্যন্ত পায়খানা কষে গিয়েছে, হচ্ছে না, অবশ্য সাধারণতঃ এটা হয় শ্লেষ্মবিকার থাকলে এবং মায়ের বুকের দুধ বা পানীয় দুধটি জীর্ণ না হলে। সেক্ষেত্রে মুক্তাঝুরির মূল ২ গ্রাম ৫/৬ চা-চামচ জলে বেটে সেটাকে ন্যাকড়ায় ছেঁকে ওই জলটা খেতে দিলে দাস্ত পরিষ্কার হয়ে যায়।
২. ক্রিমি সমস্যায়: শিশুর ক্রিমি হলে প্রায়ই কোঁত দিতে থাকে, পেট ব্যথা করে, তার জন্য পা গুটিয়ে নেয়। এ অবস্থায় মুক্তাঝুরির পাতার রস গরম করে ছেঁকে ঠাণ্ডা হওয়ার পর তা থেকে ১৫ থেকে ৩০ ফোঁটা ২ চামচ পানির সঙ্গে মিশিয়ে শিশুকে খাওয়ালে ঐ ক্রিমির উপদ্রব চলে যাবে।
৩. শিশুর কানে ব্যথায়: কানের ব্যথায়, বিশেষ করে পাঁচ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুদের কানে কট কট করলে এজন্য এর পাতার ক্বাথ ১ ফোঁটা করে সকাল-বিকাল কানে দিলে যন্ত্রণা সেরে যায়।
৪. জিভে ঘা: শিশুদের জিভে ঘা হলে মুক্তাঝুরির রস নিম তেলের সঙ্গে ফেটিয়ে জিভে লাগালে ঘা সেরে যায়।
৫. মাথায় ঘা: শিশুর মাথায় ঘা হলে কাচা হলুদসহ সাথে মুক্তাঝুরির গাছ বেটে লাগালে ঘা পরিষ্কার হয় এবং আস্তে আস্তে তা সেরে যায়। কিন্তু শিশুর ঠাণ্ডা বা সর্দি লাগাবস্থায় এ প্রলেপ দেয়া নিষেধ।
৬. পতঙ্গের কামড়ে: বিছেপোকার হুল ফোঁটালে আক্রান্ত স্থানে পাতা বাটার প্রলেপ দিলে জ্বালা-যন্ত্রণা কমে যায়।
৭. বাতের ব্যথা কমাতে: শাস্ত্রীয় প্রণালীতে আছে তিল তেলের সঙ্গে এর রস জ্বাল দিয়ে সে তেল মালিশ করলে বাতের ব্যথা সেরে যায়।
৮. হাঁপানিতে: শিশুর হাঁপানি হলে পুরনো ঘি এবং পাতার রস মিশিয়ে অল্প গরম করে আস্তে আস্তে বুকে মালিশ করলে কিছুক্ষণের মধ্যে হাপটা কমে যাবে।
৯. শিশুর বুকে সর্দি বসে গেলে: মুক্তোঝরির গাছ ও পাতা শুকিয়ে নিয়ে তা থেকে ২ গ্রাম নিতে হবে, সেইটাকে সিকি কাপ জলে সিদ্ধ করে ৩/৪ চা-চামচ থাকতে নামিয়ে ছেকে অল্প চিনি মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। তবে একটা কথা বংশে হাঁপানি রোগ থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে শিশুকে খাওয়াবেন।
১০. তড়কা রোগে: শিশুর ঘন ঘন তড়কা হতে থাকলে মুক্তাঝুরির সমগ্র গাছ পাতাসহ শুকনো গাছ ২ গ্রাম সিকি কাপ জলে সিদ্ধ করে, ৩/৪ চা-চামচ থাকতে নামিয়ে, ছেকে, সেই ক্বাথ একটিপ সৈন্ধব লবণ মিশিয়ে খাওয়ালে শিশুর ওই তড়কাটা থাকে না। তবে কাঁচা রসও দেওয়া যায়, তখন ওই রসটাকে গরম করে, তা থেকে ৩০ ফোঁটা রস ৩/৪ চা-চামচ জলে মিশিয়ে খাওয়াতে হয়।
৯. ছুলি রোগে: মুক্তঝুরির পাতা বেটে হলুদের মতো ওই সব জায়গায় মাখলে ওটা সেরে যায়, তবে প্রত্যহ ব্যবহার করার দরকার নেই, একদিন বা দু’দিন অন্তর লাগাতে হবে।
১০. শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্যে: অনেক শিশু ২/৩ দিন অন্তর পায়খানা করে, তার জন্য তাদের পেটে যন্ত্রণা হয়। সেক্ষেত্রে মক্তোঝুরির পাতা বেটে একটু ঘি মিশিয়ে পানের বোঁটার মুখে লাগিয়ে মলদ্বারে এক প্রবেশ করিয়ে দিলেই ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই দাস্ত হয়ে যাবে।
অ্যালোপ্যাথরা মুক্তাঝুরি থেকে সংশ্লেষিত একালিফাইন এবং ট্রায়াসেটোনামাইন হিসাবে উপাদানে লিখে থাকেন ।
CHEMICAL COMPOSITION
Acalypha indica Linn.
Alkaloids viz., acalyphine; cyanogenetic glucoside and triacetonamine; active principle HCN and an unknown substance, extremely poisonous to rabbits.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার), দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ৪২-৪৩।
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৪, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ১০২-১০৪।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Yercaud-elango
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।