বচ বিরুৎ-এর নানাবিধ ভেষজ গুণাগুণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি

বচ বিরুৎ-এর আবির্ভাব সম্পর্কে উদ্ভিদতাত্ত্বিকগণের মত, প্রায় আড়াইশো বছর পূর্বে এদেশে এটি এসেছে বলে মনে করা হয়। বর্ষার শুরুতে ফুল এবং শেষে ফল হয়।

বচ ছাড়াও এর আরও কয়েকটি বাংলা নাম রয়েছে যথা বচা, উগ্রগন্ধা, ষড়গ্রন্থা, গোলোমী, শত পর্বিকা, ক্ষুদ্রপত্রী, মঙ্গল্যা, জটিলা, উগ্রা, লোমশা। বিভিন্ন ভাষায় এর নাম হলো হিন্দি- বচ; গুজরাট ও মারাঠি- ভেখন্দ; মালয়- ভায়াম্প; তামিল- ভাষায়ু, আসাম- বচ; আরবি- বজ্জ, উদুল বজ্জ; ফারসিতে- অগরে তুর্কী, কারুনক; ইউনানী- ওয়াজ তুর্কী; ইংরেজিতে Sweet root, Sweet flag, calamus. এ উদ্ভিদের রাইজোম বা কন্দমূল ওষুধে ব্যবহার করা হয়।

প্রাচীন শাস্ত্রে:

চরক সংহিতা হৈমবতী বচকে শিরো বিরেচনে, বমনে, পক্বাশয়গত রোগে, বাতরোগে উপকারী বলা হয়েছে। সুশ্রুত সংহিতায় বিভিন্ন স্থানে বচের ব্যবহারের উল্লেখ করা হয়েছে।

কুটী প্রবেশিক নিয়মে ব্রাহ্মীযূতের সঙ্গে আমলকী পরিমাণ বচপিণ্ড সেবন করে গাভীর দুধ ও ঘিসহ আহার গ্রহণ করলে শতায়ু ও মেধাবান হওয়া যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাগভটের বিভিন্ন স্থানে বচকে অরোচক বা নৈঘৃণ্য রোগের অপরিহার্য ভেষজ বলা হয়েছে।

চক্রদত্তে বলা হয়েছে উন্মাদরোগে বচের রস বা চূর্ণ এবং কুড়চূর্ণ মধুসহ সেবনে উপকার হয়। অপশারে দুগ্ধান্ন সেবনপূর্বক মধুসহ এটি সেবনে অপস্মর বা মৃগী রোগ আরোগ্য হয়।

বৃদ্ধি (হার্নিয়া) রোগে বচ ও সরিষার প্রলেপ দিলে বৃদ্ধি প্রশমিত হয়। মূত্ররোধক উদাবর্ত হলে কাঁচা দুধ এবং ঠাণ্ডা পানিসহ বচের চূর্ণ সেবন করলে তা আরোগ্য হওয়ার কথা ভাবপ্রকাশে বলা হয়েছে।

বচ বিরুৎ-এর আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রয়োগ:

বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফর্মুলারী ১৯৯২-তে ৬৫টি ওষুধে বচের ব্যবহারের উল্লেখ দেখা যায়। এদের মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করা হলো- দারুষটক লেপ- শূল এবং আধান অর্থাৎ পেট ফাঁপা প্রশমক; নাগবল্যদ্য চূর্ণ-বৃষৎ, বীর্যস্তম্ভক, বাজীকরণ ও রসায়ন; ব্রাহ্মীঘৃত- স্মৃতি শক্তি বর্ধক এবং স্বর পরিষ্কারক;

আরো পড়ুন:  মুক্তাঝুরি বিরুৎ-এর গুরুত্ব ও দশটি ভেষজ গুণাগুণ

বলা তৈল- আক্ষেপ, অপর, মূর্ছা ও সূতিকা প্রশমক; অশ্বগন্ধারিষ্ট- অপস্মার বা মৃগী, মূর্ছা, সন্ন্যাস (এপোপ্লেক্সি), উন্মাদ, বাতরোগ, অনিদ্রা ও কৃশতায় উপকারী।

ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতিতেও বচ একটি বহুল ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ ওষুধি উদ্ভিদ। বাংলাদেশ জাতীয় ইউনানী ফর্মুলারী ১৯৯৩-তে নয়টি ওষুধের উপাদান হিসাবে বচ ব্যবহারের উল্লেখ দেখা যায়।

নয়টি ওষুধের মধ্যে একটি ওষুধ বাদে সবগুলো কম্পাউন্ড অর্থাৎ একাধিক উদ্ভিদ একত্র মিশিয়ে তৈরি। কেবল শুধু সাদা বচ এবং মধু বা চিনি সহযোগে তৈরি। ইউনানীতে সাদা বচকে ‘ওয়াজ তুর্কী’ বলা হয়।

অন্য কোনো উদ্ভিদ বা খনিজদ্রব্য এখানে মিলিত হয়নি। সেক্ষেত্রে এ ওষুধটির ক্রিয়া-প্রতিবন্ধকতা অপসারক, স্নায়ুসমূহের স্মৃতিবর্ধক গুণাবলিকে সাদা বরে গুণাবলি হিসাবে গণ্য করা যায়।

আরো পড়ুন: বচ বাংলাদেশের জলাভূমিতে জন্মানো ভেষজ বিরুৎ

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে বচের প্রুভিং এখনও হয়নি। হোমিওপ্যাথিক মতে মাদার টিংচার তৈরি করে কয়েকটি ক্ষেত্রে এর ব্যবহারে সাফল্য আশা করা যায়।

কেননা, বচ একাকী প্রয়োগ করে বেশ কয়েকটি সমস্যা সমাধানে সক্ষম বলে দীর্ঘকাল ধরে পরীক্ষিত হয়ে আসছে। কাশি, গলা খুশখুশ, গলা ব্যথায় ফাইটোলক্কা, রিউমেক্স, স্টিক্টা’র বিকল্প হিসাবে;

স্নায়ুসমূহের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে হাইপেরিকাম, এনাকার্ডিয়াম প্রভৃতি ওষুধের পরিবর্তে বচ ব্যবহৃত হতে পারে। অজীর্ণতার জন্য বিশেষ করে শিশুদের পেট ফাপলে বচের শক্তিকৃত ওষুধ উপকারী হতে পারে।

বচের ব্যবহার বেশ প্রাচীন এবং জনপ্রিয়। লোকায়তিক প্রয়োগ সম্ভবত এর শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে প্রয়োগের চেয়ে অধিক। সে কারণে বচ সরবরাহেও চলছে ছল-চাতুরী Acorus calamus নামের বচ গাছের শুষ্ক রাইজোমই বাণিজ্যিকভাবে কালামাস নামে বিক্রয় হয়।

প্রায়ই এ কালামাসের সঙ্গে Alpittia galanga (Linn.) Willd- হৈমবতি বচ এবং Aconituan spp (বিষ)-এর রাইজোম মিশিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশ এমনকি ভারতের বাজারেও মিশ্রণ হিসাবেই বিক্রয় হয়।

বচের রাইজোম চূর্ণ হিসাবেও বাজারজাত করা হয়। সেক্ষেত্রে সিলিসিয়াস মাটি এবং AIthaea officinalis Linn-এর শিকড় গুঁড়া করে মিশিয়ে বিক্রয় করা হয়। এতসব ভেজালের ভিড়ে আসল বচ চিনে ক্রয় করাটা সমস্যা।

আরো পড়ুন:  নটে শাক উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের ভেষজ শাক

বচের রাইজোম বা কন্দ ক্রয়ের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে বচের রাইজোম হালকা গন্ধযুক্ত, বহু ফেকুড়িবিশিষ্ট, মূল লম্বা চ্যাপটা এবং গাটবহুল।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার),  দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ৫০-৫৩।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Michael Rivera

Leave a Comment

error: Content is protected !!