সোয়া বা শুলফা বিরুৎটি বর্ষজীবী। অরোমশ, সুগন্ধি ওষুধি প্রজাতিটি উচ্চতায় ১ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। শীতকালে রবিশস্যের সাথে আগাছা হিসাবে জন্মায়। তবে ভারতের উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় এর ব্যাপক চাষ করা হয়। আশ্বিন-কার্তিক মাসে বীজ বপন করে ফাল্গুন-চৈত্রে পাকা ফল সংগ্রহ করা হয়। পাতা যৌগিক, ৪-৬ সেমি লম্বা কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত এবং এক-একটি খণ্ড সূত্রবৎ যা ২ সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ফুল যৌগ আম্বেলে (ছত্রাকৃতি) জন্মে, ফুল হলুদাভ।
ফল ডিম্বাকৃতি, চ্যাপটা, ক্ষুদ্র, ধারগুলোতে অল্প শুঁয়া বা রোম থাকে। কাঁচা অবস্থায় ফল সবুজ কিন্তু পাকলে ধূসর বর্ণের হয়; ফল লম্বালম্বি তিনটি খাঁজবিশিষ্ট, পক্ষল। ফল গুদামজাত অবস্থায়ও ফলের গায়ে মেরিকার্প লেগে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত ফুল ও বীজ না হয় এবং তার ঘ্রাণ না নেয়া হয় ততক্ষণ পর্যন্ত এ গাছকে মৌরি গাছ থেকে স্বতন্ত্র করা সম্ভব নয় ।
সোয়া বা শুলফা-র অন্যান্য নাম:
বিভিন্ন ভাষায় এর বেশ কয়েকটি নাম আছে- সংস্কৃতে- শতপুষ্প; হিন্দিতে- সোয়া; মহারাষ্ট্রে- বালাং, শোয়া; আরবিতে- শীতব্বতবজরুল; ফারসিতে- তোখমে, শুত; ইউনানীতে- শিবাত, সোয়া; ইংরেজিতে- Dill seed. এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম: Anethum sowa Roxb. ex Flem (সমনাম: A. graveolens Linn. var. Sowa Roxb; Peucedanum sowa Roxb.), গোত্র-আম্বেলিফ্যারী।
প্রাচীন শাস্ত্রে:
সোয়া বা শুলফার উপযোগিতা আহার্যে, পথ্যে, মশলা হিসাবে এ উপমহাদেশে স্বীকৃত। আয়ুর্বেদ সংহিতাগুলোতেও এর ওষুধিগুণ স্বীকৃত। চরক সংহিতার সূত্রস্থানের ৪ অধ্যায়ের সপ্তকষায় বর্গে শতপুষ্পকে (শুলফা) অনুবাসনোপযোগী ভেষজ বলা হয়েছে। আয়ুর্বেদে স্বীকৃত এ পরিভাষা ‘অনুবাসন’-এর অর্থ নির্দিষ্ট কয়েকটি ভেষজের স্নেহ নিয়ে নলের সাহায্যে বস্তিদ্বারে প্রবেশ করিয়ে যদি কার্যসাধন সম্ভব হয় তবে তাকে অনুবাসন বলা হয়। ঐ সংহিতার চিকিৎসাস্থানের ৯ এবং ২৯ অধ্যায়ে অর্শ এবং বাতরক্তে এর ব্যবহারকে স্বীকার করা হয়েছে। সুশ্রুতের সূত্রস্থানের ৩৯ আধ্যায়ে শুলফার উল্লেখ রয়েছে। অত্রি সংহিতার ১৬ অধ্যায়ে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে শতপুষ্পার ভেষজটি মেধাবর্ধনের ক্ষেত্রেও উপযোগী। একাদশ শতকের চক্রদত্তের গ্রন্থে শতপুষ্পকে বাতজ্বরের উপযোগী বলা হয়েছে। ভাবপ্রকাশে মতে শতপুষ্প (সোয়া বা শুলফা) লঘুপাক, তীক্ষ্ম, পিত্তকারক, দীপন ও কটুবিপাক, উষ্ণবীর্য, জ্বর, বাতশ্লেষ্ম, ব্রন, শূলরোগ ও চক্ষুরোগ নাশক।
আধুনিক চিকিৎসায়:
শুলফার পাতা ও ফল আহার্য কিন্ত ভেষজোপযোগিতায় বিবেচনা করা হয় কেবল শুলফা বীজকে। বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফর্মুলারি ১৯৯২-তে ৩২টি ওষুধের উপকরণ হিসাবে শুলফা ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। বত্রিশটি ওযুধের মধ্যে কেবল একটি ওষুধ শতপুষ্পী অর্ক এককভাবে শুলফা এবং পানি সহযোগে তৈরি এবং তা অগ্নিমান্দ্য, আধ্নাম ও শূল প্রশমক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সবগুলো ওষুধেই শুলফার বীজ ব্যবহার করা হয় কেবল একটি- প্রাণেশ্বর ওষুধটিতে শুলফা ফল ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সিদ্ধ প্রাণেশ্বর-এ কচি শুলফার বীজ ব্যবহারের উল্লেখ দেখা যয়। শুলফা ব্যতীত অন্যান্য উপকরণ প্রাণেশ্বর এবং সিদ্ধ প্রাণেশ্বরে ভিন্নতর হলেও ওষুধ দুটি কেবল জ্বরাতিসার প্রশমক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরো পড়ুন: সোয়া বা সালফা হচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ঔষধি বিরুৎ
বাংলাদেশ জাতীয় ইউনানী ফর্মুলারী ১৯৯৩-তে সাতটি ওষুধের অন্যতম উপকরণ হিসাবে শুলফা ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। ইউনানী পদ্ধতিতে শুলফাকে শিবাত এবং সোয়া বলা হয়। এদের মধ্যে নওনেহাল এবং শরবত তিফলিন শিশুদের পেট ফাপা, দত্ত, অজীর্ণ, দন্তোদগমকালীন পেটের পীড়ায় ব্যবহার করা; শরবত পাচলোনা। পাকস্থলীর দুর্বলতা, হজমের দুর্বলতা, পেটফাঁপা ও ক্ষুধামান্দ্য; শরবত নিসা অনয়মিত ঋতুস্রাব, ঋতুবদ্ধতা, কষ্টরজঃ শ্বেতপ্রদর, জরায়ুপ্রদাহ, জরায়ুর দুর্বলতা ও রক্তাল্পতায়; পেটফাঁপা, পাকস্থলীর ব্যথা, যকৃৎ বেদনা, পরিপাকের গোলযোগ এবং পুরনো জ্বরে ব্যবহার্য।
যোগ বা কম্পাউন্ড ওষুধে আয়ুর্বেদিক অথবা ইউনানী যে কোনো পদ্ধতিতে শুলফার ব্যবহার ছাড়া এককভাবে হাতের কাছে পাওয়া শুলফা ব্যবহারের বেশ কয়েকটি দৃষ্টান্ত রয়েছে।
সোয়া বা শুলফা-এর ভেষজ ব্যবহার:
১. বুক ধড়ফড় করা: গর্ভাবস্থায় বুক ধড়ফড় করলে শুলফা বীজ সামান্য ভেজে চূর্ণ করে ৭৫০ মিলিগ্রাম মাত্রায় সকাল-বিকাল পানিসহ খেলে বুক ধড়ফড়ানি কমে যাবে।
২. শূল রোগে: অগ্নিমান্দ্যে পরিণাম শূলের প্রথমাবস্থায়, পিত্ত-প্রধান শূলরোগে, পিত্ত-শ্লৈষ্মিক চোখ ওঠায়, গুল্মরোগে শুলফা বীজ চূর্ণ দেড় গ্রাম মাত্রায় পানিসহ সকাল-বিকাল খেলে এসব উপসর্গ চলে যায়।
৩. অনিয়মিত ঋতুস্রাব: যাদের মাসে মাসে নিয়মিত মাসিক ঋতুস্রাব হয় না, সর্বদা দিন পিছিয়ে যেতে থাকে, সেক্ষেত্রে শুলফাচূর্ণ ১-১.৫ গ্রাম গরম পানিসহ সকাল-বিকাল খেলে স্বাভাবিক হবে।
৪. প্রসূতি মায়ের বুকের দুধ বাড়াতে: প্রসূতি, যাদের বুকের দুধ কমে যায় তারা শুলফা বীজ চূর্ণ ১.৫ গ্রাম মাত্রায় এক বলকা দুধের সঙ্গে সকাল-বিকাল দুবার খেলে স্তন্য বৃদ্ধি পাবে।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার), দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ১৩৬-১৩৭।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Bff
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।