গাজরের নানাবিধ ভেষজ গুনাগুণ, উপকারিতা এবং কিছু রেসিপি

গাজর বা গাজরা (বৈজ্ঞানিক নাম:  Daucus carota subsp. sativus) অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ মূল জাতীয় সবজি। কাঁচা ও রান্না উভয় অবস্থায়ই এটি খাওয়া যায়। গাজর বেশ জনপ্রিয় সবজি যা খেতে সুস্বাদু এবং দেখতেও চমৎকার। গাজর রং ফর্সা করে। গাজরকে প্রকৃতির অমূল্য সৃষ্টি আর শক্তির ভাণ্ডার বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। গাজর সাধারণত দু রকমের হয় দেশি ও বিলিতি। দেশী কালো বা গাঢ় লালচে রঙের বা মেরুন রঙের গাজর আজকাল আর প্রায় দেখাই যায় না। বাজারে কমলা রঙের বিলিতি গাজরও পাওয়া যায় ।[১]

গাজর সালাদ তৈরি করে কাঁচাই খাওয়া যায়। গাজরের রসের অনেক উপকারিতা আছে। গাজরের ওপরকার শাকেরও উপকারিতা আছে। এই শাক সাধারণত ফেলেই দেওয়া হয় কিন্তু এই ফেলে দেওয়া শাকও ফেলনা নয়, এতে আছে অনেক গুণ।

গাজরের পুষ্টিগুণ

পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রামে ১০৫২০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন রয়েছে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.২ গ্রাম, শর্করা ১২.৭ গ্রাম,  ক্যালসিয়াম ১৭ মিলিগ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, লৌহ ২.২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.০৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ৬ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি আছে ৫৭ কিলোক্যালরি। এ ছাড়া গাজরের পাতায় ক্যারোটিন, আমিষ, শর্করা, ক্যালসিয়াম, চর্বি, লৌহ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি ও খাদ্যশক্তি রয়েছে যথাক্রমে ৫৭০০ মাইক্রোগ্রাম, ৫.১  গ্রাম, ১৩.১ গ্রাম, ৩৬০ গ্রাম, ৫.১ গ্রাম, ১০ গ্রাম, ০.০৬ মিলিগ্রাম, ৭৯ মিলিগ্রাম এবং ৭৭ কিলোক্যালরি।[২]

গাজরের গুণাগুণ :

১. গাজরের শাক: গাজরের শাক মধুর, তীক্ষ, কটু স্বাদে হয় ও শরীরকে উষ্ণ করে।গাজরের কচি পাতা বা শাকে গাজরের চেয়ে তিন গুণ বেশি ফসফরাস আছে বলে অনেকের অভিমত। পুরনো পেটের অসুখ ও অর্শ সারাতে এই খাওয়া দরকার।[১]

২. গাজর: গাজর খিদে বাড়ায় সহজে হজম হয়, মল রোধ করে, রক্তপিত্ত, অর্শ, পুরোনো পেটের অসুখ, কফ ও বায়ু থেকে উপশম করে।

. গাজরের বীজ: কৃমি নাশ করে, হার্টের পক্ষে ভাল, রুক্ষ, কিন্তু শুক্র বিনষ্ট করে। গাজরের বীজ উষ্ণ খেলে সগর্ভদের গর্ভপাত হতে পারে এরকমও অভিমত আছে।

৪. ভিটামিন এ ভাণ্ডার: গাজরে প্রচুর ভিটামিন এ আছে। খাদ্যদ্রব্যে সবচেয়ে সহজে ও সস্তায় ভিটামিন এ পাওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায় হল গাজর খাওয়া। এই ভিটামিন ‘এ’-র অভাবে শরীর ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। শরীরের বৃদ্ধি থেমে যায় শারীরিক ক্ষমতা কমে যায়। খাদ্য দ্রব্য হজম হতে অনেক দেরি লাগে, চামড়া খসখসে হয়ে যায়—ত্বকের রোগ দেখা দেয়।

আরো পড়ুন:  আদার বহুবিধ উপকারিতা, গুণাগুণ ও ব্যবহার

রাতকানা রোগ শরীরকে আক্রমণ করে, দাঁতের মাড়িতে পুঁজ জমে। পাথরি, ক্ষয় রোগ (টি বি) প্রভৃতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে হাড় নরম হয় ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। নিয়মিত গাজর খেলে এই সব রোগ বা এই সব রোগের আশঙ্কা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

৫. শরীর সুন্দর করে: গাজর খেলে শরীর নরম ও সুন্দর হয়। শরীরে শক্তির সঞ্চার হয়। আর ওজন বাড়ে যায়।

৬. শিশুর দাঁত গঠনে: শিশুদের গাজরের রস খাওয়ালে দাঁত বেরোতে কোনো কষ্ট হয় না আর দুধও ঠিক মতো হজম হয়।

৭. মস্তিষ্কে গঠন: গাজরের রস মস্তিষ্কের পক্ষেও ভাল। অর্শ, ক্ষয়রোগ, পিত্ত রোগে গাজর খেলে সুফল পাওয়া যায়। শরীরের পুষ্টি এবং বুদ্ধির বিকাশের জন্যে গাজর খাওয়া খুবই প্রযোজন। ফসফরাস থাকার জন্যে যাঁরা মাথার কাজ করেন তাঁদের পক্ষে গাজর ও গাজরের শাক খুব উপকারী।

৮. প্রস্রানের সমস্যা দূর করতে: রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর বিশেষ গুণ গাজরের আছে। গাজর  খেলে প্রস্রাবের জ্বালা সারিয়ে দেয়।

৯. গ্যাস্ট্রিক আলসার দূর করতে: পেট যদি গ্যাস্ট্রিক আলসার বেড়ে যায় তা সারাবার পক্ষে গাজর হলো মহৌষধ।

১০. পুষ্টিগুণ: গাজরে এ বি ও সি ভিটামিন আছে আর ফসফরাস আছে। ক্যারোটিন আছে প্রচুর পরিমাণে।

১১. সৌন্দর্য বৃদ্ধি: গাজর খেলে রং ফরসা হয়, মুখে সৌন্দর্য বাড়ে কারণ গাজরে আছে রক্ত পরিষ্কার করবার গুণ।

১২. পেটের অসুখ দূর করতে: গাজর খেলে অন্যান্য অসুখের সঙ্গে শরীরের জ্বালা (দাহ), পেট ফাঁপা বা পেটে বায়ু হওয়া ও তৃষ্ণা সারে।

গাজরের তরকারি, গাজরের আচার, গাজরের কাঞ্জি যা পঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশের প্রিয় পানীয় হিসাবে খাওয়া হয়। গাজরের হালুয়া যেটা দিল্লি ও পঞ্জাবে বেশি প্রচলিত খাবার। গাজরের পায়েস সবই খুব জনপ্রিয়। গাজর যদি সঠিক পরিমাণে খাওয়া যায় দামি ফল ও দামি শাক সবজির চেয়ে অনেক বেশি উপকার পাওয়া যাবে। এছাড়া গাজর বিভিন্নভাবে খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।   

আরো পড়ুন:  মানকচু বাংলাদেশের প্রচলিত ও ভেষজ গুণে ভরা জনপ্রিয় সবজি

শরীর সুস্থ রাখতে গাজর:

১. গাজর সেদ্ধ করে স্যুপ তৈরি করে খেলে বারবার পায়খানা পাওয়া ও পায়খানার বেগ থামে।

২. গাজর ঘি বা তেলে ভেজে টক দই ও ডালিমের রস মিশিয়ে খেলে রক্তার্শে আরাম পাওয়া যায়।

৩. নুন ও টক ছাড়া গাজরের তরকারি প্রতিদিন রান্না করে খেলে এবং মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দিলে যে রোগীদের শরীর ফুলে গেছে তাঁরা অনেক উপকার পাবেন।

৪. গাজরের বীজে জল মিশিয়ে বেটে পর পর পাঁচ দিন পান করলে মেয়েদের ঋতুপ্রাপ্তি হয়।

৫. গাজর সেদ্ধ করে পুলটিস বাঁধলে ক্ষত, ফোড়া আর সব রকমের খারাপ ধরনের ঘা সেরে যায়।

৬. কাঁচা গাজর থেতো করে আটায় মিশিয়ে বাঁধলে ফোঁড়া ও যে ঘায়ে জ্বালা আছে সেই ঘা সেরে যায়।

৭. গাজর কুরুনি দিয়ে কুরে নিয়ে নুন মিশিয়ে একটুও জল না দিয়ে গরম করে ও সেদ্ধ করে বাঁধলে পুরনো চুলকুনিতে উপকার হয়।

৮. রূপচর্চায়ও এর তুলনা নেই। রুক্ষ আর খসখসে ভাব দূর করে, গাজর ত্বককে রাখে সজীব, সতেজ। এজন্য গাজর ছেঁচে রস বের করে সারা শরীরে মাখতে হবে। এভাবে কমপক্ষে ১৫/২০ মিনিট রেখে পরে গোসল করা উচিত। মুখ ও শরীরের কালো দাগ দূর করার জন্য গাজর কেটে শুকিয়ে গুঁড়া করে এর সঙ্গে পরিমাণমতো ময়দা ও দুধের সর মিশিয়ে সাবানের মতো ব্যবহার করতে হয়।[২]

গাজরের কিছু রেসিপি:

গাজরের ৩ প্রকার রেসিপি দেওয়া হলও। শরীর সুস্থ্য রাখতে এটা খাওয়া দরকার।

১. গাজরের কাঞ্জি:

কালো বা দেশী গাজরের কাঞ্জি (পানীয়) তৈরি করা হয়। এই কাঞ্জি পান করলে খিদে বেড়ে যায়।

২. গাজরের আচার:

গাজর চার টুকরা করে কেটে সাত দিন নুন মাখিয়ে রাখুন। সাত দিন পরে নুন জল ফেলে দিয়ে রোদে শুকিয়ে নিন।

আরো পড়ুন:  আমাদা বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় ভেষজ কন্দজ প্রজাতি

শুকিয়ে গেলে হলুদ, সর্ষে গুড়া, নুন ও সর্ষের তেল দিয়ে মেখে নিন। এই ভাবে সহজেই গাজরের সুস্বাদু আচার তৈরি করা যায়। এই আচার খাওয়া শরীরের পক্ষে ভাল এবং এই আচার সম্পূর্ণ নির্দোষ।

৩. গাজরের মন-পছন্দ লাচ্ছা:

যা যা লাগবে : চিনি ২০০ গ্রাম, খরমুজের বিচি এটি শুকনা ফলের দোকানে পাওয়া যায়, ৫ চা চামচ, গাজর অর্ধ কেজি, গোলাপের এসেন্স বা রোজ এসেন্স ৪ থেকে ৫ ফোঁটা বা গোলাপ জল ১ চা চামচ।

কী ভাবে তৈরি করবেন :

প্রথমে গাজর কুরুনি দিয়ে কুরে নি। তিন চার চা চামচ জল মিশিয়ে কম আঁচে সেদ্ধ করুন।

এইভাবে প্রায় ছয় থেকে সাত মিনিট বসিয়ে রাখুন। এবারে চিনি মিশিয়ে একটু নেড়ে নামিয়ে রাখুন। একটু পরে অথাৎ সমস্তটা ঠাণ্ডা হলে আবার কম আঁচে বসিয়ে জলা শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত নাড়তে থাকুন।

খরমুজের বিচি (খোসা ছাড়ানো হিন্দিতে বলা হয় মগজ) আগেই শুকনা তাওয়ায় বা শুকনা কড়াইয়ে ভেজে নেবেন। গাজরের জল শুকিয়ে গেলে তার মধ্যে এই বিচিগুলা ও এসেন্স দিয়ে নামিয়ে নিন।

এই গাজরের লাচ্ছা ঘি দেওয়া হয় না বলে সুপাচ্য, বলবর্ধক, নিয়মিত খেলে গায়ের রং ফর্সা হয়।

তথ্যসূত্রঃ

১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা,১২০-১২৩।

২. নাহিদ বিন রফিক, শাকসবজির পুষ্টি ও ভেষজগুণ, তারিখহীন, কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস), http://www.ais.gov.bd/site/view/krishi_kotha_details/১৪২৪/অগ্রহায়ণ/শাকসবজির পুষ্টি ও ভেষজগুণ

Leave a Comment

error: Content is protected !!