শাক হচ্ছে সেসব সবজি যেগুলোর লতা, পাতা, ফল, মূল, বীজ ও কন্দ মানুষের জন্য ভক্ষণযোগ্য, এজন্য শাকের অন্য আরেক নাম পাতা সবজি। বাংলাদেশের শাক প্রায় শতাধিক প্রজাতির, যেগুলোর বেশিরভাগ অনাবাদি এবং কিছু আবাদি। নিচে ৫৫ প্রজাতির শাকের নাম উল্লেখ করা হলো:
১. মোরগ শাক, ২. ইছা শাক, ৩. তেলাকুচা, ৪. খুইরা কাটা, ৫. হেঞ্চি শাক, ৬. বতুয়া শাক, ৭. দুধলী শাক, ৮. ন্যাটাপেটা শাক, ৯. কানাই শাক, ১০. হেলেঞ্চা, ১১. গিমা শাক, ১২. দুরমা পাতা, ১৩. চিনতন পাতা, ১৪. পুঁইশাক, ১৫. কলমি শাক, ১৬. সেঞ্চি, ১৭. ঢেঁকি শাক, ১৮. পিপুল শাক, ১৯. শান্তি শাক, ২০. নটেশাক, ২১. চিরকুটি, ২২. ক্যাথাপাটা, ২৩. থানকুনি, ২৪. কচু শাক, ২৫. খুড়েকাটা (কাটানটে), ২৬. নুনিয়া শাক, ২৭. গিন নারিস, ২৮. খারকোন, ২৯. কস্তুরি, ৩০. আমরুল, ৩১. নুন খুরিয়া (বুলখুরিয়া), ৩২. গন্ধভাদালী, ৩৩. শুশনী শাক, ৩৪. শিয়ালমুতি, ৩৫. তেলাকুচা শাক, ৩৬. নিলিচি, ৩৭. মুনসি শাক, ৩৮. হরি শাক, ৩৯. থ্যানথ্যানে, ৪০. খ্যাটখ্যাটি, ৪১. বনঝুড়ি ৪২. হাগড়া, ৪৩. চিনিগুড়ি, ৪৪. মরিচপাতা ৪৫. বনপাট, ৪৬. হুটকা, ৪৭. মিষ্টি আলু শাক, ৪৮. ডাটা শাক, ৪৯. চালকুমড়া পাতা, ৫০. মিষ্টিকুমড়ার শাক, ৫১. লাউ শাক, ৫২. পালং শাক, ৫৩. সাজনা পাতা, ৫৪. মোরগশাক, ৫৫. মটর শাক।
আবাদি শাক
যেসব শাক চাষ করা হয়, সেগুলোই আবাদি শাক। চাষ করার অর্থ আবাদী ফসলের দিকে মনোযোগ দেওয়া যেগুলো বাণিজ্যিকভাবে উল্লেখযোগ্য।
অনাবাদি শাক
অনাবাদি শাক হচ্ছে সেসব শাক যেগুলো প্রাকৃতিকভাবে জন্মায় এবং প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা হয়। অনাবাদি শাকের বাণিজ্যিকমূল্য কম।
প্রথাগত চৌদ্দ শাক
চৌদ্দশাক প্রথা পালনে গ্রামের নারীদের চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হয়। আবাদী নয় অনাবাদী অর্থাৎ নিজে থেকে হয়ে ওঠা শাক। বাড়ীর আশপাশের পালান, খাল পুকুর ডোবার ধারে, রাস্তার ধারে, ক্ষেতের আইলে, চকে হতে আপনজালা শাক কুড়ানো হয়।
এক গবেষণায় (বইয়ের নামঃ আমাদের কুড়িয়ে পাওয়া শাক) দেখা গেছে চৌদ্দশাক কুড়াতে মেয়েরা ১ থেকে ২ কিমি পথ দূর থেকেও নিয়ে আসেন । তারা খুব খুশি হন যদি এই দুরত্বের মধ্যে অন্তত চৌদ্দ রকমের কুড়িয়ে নিয়ে আসতে পারলে।
নারীকে খবর নিতে হবে প্রকৃতির যে অংশ অনাবাদী – যে অংশ কৃষি সংস্কৃতির সংরক্ষণ করে রাখার কথা, নইলে প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ অসম্ভব – সেই অনাবাদী প্রকৃতি ঠিক আছে কিনা। যেসব গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণী আবাদ করতে গিয়ে আবাদী জায়গায় কৃষক তাদের দমন করেছে, উঠতে দেয় নি, থাকতে দেয় নি, তারা সব কি ঠিকঠাক আছে?
চৌদ্দ রকম শাক খাওয়া তো আসলে সব রকম গাছপালা প্রাণ ও প্রাণীর হালহকিকতের খোঁজ নেওয়া। ‘চৌদ্দ’ সংখ্যাটা এই দিক থেকে প্রতীকী। নারীকে খবর নিতে হবে পুরুষ সারাবছর যে ‘চাষ’ করল তাতে অনাবাদি জাতি বা প্রজাতির হাল হকিকতের কি অবস্থা।
চাষ করার অর্থ আবাদী ফসলের দিকে মনোযোগ দেওয়া, কিন্তু অনাবাদি ফসলের বিশাল ক্ষেত্র যেন তাতে নষ্ট বা কৃষ্য ব্যবস্থায় গৌণ না হয়ে পড়ে তার জন্যই চৌদ্দ রকম শাক তোলা ও খাওয়ার রীতি চালু হয়েছে। চৌদ্দ রকম শাক পাওয়ার অর্থ হচ্ছে কৃষিকাজ পরিবেশসম্মত হয়েছে , কারণ কোন অনাবাদি শাক গৃহস্থের আলালন পালান থেকে হারিয়ে যায় নি।
এই রকমের খাদ্যের প্রাপ্তি ও প্রাচুর্যতার মধ্য দিয়েও নারীরা বুঝে নেন তাঁদের গ্রামটি খাদ্য স্বার্বভৌমত্ব ও খাদ্যের সমৃদ্বির দিক থেকে নিরাপদ। এসব শাক যেন হারিয়ে না যায় তার প্রতিও তারা খেয়াল রাখেন।
চৌদ্দ রকমের শাক একত্রে মিশিয়ে রান্না করে খেলে শরীরে রোগ-ব্যাধি হয় না বলে গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করেন। তাছাড়া এসব কুড়িয়ে পাওয়া শাকে অনেক ওষুধি গুনাগুণও রয়েছে। এসব শাক খেলে মাথা ব্যথা সেরে যায়। গর্ভবতী মায়েরা বাচ্চার পুষ্টির জন্য এসব কুড়ানো শাক খান।
ঋতু পরিবর্তনজনিত রোগব্যাধির হাত থেকে বাঁচার জন্যও চৌদ্দশাক খাওয়া হয়। কার্তিক মাসে নাকি যমের বাড়ীর আটটা দরজাই খোলা থাকে! তাই ঋষিরা ধর্মের মোড়কে বেঁধে দিয়ে গেছেন চৌদ্দশাক খাবার প্রয়োজনীয়তাকে।
“ওলং কেমুকবাস্তুকং সার্ষপঞ্চ নিম্বং জয়াং।
শালিঞ্চিং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলূকং গুড়ুচীন্তথা। ভন্টাকীং সুনিষণ্ণকং
শিবদিনে যদন্তি যে মানবাঃ প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে
তিথৌ।”
-কৃত্যকৃত্ত্ব /রঘুনন্দন।
শাস্ত্রে উল্লেখিত চৌদ্দশাক-
১. ওল – Amorphophallus paeoniifolius /
Amarphophallus campanulatus
২. কেঁউ – Cheilocostus speciosus
৩. বথুয়া Chenapodium albu
৪. কালকাসুন্দে Cassia occidentalis / Cassia sophera
৫. সরষে Brassica campestris
৬. নিম Azadirachta indica
৭. জয়ন্তী Sesbania sesban
৮. শালিঞ্চে বা শিঞ্চে Atternanthera sessilis
৯. গুলঞ্চ Tinosphora cardifoli
১০. পটল বা পলতা Trichosathes dioica
১১. শেলুকা ordia dichotoma
১২. হিলমোচিকা বা হিঞ্চে Enhydra fluctuan
১৩. ভাঁট বা ঘেঁটু Clerodendrum infortunal
১৪. সুনিষণ্নক বা শুষনি Marrilea quadrifolia
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।