হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার অপ্রচলিত হরেক ফল

ফল (ইংরেজি: Fruits) বলতে জীববিজ্ঞানে বোঝানো হয় কোনো সপুষ্পক উদ্ভিদের সেই অঙ্গ যা বীজ ছড়ায়। কিন্তু সাধারণভাবে ফল হচ্ছে খাবার তৈরিতে উদ্ভিদের বীজ ছড়াবার সেই অঙ্গ। সুতরাং শব্দটিকে বিভিন্ন পরিস্থিতে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করা হয়। এখানে এই ফল বলতে আমরা বুঝাচ্ছি যেসব ফল মানুষে সাধারণ প্রক্রিয়াতেই খেতে পারে।

বাংলাদেশের অপ্রচলিত ফলগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে। এখন বাজারে অপ্রচলিত বা অবহেলিত ফলগুলো সহজে পাওয়া যায় না। আম, কাঁঠাল, কলা, আনারস, লিচু, পেয়ারা ছাড়া দেশি ফল বাজারে পাওয়া খুব কঠিন। তবে বাংলাদেশের বাজারে বিদেশী যেসব ফল খুব পাওয়া যায় সেগুলো হচ্ছে আপেল, কমলা আঙুর, বেদানা বা আনার, মাল্টা। এই হচ্ছে বাংলাদেশের ফলের সাম্প্রতিক অবস্থা। 

বাংলাদেশে অবহেলিত ফলের ভেতর যেসব ফলের নাম করা যায় সেগুলো হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বরই ও কুলশিয়াকুল, অরবড়ই, আঁশফল, আতা, আনার, আনারস, আমড়া, আমলকি, কমলা লেবু, করমচা, কাউ, কাঠলিচু, কামরাঙ্গা, কদবেল, গন্ধরাজ লেবু, গাব, গোলাপজাম, চালতা, চুকাই, জামরুল, জাম্বুরা, টিপা ফল, ডালিম, ডেউয়া, ডেফল, তাল, দাঁতরাঙা, দেশি গাব, নারিকেল, নোনা, পানিফল, পিছন্দি, ফলসা, ফুটি, বরই, বাতাবী লেবু, বিলিম্বি, বেতফল, বেল, বৈঁচি, লংগান, লটকন, সফেদা, সাতকরা, পানকিচুনকি ইত্যাদি।

এসব ফলের কয়টার আমরা নাম জানি। বাস্তব বিষয় অনেক জটিল আকার ধারণ করেছে। দেশি বৈচিত্র্যময় ফলগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। ভারত এক্ষেত্রে কিছু ফল রক্ষা করার চেষ্টা করলেও বাংলাদেশে এখনও রক্ষা করার কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। ভারত গত তিন দশকে ৪৫০ জাতের আমের বিশাল জার্ম প্লাজম সেন্টার গড়ে তুলেছে। আর আমরা কি করেছি? এখনও বাংলাদেশে উদ্ভিদের প্রজাতিসমূহকে রক্ষার জন্য একটি উদ্ভিদ উদ্যান তৈরি করা গেল না। দেশের সব উদ্ভিদের রক্ষার জন্য একটি জার্মপ্লাজম সেন্টার তৈরি করা হলও না। কোনোদিন তো কোনো পত্রিকায় দেখলাম না বাংলাদেশের কতগুলো ফল বিলুপ্ত হলো তা নিয়ে খবর করতে। পাখির উপরে জনসচেতনতা বাড়লেও উদ্ভিদের উপর তেমন সচেতন লোকজন এখনও দেশে তৈরি হলও না।

আরো পড়ুন:  তুঁত পৃথিবীর নাতিশীতোষ্ণ এবং উষ্ণমণ্ডলের দেশসমূহের বৃক্ষ

পাখি সহজে চোখে পড়ে, বাংলাদেশে পাখির প্রজাতি মাত্র সাড়ে সাতশ। ফলে পাখির অনেক সৌখিন ফটোগ্রাফার দেখা যায়, এই কারণে পাখি রক্ষায় অনেকে এগিয়ে এসেছে। আমাদের এক ঝাঁক তরুণ দরকার যারা দেশের সব উদ্ভিদ ও প্রাণী রক্ষার জন্য সচেতন ও সোচ্চার হবেন। উদ্ভিদ ও প্রাণীর ছবি তোলা, সেসব সম্পর্কে গবেষণা বৃদ্ধি করা দরকার। প্রকৃতিবিজ্ঞানের সব শাখায় আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। ইউরোপে একজন ব্যক্তি একাই দশ হাজার মতো উদ্ভিদ প্রজাতিকে চেনার সামর্থ্য অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতেও এরুপ ব্যক্তি দরকার যারা একাই দশ হাজার না হোক হাজার পাঁচেক উদ্ভিদ চিনতে পারবেন। উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পর্কে জ্ঞান মানবজাতিকে রক্ষা এবং এই পৃথিবীকে রক্ষার জন্যই জরুরি।

বাংলাদেশে প্রায় আড়াই শত প্রজাতির ফল পাওয়া যেত। একটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ছাত্রদেরকে ফলের নাম জিগ্যেস করলে ছাত্ররা একটানা ২০টি ফলের নাম বলতে পারে না। এটি আমি আমার নিজ অভিজ্ঞতাতেই দেখেছি। বাংলাদেশের একটি ফল রক্তগোটা প্রায় বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেল, অনেকটা কৃষকের চেষ্টায়। ফলটিকে সহজলভ্য করে আরো ভালোভাবে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা যায়। ফলের ২৫৫ প্রজাতির মধ্যে অর্ধেকই বিলুপ্ত হতে চলেছে।

ফল সম্পর্কে অজ্ঞতা আমাদের জাতিকে কূপমণ্ডুক করে তুলেছে। ২০১২ সালের দিকে ফজলি আমের  স্বত্ব ভারতের হাতে চলে গেছে। এই নিয়ে সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি তখন সপ্তাহখানেক ছিলো। কিন্তু সেই কথা সবাই ভুলে গেছে। আমের জাতগুলোকে আমরা রক্ষা করতে পারছি না। ভারতে যদি সাড়ে চারশ জাতের আম থাকে তবে বাংলাদেশেও সমান সংখ্যক জাতের আম থাকার কথা। কিন্তু আমরা কবে সেসব জাতের রক্ষার বিষয়ে সোচ্চার হবো।

আমি সিলেটের এক ব্যাক্তির কাছে ১২ জাতের জামের কথা শুনেছিলাম। এখন বাংলাদেশে ১ জনও ব্যক্তি বেঁচে নেই যে এই ১২ জাতের জামের নাম বলতে পারে; জামগুলোও বাঁচানো গেল না। জামের জাত এবং প্রজাতিগুলো রক্ষা করা যায়নি। জামের জাতগুলো সম্পর্কে কোনো গবেষণাও বাংলাদেশে হয়নি। অথচ জামের রয়েছে হরেক ভেষজ গুণ। বন বিভাগে যারা চাকরি গ্রহণ করেন তারা যদি এসব জাত সম্পর্কে আগ্রহী হন তবে আমরা বেশ কিছু গবেষণা, অন্ততপক্ষে এসব প্রজাতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেতে পারি। 

আরো পড়ুন:  বিলিম্বি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফলদ বৃক্ষ

বাংলাদেশে এখন বিদেশী গাছ লাগানোর উৎসব চলছে বলা যায়। এসব বিদেশী গাছ পরিবেশের জন্য ভাল নয়। হাজার হাজার বছর ধরে একটি অঞ্চলের জলবায়ু গড়ে উঠে। ফলে এই জলবায়ুতে বিদেশী প্রজাতি ঢূকালে সেটি আগ্রাসি প্রজাতির রূপ নিয়ে পারে এবং স্থানীয় প্রজাতির জন্য হুমকি হতে পারে। বিদেশী উদ্ভিদ প্রজাতিগুলো দেশি অনেক প্রজাতির জন্য হুমকি হয়েছে এবং ফলশ্রুতিতে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বিদেশী গাছ লাগানোর ফলে বাংলার পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে হলে দেশের হারিয়ে যাওয়া গাছগুলোকে ফিরিয়ে আনতে হবে। অবশ্যই একটি উদ্ভিদের জার্ম প্লাজমের জন্য বিশাল আকারের উদ্ভিদ উদ্যান গড়ে তুলতে হবে। অনেক গবেষক এবং উদ্ভিদপ্রেমি, প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশপ্রেমি ব্যক্তিকে এসব বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নতুবা পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না।

বি দ্র: প্রথম রচনাকাল ১২ আগস্ট, ২০১২, পরবর্তীতে ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৭ তারিখে লেখাটি পরিবর্ধন করা হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!