কাকমাচি বা ফুটি বেগুন বা বায়সী একটি বেগুন বা টমেটো জাতীয় উদ্ভিদ। এই বেগুনগুলো খুব ছোট আকারের হয়। এরা এক ধরনের গুল্ম যাদের অনেক ভেষজ গুণাগুণ আছে। নিম্নে সেসবের কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।
আভ্যন্তরিক প্রয়োগের (Internal medication) ক্ষেত্রে স্বাদুপত্র কাকমাচী ব্যবহার করতে হবে, এই গাছের পাতা তিতো বা তিক্ত নয়; তবে মিষ্টিও নয়। এ বিচারটা করে যদি চিনে নেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে ব্যবহার না করাই ভাল। এটি এক ধরণের গুল্ম। দুই ধরণের কাকমাচি আমাদের চোখে পড়ে একটির ফল কালো আর অন্যটির সবুজ।
কাকমাচি দুরকম, স্বাদু ও তিক্ত। কবিরাজী চিকিৎসাশাস্ত্রে স্বাদুকে ব্যবহার করা হয় আভ্যন্তরীণ এবং তিক্তকে ব্যবহার করা হয় বাহ্য প্রয়োগে। দক্ষিণ কোলকাতায় বাজারে কাকমাচি ফল বিক্রি হয়। অনেকে শাকের মতো রান্না করে খান লিভার ভাল রাখার জন্যে আর ইউনানী কবিরাজরা নিয়ে যান শুকিয়ে ওষুধ তৈরি করার জন্যে। যে গাছের পাতা ছোটো, হাল্কা সবুজ, ফল পাকলে লাল-কমলা হয় সেটা স্বাদু প্রকৃতির আর যে গাছের পাতা বড় এবং ঘন সবুজ সেটা তিক্ত বা বিষাক্ত শ্রেণীর। কালো-বেগুনী ফল কখনো খাওয়া উচিত নয়।
১. প্রমেহ রোগ: আয়ুর্বেদে দু’টি কথা আছে মেহ ও প্রমেহ। এই দুটিই রোগের নাম। এই মেহ রোগটা বংশগতও হয় না। আর রক্ত বা মাত্রাগতও হয় না; প্রমেহ রোগ তা হয়। এই কাকমাচীর পাতা প্রমেহের ক্ষেত্রেই কাজ করে। এটা রসবহ স্রোত দূষিত হয়ে যে প্রমেহ রোগ হয়, তাকেই আমরা বলি মূত্রাতিসার অর্থাৎ প্রচুর পরিমাণ প্রস্রাব হবে এবং আস্তে আস্তে শরীর দূর্বল হতে থাকবে, আর থাকে পিপাসা, আলস্য, নিদ্রা এবং পায়ের মাংসপেশীগুলিতে ব্যথা হবে। এক্ষেত্রে স্বাদু, কাকমাচী পাতার রস একটু গরম করে, ছেঁকে নিয়ে সেই জলটি সকালের দিকে ১ চা চামচ ও বিকালের দিকে ১ চা চামচ, খেলে মূত্রাতিসারে উপকার হবে। আর অগ্নিবল যদি ভালো থাকে, তাহলে ২ চা চামচ করে খেলেই হবে।
২. পান্ডু রোগ: যাকে ভুলবশত জন্ডিস বলা হয়, এটা সে রোগ নয়; এটা আসলে রক্তাল্পতা, বর্তমানের এনিমিয়া (Anaemia) রোগ। যাঁরা এই রোগাগ্রস্ত, তাঁদের শরীরটা হবে ফ্যাকাসে, দাস্ত হবে ছাড়া ছাড়া বা ভসকা, মলে থাকবে টক গন্ধ; এদের ক্ষেত্রে স্বাদু কাকমাচী, এই গাছের ফল পাকলে মিষ্টি লাগে আর রং হয় লাল, এগুলি কাকে খায়; সে পাতার রস গরম করে, ছেঁকে, সকালে ও বিকালে এক চা চামচ করে খেতে হবে। এটাতে এনিমিয়াটা চলে যাবে, তবে এর সঙ্গে লোহঘটিত ঔষধ খাওয়া ভালো।
৩. কুচো ক্রিমি: যাকে আমরা চলতি কথায় কুচো ক্রিমি বলে থাকি (Thread worms), এই ক্ষেত্রে স্বাদু, কাকমাচী পাতার রস ১৫ ফোঁটা তা যদি বালক হয় ও ৭ থেকে ৮ চা চামচ দুধ মিশিয়ে খেতে হবে। তবে রসটা গরম করে ছেঁকে নিতে হবে।
৪. মূত্রকৃচ্ছ্র: বায়ু বিকারে মূত্রবহ স্রোতের গ্রন্থি যখন শিথিল হয়ে যায়, তখন প্রস্রাব ধরে রাখার ক্ষমতা আর থাকে না, আর যদি গ্রন্থি স্ফীত হয় তাহলে বারে বারে প্রস্রাব হয় বটে, কিন্তু কষ্টের সঙ্গে এবং পরিমাণেও অল্প হতে থাকে। এইটাই মূত্রকৃচ্ছ্র রোগ। অবশ্য অস্মরী হলে কোনো কোনো সময় তার সঙ্গে ব্যথাও অনুভূত হতে থাকে। এক্ষেত্রে স্বাদু কাকমাচী পাতার রস গরম করে, ছেঁকে নিয়ে এক বা দুই চা চামচ খেতে হবে।
৫. অরুচি: স্বাদু কাকমাচীর পাতা অল্প সিদ্ধ করে, জল ফেলে দিয়ে সেই শাক ঘি দিয়ে সাঁতলে শাকের মতো প্রথমে ভাতের সঙ্গে খেলে অরুচি সেরে যাবে।
৬. এলার্জি বা আভ্যন্তরীণ শোথ: এই রোগ সাধারণত পিত্ত শ্লেষ্মা প্রধান লোকদের হয়ে থাকে। এদের পক্ষে উষ্ণগুণান্বিত দ্রব্যই শোথের কারণ হয়। সেক্ষেত্রে স্বাদু কাকমাচীর রস ১ চা চামচ গরম করে, ছেঁকে দু’বেলাই খেতে হবে। আর যদি গায়ে চাকা চাকা হয়ে ফুলে ওঠে, তাহলে ঐ গাছ বাটা অল্প গরম করে গায়ে লাগালেও ওটা কমে যাবে।
৭. বিষিয়ে যাওয়ায়: কোনো জায়গায় বিষাক্ত পোকার কামড়ে বা লোমফোড়া হয়ে কিংবা নখ লেগে বিষিয়ে গিয়ে যদি ফুলে লাল হয়ে ওঠে ও যন্ত্রণা হয়; সেক্ষেত্রে কাকমাচীর গাছ পাতা বেটে, সামান্য গরম করে ঠান্ডা হওয়ার পর অল্প ঘি মিশিয়ে আহত জায়গায় লাগালে ওটার বিষটা কেটে যাবে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো এখানে স্বাদুপত্র কাকমাচী ব্যবহার না করলেও চলবে।
৮. ঘামাচি: কুনো ব্যাঙের গায়ের মতো শরীরে চাপড়া ঘামাচি হয়েছে সেক্ষেত্রে এই কাকমাচী পাতা বাটা হলুদের মতো গায়ে মাখলে ওটা সেরে যায়।
৯. চুলকানিতে: এটা শরৎকালে ও শীতের শুরুতে বেসাতি, এটির বৈশিষ্ট্য হলো প্রথমেই হাতে ধরবে, তারপর যোগ্যস্থানে আক্রমণ করবে। এদের পক্ষে কাকমাচী বাটা একটু গরম করে গায়ে মাখলে ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই এই রোগটা চলে যাবে। তাছাড়া সম্ভব হলে স্বাদু কাকমাচীর পাতা জলে অল্প সিদ্ধ করে, জলটা ফেলে দিয়ে, শাকের মতো রান্না করে অল্প পরিমাণে খেতে পারলে আরও ভালো হয়।
৯. কুষ্ঠ রোগ: এই রোগে স্ফোটক যখন বেরোয় সেক্ষেত্রটা সর্বদাই থাকবে, কোনো অঙ্গের অগ্রভাগ, যেমন হাতের, পায়ের, নাকের, কানের ও চোখের জায়গাটিতে। এ রোগে আরও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই স্ফোটক বা ফোড়া ওঠার সময় তার রংটা থাকবে কালো, ব্যথাও তেমন হবে না ও পুঁজও হবে না, অথচ ক্ষত বেড়ে যেতে থাকবে। এই রকম ক্ষেত্রে যে কাকমাচীটা তিতো বা তিক্ত সেইটার রস একটু গরম করে, ছেঁকে, এক চা চামচ করে সকালে ও বিকালে ২ বার খেতে হবে। আর ঐ পাতা বেটে ব্যাধিতস্থানে প্রলেপ দিতে হবে।
১০. ঝাপসা দেখায়: তিতো কাকমাচি বা ফুটি পাতা গরম জলে ধুয়ে, থেঁতো করে তার রস এক বা দুই ফোঁটা একবার করে চোখে দিতে হবে। এই রকম একদিন অন্তর ৫ থেকে ৬ দিন ব্যবহার করার পর ঐ ঝাপসা দেখা চলে যাবে, তবে প্রাচীন বৈদ্যদের অভিমত হলো রসটা গরম করে ছেঁকে, ঠান্ডা হলে সেই রস চোখে ফোঁটা দেওয়াই ভালো।
১১. চোখে পিচুটি পড়ায়: অনেকের চোখে দেখা যায় যে সমস্ত দিনই চোখের কোণে জমা কফের মতো অথবা জমা কফের সুতোর মতো পিচুটি পড়ছে। এটা এক ধরনের নেত্রনালী রোগ। এই রোগের ওষধ হলো কাকমাচি বা ফুটি ফল অল্প শুকিয়ে নিয়ে, একটি পাত্রে আগুন রেখে তার মধ্যে ঐ ফল দিয়ে, তার ধোঁয়া চোখে লাগাতে হবে; তবে সরাসরি ধোঁয়া যেন চোখে না লাগে, তাই কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ঐ ধোঁয়া চোখে লাগাতে হবে।
রাসায়নিক গঠন
(a) Alkaloids, viz, Solanine, Saponin. (b) Riboflavin, nicotinic acid,
Vitamin-C, ß-carotene, Sitosterol. (c) Steroidal glycoalkaloids, viz., Solamargine, solasonine and a- and 6-solanigrine, (d) Tygogenin,
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য: ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা,২৪৮-২৫০।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Yercaud-elango
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।