তুলসি গাছ বা তুলশীর বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum tenuiflorum Linn. পরিবার Labiatae সুরসাদিগণে (Group) বর্তমানে ব্যবহৃত কয়েক প্রকার তুলসীর উল্লেখ দেখা যায়; কিন্তু তার নাম ধাম ও আকারে বর্তমানে সামঞ্জস্য করা কঠিন; আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি গ্রন্থের মতে এই তুলসীগুলি কফ, ক্রিমি, প্রতিশ্যায়, অরুচি, শ্বাস ও কাস দূর করে এবং ব্রণশোধক; তবে কোনো তুলসী এবং তার কোনো অংশ কি রোগের ক্ষেত্রে বিশেষ উপকারী, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা নেই।
আমাদের আলোচ্য নিবন্ধে বহুল ব্যবহৃত উপকারি ও সহজলভ্য তুলসির কথা বলা হচ্ছে। এটির বৈজ্ঞানিক নাম: Ocimum tenuiflorum, এবং ইংরেজি নাম Sacred Basil, holy basil, বা tulasi. এরা সুগন্ধিময় বহুবর্ষজীবী বীরুৎ, ১৪০ সেমি পর্যন্ত উঁচু। কাণ্ড চতুষ্কোণাকার, খাঁজযুক্ত, স্পষ্টত রোমশ, প্রায়ই রক্তবেগুনি, নিচে কাষ্ঠল। প্রধানত হিন্দুদের পুজোপচারে ব্যবহৃত এই তুলসিই বাংলাদেশ ভারতের সর্বত্র পাওয়া যায়।
তুলসি বা কালো তুলসি একটি উপকারি গুল্ম
ঔষধি ব্যবহার
১. যেসব শিশুদের মধ্যে সর্দি কাসির প্রবণতা আছে; অতি তুচ্ছ কারণেও সর্দি হয়, তাদের প্রতিদিন সকালে ৫ থেকে ১০ ফোঁটা তুলসী পাতার রস ২ থেকে ৫ ফোঁটা মধু মিশিয়ে অথবা না মিশিয়ে খাওয়ালে সে অসুবিধা থাকবে না। এমন কি এর দ্বারা শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর হবে; এটা অবশ্য সব বয়সেই ব্যবহার করা চলে।
২. কাঁচা সর্দিসহ যে কোনো প্রকার জ্বরে আদা ও তুলসীপাতার রস যে কোনো বয়সের রুগি ঔষধ হিসাবে খেতে হবে।
৩. শিশুদের পেটকামড়ানি, কাসি ও লিভারের দোষে প্রাচীন বৈদ্যগণ এই পাতার রস ও মধু ব্যবহার করে থাকেন।
৪. যাঁদের অকালে শরীর ও মন বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, তাঁরা আধা ইঞ্চি পরিমাণ তুলসীর মূল তবে কালো তুলসী হলে ভাল হয়; পানের সঙ্গে সকালে ও বিকাল চিবিয়ে খেলে কয়েকদিনের মধ্যে উদ্দীপনা উপলব্ধি করবেন; তবে আনুষঙ্গিক কারণগুলিও নিরসন করার প্রয়োজন আছে।
৫. তুলসী পাতা ও কাঁচা হলুদের রস একটু আখের অর্থাৎ ইক্ষুর গুড় মিশিয়ে খেলে আমবাতের উপশম হবে; এ ভিন্ন এটি ব্লাড সুগারকেও শাসন করে।
৬. প্রায় সব জাতের তুলসীর বীজ জলে ভেজালে পিচ্ছিল হয়, কারণ জলগুণ প্রধান বলে বিশেষত বাবুই ও রামতুলসীর; এই জলে চিনি মিশিয়ে খেলে প্রস্রাবঘটিত পীড়ায়, প্রস্রাবের জ্বালা যন্ত্রণার ক্ষেত্রে বিশেষ উপকার হবে।
৭. এই গাছের পাতা ও দূর্বা কাঁজি দিয়ে বেটে গায়ে মাখলে চুলকানি ও ঘামচি ভালো হয়।
৮. কোনো কোনো স্থানে যেকোনো প্রকার পোকামাকড় এমন কি বোলতা বিছাতে কামড়ালে তুলসী পাতার রস লাগিয়ে থাকেন।
৯. মুখে বসন্তের কালো দাগে তুলসীর রস মাখলে ঐ দাগগুলি মিলিয়ে যাবে; এমন কি হামের পর যেসব শিশুর শরীরে কালোদাগ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে তুলসী পাতার রস মাখলেও শরীরের স্বাভাবিক বর্ণ ফিরে আসে।
১০. তুলসী পাতা ছেঁচে পুঁটলি করে সেই রসের নাস নিলে অর্থাৎ নাকে টানলে নাসা রোগের শান্তি হয়।
১১. শ্লেষ্মার জন্য নাক বন্ধ হলে কোনো গন্ধ পাওয়া যায় না; সে সময় শুকনো পাতা চূর্ণর নস্যি নিলে সেরে যায়।
১২. হাম ও বসন্ত বের হতে দেরী হচ্ছে; তুলসীপাতার রস খাওয়ালে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবে।
১৩. কোনো কারণে রক্ত দূষিত হলে কালো তুলসী পাতার রস কিছুদিন খেলে সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
১৪. কানে ব্যথা ও যন্ত্রণায় যদি শ্লেষ্মাজনিত কারণে হয় তাহলে পাতার রস অল্প গরম করে তুলি দিয়ে কানে লাগালে উপশম হবে।
১৫. তুলসী পাতা চায়ের মতো তৈরী করে অনেক খেয়ে থাকেন এতে নীরোগ থাকা সম্ভব।
১৬. তুলসী পাতার রসে লবণ মিশিয়ে দাদে লাগালে উপশম হয়।
১৭. তুলসীতে Eugenol অধিক পরিমাণে থাকায় তা Cox-2 Inhibitor রূপে কাজ করে বলে তা ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১৮. Hypoglycemic drugs এর সাথে তুলসী খেলে তা টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগে দ্রুত গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
১৯. তেজস্ক্রিয়তার ফেলে ক্ষতিগ্রস্থ কোষসমুহকে মেরামত করে।
২০. চর্বিজনিত হৃদরোগে এন্টি অক্সিডেন্টের ভুমিকা পালন করে।
২১. তুলসী একশোরও বেশি Phytochemicals (যেমন oleanolic acid, beta caryophyllene ইত্যাদি) বহন করে বলে ক্যান্সার চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয়।
২২. তুলসীর অ্যালকোহলিক নির্যাস Immune system এর রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।
২৩. তুলসী স্নায়ুটনিক ও স্মৃতিবর্ধক।
২৪. শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্নরোগ যেমন ব্রঙ্কাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাঁপানি প্রভৃতি রোগের নিরাময়ক।
২৫. জ্বর, বমি, ডায়ারিয়া, কলেরা, কিডনির পাথর, মুখের আলসারসহ চোখের বিভিন্ন রোগে ইহা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২৬. দাঁতের রোগে উপশমকারী বলে টুথপেস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ৭৬-৭৮।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Mithu
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।