শ্বেত, নীল, কৃষ্ণ, লোহিত এবং পীত পুষ্পের ধুতরা দেখা যায়। এই সব ধরণের ফুলের কাজ সমান হলেও কালো ধুতরা ফুল বেশি কার্যকর। আরো পড়ুন ধুতরা, কালো ধুতরা ও রাজ ধুতরা এই ৩ প্রকার ধুতরার কথা প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা যে ধুতরা সাধারণত ভেষজ কাজে লাগাই সেটির দ্বিপদ নাম বা বোটানিক্যাল নাম Datura metel Linn. এটি সোলানাসি পরিবারের Datura গণের একটি বীরুত বা গুল্ম। এর হিন্দি নাম ধতুর, ধুরা, ধতুরা। ঔষধে ব্যবহার করা হয় পত্র, ফল ও মূল।
ধুতরা বাংলাদেশ ও ভারতের ভেষজ গুণের উদ্ভিদ
আর এক প্রকার ধুতরা গাছ বিহারের অঞ্চল বিশেষে এবং উত্তরবঙ্গে দেখা যায়। এগুলি ৬ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়, তার পাতাগুলি দেখতে অনেকটা বাসক (Adhatoda vasica) পাতার মত, ফুলগুলি অপেক্ষাকৃত লম্বা; কুচবিহার অঞ্চলে একে বলে গজঘণ্টা ধুতরা। বিহার প্রদেশের বৈদ্যগণের মতে এটি রাজধুতরা।
প্রাচীন বৈদ্যক গ্রন্থে ধুতরার ব্যবহার
১. উন্মত্ত কুকুর ও শৃগালে কামড়ালে: ধুতরার মূল কাঁচা দেড় গ্রাম পুনর্নবার (Boerhaavia repens.) কাঁচা মূল ৫ গ্রাম একসঙ্গে বেঁটে শীতল দুধ বা পানির সাথে পান করতে হবে সুশ্রুত সংহিতায় বলা হয়েছে। কল্পস্থানের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে এটি উল্লেখ করা হয়েছে।
২. উন্মাদে: ধুতরার মূলের খুব সরু, যে শিকড় অর্থাৎ মূল শিকড় বাদ দিয়ে কাঁচা ১ গ্রাম বা ৭ থেকে ৮ রতি শিলে বেটে সেটা আধা সের জলে গুলে সেই জলে ৫০ গ্রাম আন্দাজ পুরানো চাল আধ সের দুধে ও মাত্রামত চিনি বা মিছরি দিয়ে পায়েস করে সেটা সকালে এবং বিকালে খাওয়ার কথা বলা আছে চক্রদত্ত সংগ্রহে (এটি ১১ শতকের গ্রন্থ)। তবে রোগীর বলাবল, ক্ষেত্র, বয়স এসব বিচার করে রোগীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত।
মন্তব্য: বিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ভিন্ন জনসাধারণের পক্ষে এটি ব্যবহার করা উচিত হবে না। ধুতরা গাছের কোনো অংশের আভ্যন্তরিক প্রয়োগে (internal application) চিকিৎসের পরামর্শ প্রযোজন।
৩. গরলবিষে ধুতরার মূল, কাঁচা হলুদ, শিরীষ ফুল (Albizia lebbeck Benth) একসঙ্গে বেটে লাগালে গরল বিষ দূর হয়।
পাতার ব্যবহার
৪. টাক রোগে বা বিক্ষিত টাকে: এটা একপ্রকার Fungus infection. এ ক্ষেত্রে ধুতরা পাতার রস মাথার যেখানে সমস্যা হয়েছে সেখানে লাগাতে বলেছেন বাগভট (এটি ষষ্ঠ শতকের গ্রন্থ); এটা বলা হয়েছে উত্তরতন্ত্রের ২৬ অধ্যায়ে। তবে অনেক সময় দেখা যায় প্রায় সমগ্র মাথায় এই রোগ ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে, সেক্ষেত্রে পাতার রস আজ এধার ও কাল ওধার করে লাগাতে হয়; দিনে একবারের বেশী লাগানো উচিত নয়, আর এক দিন বাদ এক দিন লাগালেই ভাল। পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই রোগের নাম দেওয়া হয়েছে Alopecia areata, যদি দেখা যায় যে মাথায় একটা যন্ত্রণা অনুভব করছেন, তা হলে এটা ব্যবহার করা সমীচীন হবে না।
৫. ক্রিমিতে: পাতার রস ২ থেকে ৩ ফোঁটা করে দুধের সঙ্গে খাওয়াতে বলেছেন ভাবপ্রকাশ। এ ক্ষেত্রে প্রয়োগের বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার নেই, পরীক্ষা প্রয়োজন।
৬. স্তনের ব্যথায়: কাঁচা হলুদ ও ধুতরার পাতা বেঁটে অল্প গরম করে লাগাতে বলা হয়েছে। এটাও ভাবপ্রকাশের যোগ।
৭. ফুলো ও ব্যথায়: ধুতরার পাতার রস করে, তাকে জ্বাল দিয়ে ঘন করে দেখতে মধুর মতো ঘনত্ব তারপরে তুলা দিয়ে লাগাতে হবে, এর দ্বারা ব্যথা ও ফুলো দুয়েরই উপশম হয়। আর যদি এর সঙ্গে একটু আফিং ও মুসব্বর মিশিয়ে লাগানো যায় তবে আরও ভালো ফল পাওয়া যাবে।
৮. ফিক ব্যথায়: সে ঘাড়ে বা পিঠে যে কোনো জায়গায় হোক না কেন, ধুতরার পাতা ও চূর্ণ একসঙ্গে মিশিয়ে রস বের করে সেই রসটা লাগালে ঐ ব্যথা কমে যায়; অন্ততঃ ৩ বার ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা অন্তর লাগাতে হয়।
৯. সাদা আমাশায়: কাল ধুতরার পাতার রস ৩ থেকে ৪ ফোঁটা আধ পোয়া দই এ মিশিয়ে খেতে বলে থাকেন।
১০. হাঁপানীতে: কালো ধুতরার শুষ্ক পাতা ও ফুল বাসক পাতায় বেঁধে চুরুট তৈরী করে সেই চুরুটের ধোয়া টানলে হাঁপের টান কমে যায় বটে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সর্দিটা টেনে যায়। বাসক পাতা বা ফল ভেঙে বিড়ির তামাকের মতো করে নিতে হয় তার মাত্রা হবে ৩ রতি থেকে ৬ রতি পর্যন্ত।
বৈদ্যবাড়ীর কনক তৈল
প্রস্তুত বিধি: সরষের তেল ১ কেজি, ধুতরার পাতা ডাঁটাসহ কুটে নিয়ে রস নিংড়ে বের করে নিতে হবে ২ কেজি বা লিটার। আর পাতা নিতে হবে ১০০ গ্রাম আন্দাজ। তেল আগুনে চড়িয়ে নিষ্ফেন হয়ে ধোঁয়া উঠলে নামিয়ে ঠান্ডা হলে ঐ রসটা এবং ঐ পাতা বাটা অল্প অল্প করে দিতে হবে। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পরে আন্দাজ ২ সের জল দিয়ে পাক করতে হবে, জলটা মারে গেলে, ঐ তেলটাকে ছেঁকে নিতে হবে।
১১. পাদদারী রোগে: যাঁদের পায়ের তলা ফেটে ফেটে যায়, তাকেই পাদদারী রোগ বলে। এ ক্ষেত্রে উপরিউক্ত কনক তেল বিশেষ উপকারী।
১২. হুলিতে: এই কনক তেল লাগালেও কাজ হয়।
১৩. কানের যন্ত্রণায়: উদ্ধর্গ শ্লেষ্মার দোষে কানে বা কপালে যন্ত্রণা হয়, সে ক্ষেত্রে কানে তেলের ফোঁটা দেওয়া আর কপালের যন্ত্রণায় একটু তেল কপালে মালিশ করতে হবে।
১৪. শ্বাসে: সমগ্র গাছকে অর্থাৎ গাছ, পাতা, মূল, ফুল ও ফল সিদ্ধ করে অন্যান্য দ্রব্য সহযোগে সন্ধিত আসব (Fermentation) করা হয়। এইটি কনকসব নামে প্রচলিত।
১৫. বাতের ব্যথায়: ধুতরা পাতার রসের সঙ্গে সরষের তৈল মিশিয়ে গরম করে মালিশ করলে কমে যায়।
১৬. ফোঁড়ায়: ধুতরার পাতার রসের সঙ্গে সামান্য একটু গাওয়া ঘি মিশিয়ে প্রলেপ দিলে পেকে যায়।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ২৮০-২৮৫।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Halavar
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।
আমার চুল পড়ে যাচ্ছে কিছু দিন হল। আমি ন্যাড়া করে পেয়াজ রস দিয়েছি, ভিটামিন ই ট্যাবলেট খেয়েছি কিন্তু চুলপড়া বন্ধ হচ্ছে না, এখন ধুতরা পাতার রস মাথা ন্যাড়া করে লাগাতে হবে নাকি চুলের উপর লাগানো যাবে?
মাথায় লাগানোর কত সময় পর ধুয়ে ফেলতে হবে? কতদিন লাগাতে হবে?
জানালে উপকৃত হব!!
আপনি একদিন পর একদিন চুল থাকা অবস্থায় লাগাবেন। তাহলে চুল পড়া বন্ধ হবে এবং নতুন চুল গজাবে। তবে সাবধান এ রস যেনো কোনোক্রমে মুখে না যায় তাহলে পাগল হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এই রস উপকারি যেমন, ক্ষতিকারকও তেমন। তবে লাগানোর পর মাথায় জালাপোড়া করলে লাগাবেন না।