ভূমিকা: বন তেজপাতা, দাঁতরাঙ্গা, লুটকি (বৈজ্ঞানিক নাম: Melastoma malabathricum , ইংরেজি: Indian Rhododendron) মেলাস্টোমাসি পরিবারের, মেলাস্টোমা গণের একটি এক প্রকারের গুল্ম। মাঝারি আকারের এই ঝপালো গুল্মের আগায় গোলাপি-বেগুনি রঙের ফুলে ভরে যায়। সারা বছর এই গাছে ফুল ফোটে। বাগানের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য এই গাছ লাগানো যতে পারে।[১] বাংলাদেশে দাঁতরাঙাকে আগাছা বা অপ্রয়োজনীয় গাছ হিসেবে মনে করা হয়। তবে বর্তমানে এদের কিছু ভেষজ গুণাগুণ জানা গেছে। গণের নাম ত্থেকে পাওয়া গ্রিক শব্দ Melastoma অর্থ Black Mouth বা কালো মুখ। পাতাগুলো দেখতে কিছুটা তেজপাতার মতো হবার কারণে অনেকে এদেরকে বন তেজপাতা বলে থাকেন।
বৈজ্ঞানিক নাম: Melastoma malabathricum L., Sp. Pl.. 1:390 (1753). সমনাম: Melastoma affine D. Don (1823), Melastoma polyanthum Blume (1831), Melastoma royenii Blume (1831), Melastoma ellipticum Naud. (1849), Melastoma scabrum Ridl. (1918). ইংরেজি নাম: Indian Rhododendron. স্থানীয় নাম: বন তেজপাতা, দাঁতরাঙ্গা, লুটকি। চাকমা ভাষায় নাম: ‘মুওপিত্তিংগুলো’।
জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস জগৎ/রাজ্য: Plantae. বিভাগ: Angiosperms. অবিন্যাসিত: Edicots. বর্গ: Myrtales. পরিবার: Melastomataceae. গণ: Melastoma প্রজাতির নাম: Melastoma malabathricum
বর্ণনা:
দাঁতরাঙ্গা গুল্মটি প্রায় ৩ মিটার পর্যন্ত উঁচুহয়। এর উপশাখাগুলো চতুষ্কোণী এবং চেপ্টা থেকে প্রশস্ত, সুক্ষ্ম-খন্ডিত এবং তামাটে শঙ্কদ্বারা ঘন আবৃত। গাছের পাতা দেখতে উপবৃত্তাকার থেকে ভল্লাকার। পাতার আকার ৫-২০ × ১.৫-৭.০ সেমি। শীর্ষ তীক্ষ্ম বা খর্ব দীর্ঘা, নিম্নপ্রান্ত তীক্ষ বা গোলাকৃতি, ৫-শিরাল, উভয়পৃষ্ঠ খর্বাকৃতির চেপ্টা রোমাবৃত, পত্রবৃন্ত ০.৪-১.৮ সেমি লম্বা।
পুষ্পমঞ্জরীতে ৩ থেকে ৭টি ফুল থাকে; যা ঠাসা বা শিথিল স্তবক, প্রান্তীয় বা উপরের পাতার কাক্ষিক। মঞ্জরীপত্র কখনও স্থায়ী এবং বৃহৎ ও সুদৃশ্য, ২ সেমি পর্যন্ত লম্বা, বহি:পৃষ্ঠ বিশেষ করে মধ্যশিরা বরাবর চেপ্টা এবং সাদাটে বা লালচে শঙ্ক দ্বারা ঘন আবৃত। হাইপ্যানথিয়াম ৫-৯ মিমি লম্বা, চেপ্টা এবং অল্প পরিসরে চতুষ্কোণী, রুপালী থেকে হলুদাভ পিঙ্গল বর্ণের শঙ্ক দ্বারা কমবেশী ঘন আবৃত, শল্ক ১-৩ মিমি লম্বা ।
বৃত্যংশ ডিম্বাকার-ত্রিকোণাকার এবং আকারে ০.৫-১.৩ সেমি লম্বা, অঙ্কীয়পৃষ্ঠ মসৃণ, পৃষ্ঠীয়দেশ হাইপ্যানথিয়ামের ন্যায়। শল্কাবৃত। পাপড়িগুলো ২.০-৩.৫ সেমি লম্বা, পাটল বর্ণ থেকে ফিকে লাল বা বেগুনি। পুংকেশর ১০টি, কদাচিৎ ৮ বা ১২টি, দ্বিরুপী, পরাগধানী সরু ডিম্বাকার, বহি:পরাগধানী ৭-৯ মিমি লম্বা, বিবর্ণ বেগুনি বর্ণের, অন্তঃপরাগধানীগুলো ৫-৬ মিমি লম্বা, হলুদ। গর্ভাশয় ৫প্রকোষ্ঠীয়, অগ্রভাগ কুৰ্চ আবৃত, ডিম্বক অনেক।[২]
ক্রোমোসোম সংখ্যা:
2n = ২৮ (Gill et al., 1979).
দাঁতরাঙা গাছের বংশবিস্তার ও চাষাবাদ:
দাঁতরাঙ্গা গাছটি বেশ ঝোপালো। এটি উন্মুক্ত জায়গা ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। যে বন বা জঙ্গলে মানুষ সহ অন্য তৃণভোজীর চলাচল কম সেখানে বেশি জন্মে। তবে এই গাছটি মূলত পাহাড়ি। বিঘ্নিত মাঠ, রাস্তার পাশে, ঝোপ-ঝাড় এবং নদীর পাড় এই গুল্মের পছন্দের স্থান। এই গুল্ম যেহেতু ঝোপ-ঝাড়ের গাছ তাই বিশেষ যত্নের প্রযোজন নেই। বাড়ির উঠানে, প্রতিষ্ঠানে বা টবে লাগিয়ে শোভাবর্ধনের জন্য যত্ন নেয়া যায়। স্বাভাবিক আলো বাতাস, পানি সরবাহ, আগাছা পরিষ্কার ইত্যাদি করলেই গাছ বেড়ে উঠবে ও ফুল ফুটবে।
এদের কাণ্ডের রং লালচে। এসব গাছের কাণ্ড নরম, সরল পত্র এবং প্রায় সারা বছর উজ্জ্বল বেগুনি রঙের ফুলে গাছ ভরে থাকে। এই ফুলে পাপড়ি থাকে মোট পাঁচটি। ডালের আগায় থোকা আকারের ফুল ফোটে। ফুল মাঝারি আকারের হয়। গোলাপি, বেগুনি রঙের ফুলের মাঝখানে হলুদ বেগুনি রঙের অসমান কয়েকটি পুংকেশর থাকে। ফল ডিম্বাকৃতির ও ছোট হয়। কালো শাঁস জড়ানো থাকে।[৩]
ফলের রঙ সবুজ। ফল পাকলে ফেটে যায় আর ভেতরের কালো শাঁস ফাটা অংশ দিয়ে বের হয়ে থাকে। পাকলে ফলগুলো খেতে তেতো-মিষ্টি লাগে। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এ ফল খুব মজা করে খায়। ফল খাওয়ার পরে দাঁত ও জিহবা বেগুনি রঙে রঙিন হয়ে যায়। এই কারণেই এদের নাম হয়েছে দাঁতরাঙা। আদি ফুটকির প্রাকৃতিক রং গোলাপি এবং মেজেন্টা হলেও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা ইদানিং বিভিন্ন রঙের হাইব্রিড ফুটকি উৎপাদন করছেন। বীজ থেকে নতুন চারা জন্মে। সারা বছর গাছে ফুল ফোটে। বাণিজ্যিকভাবে এর চাষও হচ্ছে।
বিস্তৃতি:
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং উদ্ভিজ্য অঞ্চল থেকে নিউগিনি বরাবর ফিলিপাইন এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের ভেতরে এটি প্রধানত পাহাড়ি বা উচুঁ এলাকায় সহজে জন্মে থাকে। তবে পঞ্চগড়, গাজীপুর, কাশিমপুর, শ্রীপুর ও সিলেট এলাকায় বেশি দেখা যায়। টেকনাফ ও বান্দরবান এলাকায় এর আরও কয়েকটি জাতের দেখা মেলে।
দাঁতরাঙা ভেষজ গুণ:
ইহার ফলের শাস ভক্ষনযোগ্য। ইহার পাতা উদরাময় এবং আমাশয় চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় । ইহার পাতা অগ্নিদগ্ধ এবং দ্রুত বর্ধনশীল ক্ষত নিরাময়েও ব্যবহৃত হয়।
জাতিতাত্বিক ব্যবহার:
থাইল্যান্ডে মেওহিল আদিবাসীরা ইহার শিকড়ের নির্যাস পানিতে ফুটিয়ে প্রসব পরবর্তী জটিলতায় ব্যবহার করে। ইন্দো-চীনে ইহার পাতা এবং পুষ্প শ্বেতপ্রদর রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় । ফিলিপাইনে ইহার বাকলের ক্বাথ সর্দিজনিত গলবিল প্রদাহ এবং মুখের পচনে ব্যবহৃত হয়।[২]
ফুটকির রয়েছে নানাবিধ ঔষধি গুণ। লোকায়তিক চিকিৎসায় এটি ব্যবহার হতে দেখা যায়। এটি কৌষ্ঠ্যকাঠিন্য রোগে ব্যবহৃত হয়। দাঁতরাঙার পাতার নির্যাস মানবদেহের ক্যান্সার, হৃদরোগ রোধে সহায়ক। তাছাড়া এর পাতার রস আমাশয়, পেটব্যথা, বাত ও বাতজ্বর দূর করতে পারে। আলসার, উচ্চ রক্তচাপ, দাঁত ব্যথা, চর্মরোগ ও ডায়রিয়া চিকিৎসায় দাঁতরাঙা ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কাটাছেঁড়ায় ফুটকির পাতা তাৎক্ষণিক রক্ত পড়া বন্ধ করে। এ গুল্মের আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যেখানে দাঁতরাঙা ফোটে সেখানে চা বাগান তৈরি করা যায়। আর সে কারণেই টি ইন্ডিকেটর বা চা নির্দেশক শ্রেণীর উদ্ভিদ হিসেবে একে ধরে নেয়া হয়।
অন্যান্য তথ্য:
বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৯ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) দাঁতরাঙ্গা প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে দাঁতরাঙ্গা সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির বর্তমানে সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই।[২]
তথ্যসূত্র:
১. দ্বিজেন শর্মা লেখক; বাংলা একাডেমী ; ফুলগুলি যেন কথা; মে ১৯৮৮; পৃষ্ঠা- ৫৫, আইএসবিএন ৯৮৪-০৭-৪৪১২-৭
২. এম অলিউর রহমান (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৯ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৭০। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
৩. শেখ সাদী, উদ্ভিদকোষ, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা, ২৩২, আইএসবিএন ৯৮৪-৪৮৩-৩১৯-১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।