গ্রীষ্ম ও শীতকালের জনপ্রিয় মোরগঝুঁটি বা মোরগ ফুলের চাষ ও পরিচর্যা পদ্ধতি

মোরগঝুঁটির (Celosia argentea) আরেক নাম সিলোসিয়া। এই ফুল ভেলভেটের মতো মোলায়েম ও মোরগের ঝুঁটির মতো দেখতে হয় বলে এই ফুলকে মোরগঝুঁটি বলা হয়। মোরগঝুঁটি প্রধানত: গ্রীষ্মকালীন ফুল তবে শীতকালেও চাষ হতে দেখা যায়। উর্বর দো-আঁশ মাটিতে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে মোরগঝুঁটি চাষ করাই উত্তম। গাছ ২০-৫০ সেঃ মিঃ উচু হয়ে থাকে।

জাত:

রূপালী, সাদা, লাল, গাঢ় কমলা, হলুদ, সোনালী ও মিশ্র রঙ এর মোরগঝুঁটি প্রধানত: ৪ প্রজাতির। যেমন—

১. সিলোসিয়া ক্রসিটটা এর ফুল বড়, চ্যাপ্টা ও ঠাসা। এবং হলদে হালকা ও গাঢ় কমলা, গাঢ় পিঙ্ক, ক্রিমসন বেগুনি প্রকৃতি রঙ হয়ে থাকে।

২. সিলোসিয়া প্লুমোসা এর ফুল লম্বা ধান শীষের মতো এবং কাণ্ড ও শাখার মাথায় জন্মে থাকে। ফুলের রঙ সাধারণত লাল, ক্রিমসন, ফিকে ও গাঢ় হলদে হতে দেখা যায়।

৩. সিলোসিয়া অরেজেনসিয়া এর ফুল দেখতে ঝুলতে শিসের মতো হয়ে থাকে। এবং

৪. সিলোসিয়া চাইন্ডসাই এর ফুল গোল বলের মতো লালচে বা গাঢ় পিংক রঙের হয়ে থাকে।

জমি প্রস্তুত:

মোরগঝুঁটির জমি ২ ধাপে প্রস্তুত করতে হয়। একবার বীজতলা হিসেবে যেখানে বীজ বপন করে চারা উৎপাদন করা হয় এবং দ্বিতীয় ধাপে যেখানে উৎপাদিত চারা স্থায়ী বাগানে লাগানো বা রোপন করা হয়।

চারা উৎপাদনের বীজতলা প্রস্তুত:

সূর্যালোকিত জায়গায় উচু দো-আঁশ বা বেলে মাটিই বীজতলার জন্যে উপযোগী। ৭৫ সেঃ মিঃ থেকে ১ মিঃ প্রস্থ, ১.৫ মিঃ থেকে ৩ মিঃ বা তারও বেশি দৈর্ঘ্য এবং ভূমি থেকে ১০-১৫ সেঃ মিঃ উচু জমি বাছাই করে, চারপাশে ২০-৩০ সেঃ মিঃ চওড়া ও ১০-১৫ সেঃ মিঃ গভীর সেচান রাখতে হয় তলা প্রস্তুতির কাজগুলি করতে হয়। কাজগুলো যথাক্রমে-

ক. মাটি কুপিয়ে নরম ও ঝুরঝুরে করতে হবে।

খ. কোপানো মাটির সাথে ঝুরঝুরে মাটির ১০ ভাগ এর সাথে ১ ভাগ পচা পাতা সার বা শুষ্ক গোবর সার মিশাতে হবে।

গ. উপরোক্ত আয়তনের জমিতে ২০০-২৫০ গ্রাম এস এস পি ও ৫০-৬০ গ্রাম পটাশ প্রয়োগ করে মিশানোর পর মাটি সমান করে দিতে হবে।

ঘ. এই সময় ব্রাসিকল ৭৫ এবং বি সি ৫০ এর ০.৪% স্প্রে দ্বারা ৪-৬ সেঃ মিঃ গভীর পর্যন্ত মাটি ভিজিয়ে মাটি শোধন করতে হবে।

ঙ. এর ৪ থেকে ৫ দিন পর মাটির উপর স্তর আলগা করে জমিতে বীজ বা কাটিং লাগাতে হবে।

চারা লাগানোর জমি প্রস্তুত:

মোরগঝুটি ফুল চাষের জমি উর্বর, উঁচু, শুষ্ক ও সহজে জল নিষ্কাশন করা যায় এমন জমিই উত্তম। দক্ষিণ খোলা উর্বর হালকা দো-আঁশ মাটি মোরগঝুঁটি চাষে উপযোগী। তবে এটেল মাটি আরো ভালো।

ক. নির্বাচিত জমি লাঙ্গল বা কোদাল দিয়ে ৪ বা ৫ বার গভীর ভাবে কর্ষণ করে মাটিকে ঝুরঝুরে করতে হবে।

খ. আগাছা, ইট, পাটকেল, পাথর, আবর্জনা ইত্যাদি পরিষ্কার করে প্রতি ১০০ মিটার। জায়গায় ২০০ কেজি পাতা-পচা সার বা গোবর সার, ৬-১০ কেজি কাঠের ছাই, ২-৩ কেজি এস এস পি সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।

গ. এটেল মাটির জমিতে চাষের সময় সামান্য চুন মিশাতে হবে যা দো-আঁশ মাটিতে দরকার হবে না। মাটি শোধণের জন্যে সমগ্র মাটিতেই ৩০ গ্রাম অলড্রিন এবং ২৫০ গ্রাম ব্রাসিকল ২০ সামান্য গুড়া সারের সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

ঘ. এই অবস্থায় মাটি সমতল করে ৩ থেকে ৪ সেঃ মিঃ বীজের ও ৪-৫ টি পাতার কলমের চারা রোপনের ব্যবস্থা করতে হবে।

চারা উৎপাদন ও চারা রোপণ:

প্রস্তুতকৃত বীজতলা মাটি যথাযথ ভাবে প্রস্তুত করতে হবে।

ক. ঝুরঝুরে করে এপ্রিল-মে মাসে। মোরগ ফুলের বীজ সামান্য ছাই এর সাথে মিশিয়ে বপন করতে হয়।

খ. বপনের পর সামান্য জল ছিটিয়ে মাটি হালকা ভাবে চাপিয়ে সমান করে দিতে হয় এবং পাখি বা ছাগল- গরু যাতে ক্ষতি না করতে পারে সেজন্যে চারদিকে বেড়া দিয়ে দেয়া ভালো।

গ. বীজতলায় যাতে কোনোভাবেই জলাবদ্ধতা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে প্রয়োজন। মাটি খুব বেশি শুকিয়ে গেলে পরিমাণ মতো জলসেচ দিতে হবে।

ঘ. চারায় ৪-৫টি পাতা গজালেই পূর্বে প্রস্তুত করা স্থায়ী বাগানের মাটিতে রোপনের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ১৫-২৫ সেঃ মিঃ এবং লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব হতে পারে ৩০-৪০ সেঃ মিঃ।

মোরগঝুঁটি পরিচর্যা:

গাছ লাগানোর সময় থেকে পরিচর্যার ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুবা ভালো ফল পাওয়া যাবেনা।

ক. চারা লাগানোর সময়ই সামান্য ফসফেট সার দিতে হবে এবং সামান্য জলসেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

খ. পানি জমে যাওয়া বা পানি শূন্য হয়ে যাওয়া কোনটাই চন্দ্রমল্লিকা সহ্য করতে পারেনা বিধায় ফুল আহরণ পর্যন্ত প্রয়োজন মতো সেচ দিতে হবে।

গ. গাছ সামান্য বড় হলেই ছোট ছোট চিকন খুটির সাথে গাছগুলিকে বেধে দিলে ভালো হবে এবং অপ্রয়োজনীয় ডাল ছেটে দিতে হবে।

ঘ. গাছের চাহিদার অতিরিক্ত সার দেয়া হলে গাছ থেকে পাতা বড় হবে ও ডগা দুটি বেঁধে যাবে এবং ফুল ছোট হবে। এ অবস্থায় গাছের ডগা ছেটে দিতে হবে।

ঙ. চারা লাগানোর ১৫ দিন পর থেকে প্রতি ১৫ দিনে একবার পরিমাণ মতো তরল। সার এবং মাসে একবার মাছের গুড়া চাপান সার হিসেবে দিতে হবে।

চ. গাছে কুড়ি আসার সময় একবার বা দুইবার অ্যামোনিয়াম সালফেট বা ইউরিয়া বা অন্য কোন নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করতে হবে।

ছ. নাইট্রোজেন সার বেশি মাত্রায় দেয়া যাবেনা। কেননা তাতে ফুলের আকার ছোট ও রঙ ফ্যাকাসে হবে।

জ. অতিরিক্ত পর্যাপ্ত পটাশ সার দিলে ফুলের রঙ ভালো হয় এবং অতিরিক্ত ফসফরাস। সার দিতে ফুলের রঙ খারাপ হয়। তাই ফসফরাস সার বেশি মাত্রায় দেয়া যাবেনা।

ঝ. গাছের গোড়ার মাটি নিয়মিত আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তবে মাটি সাবধানে খুড়তে হবে যাতে গাছের শেকড় না কাটে।

ঞ. গাছ বড় হলে প্রতিটি গাছে ৩ থেকে ৪টি বড় শাখা রেখে বাকীগুলি ছেটে দিলে ফুল বড় হবে।

ট. প্রদর্শনীর জন্যে বড় ফুল পেতে পাশের কুড়ি ছেটে দিয়ে নিয়মিত সার প্রয়োগ, জলসেচ ও রোগ বালাই দমন করতে হবে।

ঠ. গোবর সার ও সরিষার খইল ভিজিয়ে তরল সার তৈরী করে চারা রোপণের পরের মাস থেকেই দিতে হবে এবং কুড়ি আসার সময় তরল সারে সামান্য ইউরিয়া মিশিয়ে দিতে হবে।

ড. গাছ ২৫ থেকে ৩০ সেঃ মিঃ লম্বা হলে প্রধান শাখাটি কোনো বাউনীতে বাড়িলে দিলেও তাতে ছোট ছোট শাখা বের হবে এবং ফুলের উৎপাদন হবে।।

মোরগঝুঁটির ফুল সংগ্রহ:

জুলাই-আগষ্ট মাসে অর্থাৎ চারা লাগানো ২-৩ মাসের মধ্যেই মোরগঝুটির গাছ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। এ সময় নিজস্ব ব্যবহারের জন্যে লম্বা বোটাসহ তুলে এনে সাজানো যায়।

তথ্যসূত্র:

১. সিরাজুল করিম আধুনিক পদ্ধতিতে ফুলের চাষ প্রথম প্রকাশ ২০০১ ঢাকা, গতিধারা, পৃষ্ঠা ১১৫-১১৭। আইএসবিএন 984-461-128-7

আরো পড়ুন:  বাংলাদেশ ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার সহজলভ্য নয়ন মোহিনী দশটি ফুল

Leave a Comment

error: Content is protected !!