বর্ষজীবী গুল্ম, কাণ্ড খাড়া, ৬-১৮ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে। সমগ্র ভারতের সমতল ভূমিতে এবং ৫০০০ ফুট পর্যন্ত উঁচু স্থানে এটিকে পাওয়া যায়। এছাড়া চীন, মালয়, অস্ট্রেলিয়াতেও পাওয়া যায়।
কান্ড স্থুল, চতুর্ভুজাকার, খাঁজ কাটা কাটা এবং ছোট ছোট সাদা রোমে আবৃত থাকে। পাতা আয়তাকার ১-৩ ইঞ্চি লম্বা, ক্রমশঃ সরু, অগ্রভাগ ভোঁতা, কিনারা অবিন্যস্তভাবে খাঁজ কাটা, অল্প রোমশ। ফুল ছোট, গুচ্ছবদ্ধ, সাদা, ঘন্টার মত আকৃতি। বীজ সরষের চেয়েও ছোট, মসৃণ, কালো বা ধূসর বর্ণের। শীতের শেষে ফুল ও ফল হয়।
হিন্দীভাষী অঞ্চলে এবং পাঞ্জাবে এটি সাথী, সাঠী, সমুন্দর-সোক, সমুন্দর-সোখ, কম্মরকস, সমুদ্রশোষ প্রভৃতি নামে পরিচিত। বাংলায় এটিকে ভূ-তুলসী, কোকবুরাদি বলে। বোটানিক্যাল নাম Salvia plebeia R. Br., পরিবারের নাম Labiatae. Argeria speciosa গাছের বীজকে কেউ কেউ সমুন্দর, সোখ বললেও যেটি সমুন্দর-সোখ হিসেবে বাজারে পাওয়া যায়, সেটি কিন্তু এটি নয়।
ভূ তুলসী-র ঔষধ হিসাবে প্রয়োগ
ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ— বীজ। বীজের প্রয়োগ গুরু, বিষ্টম্ভী, দীর্ঘপাকী, উষ্ণ, স্নেহন, পৌষ্টিক, পিচ্ছিল ও সংশমন। এটি অগ্নিমান্দ্য, অতিসার, অর্শ, রক্তপ্রদর, বাধক, গনোরিয়া, শুক্রমেহ, শুক্রতারল্য, স্বপ্নদোষ, মূত্রদাহ প্রভৃতি রোগে ব্যবহার্য।
বীজ ভিজিয়ে রাখলে তা ফুলে গিয়ে এক প্রকার থলথলে, অনেকটা জেলীর মত আকার নেয়। বোম্বে অঞ্চলে এর বীজ সম্ভোগ ইচ্ছা বাড়াবার জন্য ব্যবহৃত হয়। মাথার চুলকে চকচকে রাখার জন্য মেয়েরা এই বীজের ব্যবহার করে থাকেন। ইউনানী মতে এটি মধু ও শর্করার (চিনি) সঙ্গে সেবন নিষিদ্ধ। বিশেষতঃ বীর্য পুষ্টিকর দ্রব্য হিসেবে এর ব্যবহার বেশি দেখা যায়।
১. অগ্নিমান্দ্যে: নানা কারণে অগ্নিমান্দ্য হতে পারে, কিন্তু যেখানে কোন না কোনভাবে অত্যধিক শুক্রক্ষয়ের ফলে এটি আসে, আর তার সঙ্গে থাকে খিটখিটে মেজাজ, সামান্য কারণে উত্তেজিত ভাব, কখনো কখনো প্রস্রাবে জ্বালাবোধ, সেক্ষেত্রে ভূ-তুলসীরবীজ চূর্ণ ১ গ্রাম মাত্রায় দিনে ২/৩ বার জল সহ খেলে এবং সেই সঙ্গে গুরুপাক খাদ্য দ্রব্যগুলি খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিলে ১০/১৫ দিনের মধ্যেই উপকার বুঝতে পারবেন। আরও কিছুদিন ব্যবহার করে যেতে হবে। ২/৩ মাস ক্রমাগত খেলেও ক্ষতি নেই।
২. রক্তপ্রদরে: যাঁদের ঋতুধর্ম এখনো বন্ধ হয়নি, তাঁদের বেলায় যদি মাসিক ঋতুস্রাব বেশি হতে থাকে অর্থাৎ পরিমাণে বেশি এবং দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে এবং এর পেছনে যদি কোন বিশেষ কারণ অর্থাৎ গর্ভপাত, অস্ত্রোপচার কিংবা কোন বিশেষ রোগের ইতিহাস না থাকে, তাহলে এর বীজ চূর্ণ ১ গ্রাম মাত্রায় দিনে ৩ বার করে ১০/১৫ দিন খেতে হবে। ১ গ্রাম বীজ আধ কাপ ঠাণ্ডা জলে ঘণ্টা দুই ভিজিয়ে রেখে তারপর খেলে ভাল কাজ হয়। সেই সঙ্গে বেশি চলাফেরা, ভারি কাজ করা প্রভৃতি একেবারেই বন্ধ রাখা দরকার।
৩. স্বপ্নদোষে: স্বপ্ন শব্দটির সঙ্গে দোষ শব্দটিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এ দোষ শব্দটি নিন্দনীয় অর্থে নয়। স্বাভাবকিভাবে মানুষের যৌবন আসে এবং ঐ সময় সে নানা রঙ-বেরঙের স্বপ্নও দেখতে থাকে, স্বপ্ন অন্য বয়সের লোকেও তো দেখে, কিন্তু দোষ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে সেক্ষেত্রেই, যেক্ষেত্রে স্বপ্ন দেখার ফলে সুপ্তাবস্থায় বীর্যস্খলন হয়ে যায়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রাথমিক মতানুসারে এই স্বপ্নদোষটিকে কিন্তু কোন দোষের মধ্যে বা রোগের মধ্যে ফেলা হয় না, অতি স্বাভাবিকভাবেই যৌবনের প্রারম্ভেই আসে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ের পর প্রায়ই হতে দেখা যায় না।
কিন্তু যেক্ষেত্রে এই স্বপ্নদোষ মাত্রাতিরিক্ত হতে থাকে, অর্থাৎ সপ্তাহে ৩/৪ দিন বা বেশি, কিংবা স্বাভাবিক সাংসারিক জীবন-যাপন করা সত্ত্বেও যার প্রায়ই স্বপ্নদোষ হতে থাকে, সেক্ষেত্রে এটি স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্যবোধের শিকার হয়ে পড়েন। এইরূপ ক্ষেত্রে ভূ তুলসীর বীজচুর্ণ ১ গ্রাম মাত্রায় দিনে ৩ বার। সকালে, বিকালে ও রাত্রে হালকা গরম দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে। প্রত্যেক বার দুধ আন্দাজ আধ কাপ নিতে হবে। এটা একটু বেশিদিন ব্যবহার করা দরকার, আর সেইসঙ্গে স্বপ্ন দেখার সম্ভাব্য মানসিক কারণগুলি থেকে দূরে সরে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
৪. শুক্রতারল্যে বা শুক্রাল্পতায়: অত্যধিক স্বপ্নদোষের ফলেই হোক আর বৈধ বা অবৈধ যেভাবেই হোক, শুক্রধাতুর অত্যধিক ক্ষয় হওয়া মানেই শরীর ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শরীরে শুক্রধাতুর ক্ষীণতা আসে অর্থাৎ তখন প্রয়োজনমত শুক্র স্খলিত হয় না। শরীর ক্ষীণ বা দুর্বল হলে সতেজ শুক্র নির্গত হওয়া সম্ভবও নয়। এ তো আর কোন থলেতে ভরা থাকে না, যার থেকে কিছুটা গড়িয়ে নেওয়া যাবে। হর্ষোৎফুল্ল মুহুর্তে শরীর মথিত হয়ে নির্দিষ্ট স্থানসমূহ থেকে নিঃসরিত পদার্থ সমূহের সমষ্টিই তো শুক্রধাতু। আর সন্তান উৎপাদনের জন্য সতেজ (অতি মাত্রায় শুক্রকীট সম্পন্ন) শুক্র অপরিহার্য। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে ভূ তুলসী-র বীজচূর্ণ ১ গ্রাম আধ কাপ গরম দুধের সঙ্গে মিশিয়ে দিনে ২/৩ বার করে খেলে ২/৩ মাসের মধ্যে উপকার পাবেন।
৫. সদ্যোগে অনিচ্ছায়: এই অনিচ্ছাটা কি ছেলেদের আর কি মেয়েদের সকলেরই জীবনে আসে একটু একটু করে, অর্থাৎ খুব ধীরে ধীরে, আচমকা নয়, আর সাধারণতঃ সেটা আরম্ভ হয় পড়ন্ত যৌবনের পর থেকেই এবং একেবারে অনিচ্ছায় পরিণত হয় বার্ধক্যে, তবে তা একেক জনের একেক বয়সে। এই স্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দেবার পূর্বেই যদি অনিচ্ছা এসে দেখা দেয়, নতুবা দ্রুত গতিতে এটি এসে হাজির হয়, তখন কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার এই মনঃকষ্ট থেকে নানাবিধ জটিল মানসিক ব্যাধির শিকার হওয়াটা কারো কারো ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এইসব ঝামেলার হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে করণীয় হচ্ছে- ১ গ্রাম মাত্রায় ভূ তুলসী-র বীজচুর্ণ দিনে ২ বার অর্থাৎ সকালে ও বৈকালে হালকা গরম দুধের (আন্দাজ আধ কাপ) সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া আরম্ভ করতে হবে। সপ্তাহতিনেকের পর থেকেই উল্লেখযোগ্য ফল উপলব্ধি করতে পারা যায়।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৯, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৫, পৃষ্ঠা, ২২১-২২২।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি flowersofindia.net থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Gurcharan Singh
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।