আদার বা আর্দ্রক (বৈজ্ঞানিক নাম: Zingiber officinale Rosc.) হচ্ছে জিঞ্জিবারাসি পরিবারের জিঞ্জিবার গণের কন্দজাতীয় উদ্ভিদ। ভারতের সর্বত্র আদা হলুদের (বৈজ্ঞানিক নাম: Curcuma longa) মতো চাষ হয়, তবে কম-বেশি গাছ ২ থেকে ৩ ফুট উচু হতে দেখা যায়; সুবিন্যস্ত পত্র ১ থেকে ১১/২ ইঞ্চি চওড়া, ১২।১৩ ইঞ্চি লম্বা। এর পাতাগুলি সুন্দর ভাবে সাজানো দেখেই বৈদিক যুগে তার নাম সৌপর্ণ; এতে একটি সুমিষ্ট-গন্ধেরও অস্তিত্ব থাকে।
রান্নায় স্বাদ আনে আদা। খাওয়া-দাওয়ার আগে আদার কুচি নুন দিয়ে খেলে বা সাদা বাংলায় যাকে আদা-নুন বলা হয় খেলে মুখে খাওয়ার রুচি আসে, খিদে বাড়ে। সেই জন্যে বলা হয় ‘ভোজনাগ্রে সদা পথ্য আর্দ্রক লবণ-মিশ্রিত’;— এইভাবে আদা খেলে খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয়, কফ আর বায়ু রোগ হয় না, গলা বা কণ্ঠ ও জিভের শুদ্ধি হয়। ভোজনের আগে আদা-নুন সর্বদাই পথ্য। বিশেষত বর্ষা ও শীতে এইভাবে আদা খাওয়া শরীরের পক্ষে হিতকর। আদা শুধু খাদ্যরুচিই বাড়িয়ে দেয় তা নয় স্বরভঙ্গ, শ্বাসের কষ্ট বা হাঁপানি, কাশি, কোষ্ঠবদ্ধতা, কফ, বায়ু, ফোলা, মন্দাগ্নি সারিয়ে দেয়।
আদার মোরব্বা, অবলেহ ও পাক তৈরি করা হয়। আদার সঙ্গে পাতিলেবুর রস মিশিয়ে আচারও তৈরি করা হয়। শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, নাভা অর্থাৎ গর্ভবতী এবং প্রসূত অর্থাৎ যাদের সদ্য বাচ্চা হয়েছে সকলেই আদা খেলে উপকার পাবেন। আদা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন
আদা একটি ঔষধি কন্দজ গুল্ম
আদা গাছের মূলই (কন্দ) গ্রহণ করা হয়; আবার তাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকিয়ে নেওয়া হয়, তখন তার নাম হয় শুঠ বা শুণ্ঠী। আয়ুর্বেদিক গ্রন্থে ঔষধার্থে শুঠের ব্যবহারই বেশি, তাই প্রায় সর্বত্র শুঠের নামের উল্লেখ দেখা যায়; এ ভিন্ন তার আরও নাম আছে বিশ্ব, শৃঙ্গবের, কটুভদ্র, নাগর প্রভৃতি। তার আদ্রক নামকরণে তাৎপর্য হ’লো জন্মক্ষেত্র স্যাঁতস্যাঁতে ভূমিতে (আর্দ্র ভূমিতে)। এই হিসেবে তার নাম আর্দ্রক। তবে সে নিজে তেজোগুণে ভরপুর-সোমগণে নয়। এখানে দ্রব্য-সংগঠনে পঞ্চমহাভূতের মধ্যে তেজ বা অগ্নিগুণেরই আধিক্য।
রোগ প্রতিকারে আদার ব্যবহার
১. পেটের সমস্যা দূর করে: আদা মল পরিষ্কার করে, ভারী, উষ্ণ, খিদে বাড়ায়, তীক্ষ্ণ, পাকে মধুর, রুক্ষ, বায়ু ও কফ দূর করে। শরীরের ভেতরের বায়ু ও আমাশায় সারিয়ে তোলে।
২. অরুচি: মধ্যাহ্ন আহারের অব্যবহিত পূর্বে সৈন্ধব লবণ দিয়ে একটু আদা চিবিয়ে খেলে ক্ষুধা বাড়ে; মুখের বিরসতা, জিভের ও গলার কফের জট এবং জড়তা দুইই নষ্ট হয়।
৩. হৃদরোগ দূর করে: আদার রস শরীর শীতল করে, মধুর, তীক্ষ, এবং হার্টের পক্ষে ভাল। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের মতে আদা হৃদগ্রন্থির বলকারক।
৪. হজম বাড়ায়: আদার কাজি বা পানীয় নুন মিশিয়ে পান করলে খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয়, খিদে বেড়ে যায়, কোষ্ঠবদ্ধতা দূর হয় এবং আমাশয় সারে। আদা খেলে মুখে বেশি থুতু বা লালা উৎপন্ন হয়। এই লালা বা ইংরেজিতে স্যালাইভা খাবার হজম তাড়াতাড়ি করাতে সাহায্য করে। সেইজন্যে অরুচি ও অখিদে দূর করতে আদা খাওয়া, বিশেষত খাওয়ার আগে জরুরি।
৫. বায়ু দূর করে: আদার রস পাতিলেবুর রস ও নুন বা শুধু নুন মিশিয়ে খেলে মুখশুদ্ধি হয়- খিদে বাড়ে, রুচিকর, সায়ক অর্থাৎ বন্ধ বায়ু ও মল নিঃসরণ করে, খেতে ভাল লাগে, বায়ু ও কফ নাশ করে ফোলা কমিয়ে দেয় ।
৬. কাশি দূর করে: কাশি ও হাঁপানি সারাতে আদার রসে মধু মিশিয়ে খাওয়া উচিত।
হাকিমি বা কবিরাজি মতে আদার উপকারিতা:
১. পেটের সমস্যা দূর করে: আদা বিরেচক বা মল পরিষ্কার করে ও পাচক বা খাবার হজম করায়। পাকস্থলী ও লিভারের শক্তি ও স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে দেয়। মস্তিষ্কের বা ব্রেনের দূষিত রস, পেটের পুরানো বদ্ধমল ও পাকস্থলীর কৃমি নিসারণ করে, অরুচি নাশ করে।
২. বিভিন্ন কারণে ফুলে যাওয়া সারাতে: শিরা ও পেশী যদি বায়ুবৃদ্ধির কারণে ফুলে ওঠে কমিয়ে দেয়। আদা বাটার প্রলেপ লাগালে ঠাণ্ডা লাগার জন্যে যদি শরীরের কোনো অংশে ব্যথা হয়, শ্লেষ্মর জন্যে যদি কোনো অংশ ফুলে ওঠে এবং এই ধরনের সব ব্যথায় আরাম হয়। অল্প তিল তেলে আদার রস পাক করে নামিয়ে নিয়ে গরম গরম মালিশ করলে বায়ুজনিত ব্যথা, ফিক ব্যথা ও সন্ধিস্থলের ব্যথা সারে।
৩. ইন্দ্রিয়জনিত রোগ সারাতে: নাক, কান ও গলার রোগ সারিয়ে দেয়। শ্বাস, কণ্ঠ বা শ্বাসরোগ, কাশি ও বধিরতা উপশম করে। আদার মোরব্বা খেলে কফ রোগ সারে।
৪. চোখের সমস্যা সারাতে: পক্ষাঘাত (প্যারালিসিস) চোখের ছানি এবং অন্য চোখের রোগে উপকার করে।
বৈদ্যশাস্ত্রের মুষ্টিযোগ:
১. কানের ব্যথায়: তিল তেল, আদার রস, মধু ও নুন মিশিয়ে গরম করে কানে ফোঁটা দিলে কানের ব্যথা সারে।
২. খিদে না হলে: এই সমস্যায় খাবার ঠিক আগে চার পাঁচ কুচি আদা নুন মিশিয়ে চিবোলে উপকার পাওয়া যায়।
৩. নতুন সর্দি: কাঁচা সর্দি কাশিতে এক চা চামচ মধু মিশিয়ে এক চা চামচ আদার রস পান করলে কষ্ট কমে।
৪. শীত পিত্ত বা আমবাত: পুরোনো গুড়ের সঙ্গে আদার রস মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
অনেকে বলেন আদার আদি জন্মস্থান ভারতবর্ষ ; আদাকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় আর্দ্রক। আদা তরকারিতে দিলে স্বাদ বাড়ে, সুঘ্রাণ হয়। আদার পাচক রসের জন্যে তরকারি তাড়াতাড়ি হজম হয়। ভাল করে চিবিয়ে আদা খেলে মুখ থেকে অধিক পরিমাণ লালা বেরোয়। সে কারণেও ব্যঞ্জন তাড়াতাড়ি হজম হয়। আদা ও লঙ্কা দুটিই স্বাদে তীব্র ও ঝাল। কিন্তু লঙ্কা বেশি খাওয়া ভাল নয়। সে হিসেবে পরিমাণ মতো আদা খেলে তার অপকারিতা নেই। অতএব তরকারির স্বাদে তীব্রতা বাড়াতে লঙ্কার পরিবর্তে আদা ব্যবহার করা যেতে পারে।
আধুনিক মতে আদার উপকারিতা:
১. ক্ষুধা বাড়ায়: আদা ক্ষুধাবর্ধক, জীবনীশক্তি বাড়িয়ে তোলে। আদার রসে মধু মিশিয়ে খেলে সর্দি, কাশি, ও অখিদে দূর হয়।
২. পেটের সমস্যা দূর করতে: উত্তেজনা বৃদ্ধি করে, অম্ল (অম্বল) নিবারণ করে, পেটফাঁপা রোগের পক্ষে এটি মহৌষধ। আদার রস খেলে উদরশূল বা পেট ব্যথা সারে। আদার রস চুনের জলের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে অম্ল রোগের উপশম হয়।
৩. দাঁতের রোগ সারাতে: আদা চিবিয়ে খেলে দাঁতের রোগ ও টনসিল সারে। আদা গরম জলে সেদ্ধ করে বেটে তার প্রলেপ লাগালে দাঁতের ব্যথা ও মাথা ব্যথা সারে।
৪. মাথার ব্যথা কমাতে: আদার রস নাকে নস্য হিসেবে দিলে মাথা ব্যথা সারে।
৫. শরীরের শক্তি বাড়াতে: আগে ভারতীয় বিশেষত বাঙালিদের মধ্যে নিয়ম ছিল সকালে স্নান করে আদা ছোলা খাওয়া। এতে শরীর খুবই তাজা থাকতো এবং কাজ করবার শক্তি পাওয়া যেত। এই অভ্যাসটি আবার চালু করলে কোনও অসুবিধেও নেই এবং এটা কিছু ব্যায় সাপেক্ষও বা পরিশ্রম সাপেক্ষও নয়।
আদার রাসায়নিক গঠন:
(a) Terpenoids viz., camphene, betaphenandrene, cineol, citral, borneol gingerol, shogaol. (b) Salt viz., potassium oxalate. (c) Traces of essential oil.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা,১৮৯-১৯০।
২. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ৫৭-৫৮।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।