পরিচিতি: ডেউয়া মোরাসি বা তুঁত পরিবারের আর্টোকারপাস গণের বহু শাখায়িত একটি বৃক্ষ প্রকৃতির গাছ। এই গাছ উচ্চতায় ১০ থেকে ২০ মিটার হয়। ঘন ও ছড়ানো চূড়াবিশিষ্ট, কচি বিটপ অতি রোমশ। এদের গুঁড়ি কাণ্ড সরল, সোজা, নলাকার এবং বাকল অমসৃণ, গাঢ় বাদামি বা ধূসর বর্ণের। এর বিভিন্ন অংঙ্গ ভেঙ্গে গেলে দুধের মতো সাদা কষ বের হয়।
পাতা সরল, একান্তর, বৃন্তক, পত্রবৃন্ত ১.০-২.৫ সেমি লম্বা, ফলক উপবৃত্তাকার, ডিম্বাকার বা দীর্ঘায়ত, ১২-২৫ X ৬-১৫ সেমি, চর্মবৎ, নিম্নপ্রান্ত তির্যক গোলাকার বা হৃৎপিণ্ডাকার, নিম্নপৃষ্ঠ রোমশ এবং উপরের পৃষ্ঠ মসৃণবৎ কিনারা মসৃণ এবং আগা সূচালো।
এপ্রিল-মে মাসে গুচ্ছাকারে ক্রিম-হলুদ বর্ণের ফুল ফোটে। এরা উদ্ভিদ সহবাসী, পুং এবং স্ত্রী শিরমঞ্জরী একই উদ্ভিদে আলাদা আলাদা ভাবে জন্মায়। পুং পুষ্পধার প্রায় অবৃন্তক, ৩ সেমি পর্যন্ত ব্যাসবিশিষ্ট, রোমশ। স্ত্রী পুষ্পধার বৃন্তক, ১০ সেমি পর্যন্ত ব্যাসবিশিষ্ট অনিয়মিতভাবে খন্ডিত, মখমলীয়।
ফল সিনকার্প, গোলকাকার, অনিয়মিত দর, পরিপক্ক অবস্থায় কমলা লাল বর্ণের, নরম এবং সরস। বীজ সাদা, দীর্ঘায়ত। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে এপ্রিল-জুন মাসে।
স্ত্রী ফুল থেকে ফল হয়। ফল কাঁঠালের মতো, তবে আকারে ছোট, গোলাকার, ৫-১০ সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের তবে অসমান, খসখসে ও একাধিক ভাঁজযুক্ত। ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং জুলাই-আগস্ট মাসে পরিপক্ক ফল হলদে-সবুজ থেকে কমলা-লালচে বর্ণের হয়। পাকা ফল নরম এবং সরস। পাকা ফলগুলোর খোসা (আবরণ) বেশ পাতলা এবং ভেতরের অংশ ফ্যাকাসে হলুদ বা কমলা-লালচে বর্ণের এবং নরম, মাংসলও ভক্ষণীয়। ফলের প্রতিটি কোয়ার সাথে বীজ থাকে। বীজ সাদা, দীর্ঘায়ত। ফলের হলুদ পাল্পের মধ্যে বীজগুলো ছোট গোলাকার সাদাটে বর্ণের। প্রতি কেজিতে বীজের সংখ্যা ৫০০-৭০০টি। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ১০-১৫ দিন পর্যন্ত বীজ সংরক্ষণ করা যায়।
ভৌগোলিক বিস্তৃতি: আর্দ্র পত্রঝরা এবং চিরহরিৎ অরণ্য। ডেউয়া বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় পাওয়া যায়। অন্যত্র প্রবর্তিত এবং আবাদী।
বাংলাদেশে বিস্তৃতি ও প্রাপ্তিস্থান: বর্তা বা ডেউয়া মূলত কাঁঠাল পরিবারভুক্ত দেশিয় গাছ হিসেবে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে বুনো পরিবেশে জন্মাতে দেখা যায়। এ ছাড়া দেশব্যাপী গ্রাম-গঞ্জে বিক্ষিপ্তভাবে কম-বেশি লাগানো বর্তা গাছ রয়েছে।
প্রজনন ও বংশবিস্তার: সাধারণত বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বীজ থেকে বর্তার চারা জন্মায় ও বংশ বিস্তার হয়। নার্সারিতে জুলাই-আগস্ট মাসে সংগৃহীত পাকা ফল পানিতে ভিজিয়ে হাত দিয়ে কচলিয়ে বীজগুলো বের করা হয়। অথবা ফল খাওয়ার পর সংগৃহীত বীজ কয়েক দিনের মধ্যে পলিব্যাগে বপন করতে হয়। বীজ গজানো বা অঙ্কুরোদগমেরহার শতকরা ৫০-৬০ ভাগ। চারা গজাতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। ক্রোমোসোম সংখ্যা: 2n = ৫৬ (Kumar and Subramaniam, 1986).
গুরুত্ব ও ব্যবহার: কাঠ হলুদাভ বাদামি বর্ণের, মধ্যম ভারী ও টেকসই। ঘর-বাড়ি ও অবকাঠামো নির্মাণে কাঠ ব্যবহৃত হয়। এর লম্বা নলাকার গুঁড়ি খুঁড়িয়ে আস্ত নৌকা/ডিঙ্গি বানানো হয়। ফলের হলুদ পাল্প ভক্ষণীয় এবং স্বাদে হালকা টক-মিষ্টি। পাকা ফল লবণ-মরিচ মাখিয়ে খেতে বেশ মজা। ফল ক্ষুধা ও শক্তিবর্ধক। বর্তার বীজ আগুনে ভেজে বা পুড়িয়ে খাওয়া যায়। পানের সাথে বাকল চিবিয়ে খাওয়া হয়।(Das and Alam, 2001).
শিকড় থেকে এক প্রকার হলুদ রং নিষ্কাশন করা হয় (Das and Alam, 2001). কান্ডের বাকলে ষ্টীলবিন, ক্রিষ্টাল্লাইন, ট্রাইটারপিন্স, লুপিউল, লুপিউল এসিটেট, বিটা-এ্যামাইরিন। এসিটেট, সাইক্লোয়ার্টেনল এবং তদ্বীয় যৌগ বর্তমান। কান্ডের বাকল ফিতা কৃমিনাশক। বাকলের ক্বাথ মুখের ব্রণ, ত্বক ফাটা এবং ক্ষতে ব্যবহৃত হয় (Ghani, 2003). ফল কফ বর্ধক, কাম উদ্দীপক ও ক্ষুধা বর্ধক।
ব্যবহার্য অংশ: ডেউয়া একটি ভেষজ গাছও বটে এর ছাল গুঁড়ো করে যে কোনো ক্ষতে লাগালে ক্ষত শুকিয়ে যায়। ফল কফ বর্ধক, কাম উদ্দীপক ও ক্ষুধা বর্ধক।
সংরক্ষণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ: ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ৫৫ নম্বর সেকশনে লাগানো বর্তারকিছু গাছ সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। আরণ্যক ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এর সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চারা লাগিয়ে প্রজাতিটিকে সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৯ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) ডেউয়া প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে ডেউয়া সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১. মৃত্যুঞ্জয় রায়; বাংলার বিচিত্র ফল, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ২৪৩-২৪৪।
২. এম এ হাসান, (আগস্ট ২০০৯)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস”। আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ ৯ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ১৯৮-১৯৯। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।