দেবকাঞ্চন দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার উদ্যানে চাষযোগ্য ভেষজ গুণ সম্পন্ন আলংকারিক ফুল

ভূমিকা: দেবকাঞ্চন (বৈজ্ঞানিক নাম: Bauhinia purpurea , ইংরেজি: Purple Bauhinia, Butterfly Tree,  amel’s Foot Tree, Purple Orchid Tree, Geranium Tree, Tree Bean) ফেবাসিস পরিবারের,  ফানেরা গণের একটি এক প্রকারের বৃক্ষ। রক্তকাঞ্চনের চেয়ে এই গাছের আকার বড়। এটি ভারতীয় প্রজাতি। মাঝারি আকৃতির পত্রমোচক, প্রায় গোলাকৃতির এই গাছের বেগুনী রঙের ফুল ফোটে।[১]

বৈজ্ঞানিক নাম: Bauhinia purpurea L., Sp. Pl. 1: 375 (1753). সমনাম: Bauhinia coromandeliana DC. (1825), Bauhinia triandra Roxb. (1832), Phanera purpurea (L.) Benth. (1852). Betis. ইংরেজি নাম : Purple Bauhinia, Butterfly Tree,  amel’s Foot Tree, Purple Orchid Tree, Geranium Tree, Tree Bean.  স্থানীয় নাম: দেব কাঞ্চন, কোইয়ার্ল, কারালি, কদারি, গান্দি, কাঞ্চন, রক্তকাঞ্চন। জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস জগৎ/রাজ্য: Plantae. বিভাগ: Angiosperms. অবিন্যাসিত: Edicots. বর্গ: Fabales. পরিবার: Fabaceae. গণ: Phanera  প্রজাতির নাম: Bauhinia purpurea L

বর্ণনা:

দেবকাঞ্চন মাঝারি আকৃতির  চিরহরিৎ গুল্ম বা ছোট বৃক্ষ। উচ্চতায় এই গাছ ৪ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। শীর্ষের শাখা-প্রশাখা ও পত্রাদির ছাউনি বা মুকুটের মতো গোলাকার। বাকল পুরু, প্রায় মসৃণ, ছাই বা ঘন বাদামী বর্ণ যুক্ত, তরুণ কান্ড রোমশ। পত্র সরল, একান্তর ও ফলক আকৃতির; পাতার দৈর্ঘ্য ৭ থেকে ১৮ ও প্রস্থ ৫ থেকে ১৫ সেমি। প্রশস্ত উপবৃত্তাকার, ৯-১১ শিরাল, মাঝামাঝি অংশ দ্বিখন্ডিত, খন্ড অর্ধসূক্ষ্মাগ্র বা গোলাকার, মূলীয় অংশ কর্তিতা থেকে গোলাকার, রোমবিহীন, তরুণ অবস্থায় পাতার নিচের পৃষ্ঠ ক্ষুদ্র রোমশ, বৃন্ত ২.৫-৫.০ সেমি লম্বা।

পুষ্পবিন্যাস কাক্ষিক থেকে শীর্ষীয়। ফুল থোকা থোকা আকারে ধরে। এক থোকায় ১০ থেকে ১২টি ফুল থাকে। ফুল ঘন ফ্যাকাশে লাল বা বেগুনি বর্ণযুক্ত। দেখতে সুদর্শন, পূর্ণ, মনোরম। প্রস্ফুটিত ফুল আড়াআড়িভাবে ৭.৫ সেমি। পুষ্পমুকুল দুই থেকে আড়ায় সেমি লম্বা হয়। উপরের অর্ধাংশে ৫ টি ফুল কৌণিক ভাগে থাকে। বিভক্ত, খাজ কালো বর্ণযুক্ত, বৃন্ত ০.৫-১.৩ সেমি লম্বা, ঘন ক্ষুদ্র কোমল রোমশ, মঞ্জরীপত্র ৩ সেমি লম্বা, মঞ্জরীপত্রিকা ২ সেমি লম্বা, হাইপ্যানথিয়াম ৭-১০ মিমি লম্বা। বৃতি চমসাকার, নালি বিকৌণিক, ২.৫-৩.০ সেমি লম্বা, সাধারণত ২ টি পশ্চাদমুখী খন্ডে বিভক্ত, ১টি খাতাগ্র এবং অপরটি ৩ টি দাঁতযুক্ত।

একটি ফুলে পাপড়ি থাকে ৫টি ও মুক্ত অবস্থায়। পাপড়ির দৈর্ঘ্য সাড়ে তিন থেকে পাঁচ সেমি ও প্রস্থ দেড় থেকে দুই সেমি। উপবৃত্তাকার থেকে বিভল্লাকার, দলবৃন্ত ১ সেমি লম্বা, প্রসারিত, শিরাযুক্ত। পুংকেশর মোট ১০টির থাকে । তারমধ্যে উর্বর পুংকেশর ৩ থেকে ৪টি এবং বাকি  পুংকেশর বন্ধ্যা বা হ্রাস প্রাপ্ত।  পুংদন্ড লম্বায় ৩ থেকে ৪ সেমি  হয়ে থাকে। গর্ভাশয় রোমশ ও লম্বা। গর্ভদন্ড দন্ডক যুক্ত থাকে ও গর্ভমুন্ড তীর্যক। ফল পড, রৈখিক-দীর্ঘায়ত বা অসি আকার,  দৈর্ঘ্য ১৫ থেকে ২৫ ও প্রস্থ ১.৫-২.৫ সেমি, দন্ড ২ সেমি লম্বা হয়।  ক্রমান্বয়ে দন্ডের দিকে সরু এবং উপরের দিকে প্রশস্ত, চ্যাপ্টা, চর্মবৎ, পাকানো কপাটিকা দ্বারা বিদারী । বীজ প্রতি পডে ১২-১৫ টি। বীজের আকার প্রায় ৭ × ৪ সেমি, উপবৃত্তাকার, বাদামী, মসৃণ।[২]

ক্রোমোসোম সংখ্যা:

2n = ২৬, ২৮ [৩]

বংশ বিস্তার ও চাষাবাদ:

রৌদ্রজ্জ্বল ও শুষ্ক স্থানে এই ফুলের চারা রোপণ করা হয়। গ্রামের ঝোপ-ঝাড়, উদ্যান, জলাশয়ের তীরবর্তী স্থান এবং পর্ণমোচী অরণ্যে দেবকাঞ্চন লাগানো হয়। হেমন্তে গাছে থোকা থোকা ফুলে গাছ ভরে যায়। এরপরে ফুল থেকে শুঁটি হয়। চৈত্রমাসে নিষ্পত্রগাছে ঝুলন্ত ফলগুলি সশব্দে ফেটে ছড়িয়ে পড়ে। বীজ থেকে নতুন চারা জন্মে।  ফুল ও ফল ধারণ নভেম্বর থেকে মে মধ্যেই শেষ হয়।

বিস্তৃতি:

ভুটান, ভারত, মায়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ড। বাংলাদেশের সর্বত্র জন্মে। তবে ভারতের হিমালয়ের পাদদেশে ও আসামের পাহাড়ের এই গাছের আদি নিবাস।[৪]

অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও ভেষজ গুণ:

বাহারী উদ্ভিদ হিসাবে লাগানো হয়। দেবকাঞ্চনের নানা ভেষজ গুণ আছে। এটির মূল টনিক ও বায়ুনাশক। ফুল রেচক রূপে ব্যবহৃত (Sachan et al., 1992)। বাকল ট্যানিন, গঁদ ও আঁশের উৎস, কান্ডের বাকল আমাশয়ে উপকারী। বাকলের ক্বাথ ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। (Blatter and Millard, 1937)। মূলের বাকল স্বল্প মাত্রা হলেও বিষাক্ত উপাদান আছে (Caius, 1989)। কাঠ মাঝামাঝি শক্ত এবং কৃষিযন্ত্রপাতি ও গৃহ নির্মাণাদিতে বেশ উপযোগী।

জাতিতাত্বিক ব্যবহার:

ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের অধিবাসীরা ঝলসানো বীজ খায়, তারা পাতা ও ফুলের সবজি রূপে রান্না করে খেয়ে থাকে (Saxena et al., 1988)। ভারতের মুন্ডা আদিবাসীরা মূল শরীরের কাটা ও ভাঙ্গা স্থানে ব্যবহার করে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মূলের বাকল ও ফুল চালের পানির সাথে মিশিয়ে ফোঁড়া পাকাতে ব্যবহার করা হয় (Caius, 1988)। বাংলাদেশ ও ভূটানে পাতা গবাদি পশুর খাদ্যরূপে ব্যবহৃত।

অন্যান্য তথ্য:

বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৭ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) দেবকাঞ্চন  প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে দেবকাঞ্চন  সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির বর্তমানে সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই।[২]

তথ্যসূত্র:

১. ড. মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ ফুলের চাষ প্রথম সংস্করণ ২০০৩ ঢাকা, দিব্যপ্রকাশ, পৃষ্ঠা ১৩৩। আইএসবিএন 984-483-108-3

২. বি এম রিজিয়া খাতুন (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৬ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ১০০-১০১। আইএসবিএন 984-30000-0286-0

৩. Kumar, V. and Subramaniam,, B. 1986 Chromosome Atlas of Flowering Plants of the Indian Subcontinent. Vol.1. Dicotyledons Botanical Survey of India, Calcutta. 464 pp.   

৪. দ্বিজেন শর্মা লেখক; বাংলা একাডেমী ; ফুলগুলি যেন কথা; মে ১৯৮৮; পৃষ্ঠা- ১৮, আইএসবিএন ৯৮৪-০৭-৪৪১২-৭

আরো পড়ুন:  ক্যামেলিয়া থেয়াসি পরিবারের এরিকালিস গণের শোভাবর্ধনকারী সপুষ্পক উদ্ভিদ

Leave a Comment

error: Content is protected !!