কফি-এর চারটি প্রজাতির প্রজাতির পরিচয়

দক্ষিণ ভারতে কফির চাষ ভালো হয়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে coffea arabica এই প্রজাতিটির চাষ হলেও অন্য বেশ কয়েকটি প্রজাতি থেকেও কফি তৈরি হয়ে থাকে বা হতে পারে। সেগুলি সম্বন্ধেও সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই প্রবন্ধে দেওয়া চেষ্টা করছি। কফির ৫০-৬০টি প্রজাতি আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে পাওয়া। তন্মধ্যে Coffea arabica-র চাষ ব্যাপকভাবে এবং C. liberica, C. robusta এবং C. stenophylla অঞ্চলবিশেষে সামান্য পরিমাণে চাষ হয়ে থাকে। এছাড়াও কিছু জংলী প্রজাতি আছে, যেগুলি দক্ষিণ ভারতের পাহাড়ী অঞ্চলে এবং হিমালয়ের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে জন্মে। তবে C. bengalensis বাগানে লাগানো হয়ে থাকে তার সৌরভযুক্ত ফুলের জন্য।

চারটি প্রজাতির পরিচয়:

Arabian Coffee: বর্তমানে দক্ষিণ ভারতে এর ব্যাপক চাষ হয়ে থাকে। শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে পরীক্ষামূলকভাবে কফির চাষ করে উৎকৃষ্ট স্বাদ ও যুক্ত যথেষ্ট পরিমাণ কফি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন রয়েল এবং রক্সবার্গ শাহেদয়। এটি Rubiaceae ফ্যামিলীভুক্ত গাছ। এই প্রজাতির অনেকগুলি Varieties (প্রকার ভেদ) থাকলে Chicks, Coorgs, Kents – এই তিনটি বিশেষভাবে ভারতে অধিক জন্মে ।

চিরহরিৎ ছোট গাছ। সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে ততটা বাড়তে দেওয়া হয় না, কাটিং ক’রে ৪/৫ ফুট উঁচু রাখা হয়, ফলে গাছ বেশ ঝাঁকড়া হয় এবং বেশি ফল দেয়। পাতা গাঢ় সবুজ এবং বিপরীতমুখী। বোঁটা ছোট, পাতা বোঁটার দিকে ক্রমশঃ সরু এবং অগ্রভাগ সরু ও লম্বাটে। পাতা লম্বায় ৫/৭ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফুল ছোট (ছোট, সাদা রঙের, সুগন্ধ যুক্ত, গুচ্ছবদ্ধভাবে পাতার কোণ থেকে বেরোয়। ফুলের পাপড়ি ঘন্টাকৃতি। ফল ছোট, মাংসল, কাঁচায় গাঢ় সবুজ, ধীরে ধীরে হলদে হয় এবং পাকলে গাঢ় লাল হয়ে যায়। বেরী জাতীয় ফল। ফলের মধ্যে ১-৩টি বীজ থাকে। পাকা ফল গাছে থাকে ঝরে পড়ে না। এতে সংগ্রহের সুবিধে হয়।

আরো পড়ুন:  মুথা ঘাস বাংলাদেশের সর্বত্রে জন্মানো ভেষজ প্রজাতি

সাধারণত মার্চ থেকে এপ্রিলে গাছে ফুল আসে এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বরে ফল পাকে। পাকা ফলগুলিকে তুলে নিয়ে তা থেকে বীজগুলি বের করে পরিষ্কার ভাবে ধুয়ে শুকিয়ে তারপর সেগুলোকে ভেজে গুঁড়ো করে কয়েকটি পদ্ধতির দ্বারা কফি প্রস্তুত করা হয়। কফির যে সৌরভ, তা কিছুটা নির্ভর করে mercaptans নামক পদার্থের উপস্থিতির জন্য। গাছ তিন বছরের হলে ফুল ও ফল হওয়া আরম্ভ হয়, চলে ৪০/৫০ বছর পর্যন্ত ।

Coffer liberica bull: এটিকে Liberian কফি বলা হয় । গাছ ৪০/৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে দেখা যায় । যেকোন প্রাকৃতিক অবস্থায় এটি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে । গাছে প্রচুর পরিমাণে ফল হয় এবং সেগুলি পেকে গেলেও গাছ থেকে ঝরে পড়ে না । তবে C. arabicaর বীজের চেয়ে এটির বীজ কম গুণসম্পন্ন । এই প্রজাতিটির দু’টি Varieties—Abeokutae এবং Excelsa অধিক দেখা যায়। এগুলির রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা খুব বেশি। এটিও আফ্রিকার গাছ এবং দক্ষিণ ভারতে লাগানো হয়েছে। Coffea arabica-র সঙ্গে সংকর উদ্ভিদ তৈরী করার কাজে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।

Coffer robusta: এটিকে Congo কফি বলা হয়। এই প্রজাতিটি C. arabicaC. liberica-র চেয়ে আকারে বড় হয়ে থাকে এবং অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন। যেকোন আবহাওয়া সহজে সহ্য করতে পারে। অন্যান্য প্রজাতিগুলির চেয়ে এটির রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা অনেক বেশি। তাছাড়া অন্যান্য গাছের সঙ্গে একত্রে লাগানো যায় । এর আদি বাসস্থান Belgian Congo, ভারতে এসেছে জাভা থেকে। বর্তমানে দক্ষিণ ভারতে এটির ব্যাপক চাষ হচ্ছে। Coffea robusta-র বীজের গুণাগুণ C. arabica-র বীজের গুণাগুণের প্রায় সমান। যেহেতু এই প্রজাতিটি আম, কলা, নারিকেল, কমলালেবু প্রভৃতির বাগানেও ভালভাবে জন্মে এবং ফল দেয়, সেজন্য দক্ষিণ ভারতে এটির কদর ক্রমশঃ বাড়ছে।

Coffer stenophylla: এটির আদি বাসস্থান পশ্চিম আফ্রিকার Sierra Leone নামক স্থানে, যার জন্য একে Sierra Leone Coffee বলা হয় । পরীক্ষামূলকভাবে ভারতে এই প্রজাতিটির চাষ হচ্ছে। গাছ ২৫/৩০ ফুটের বেশি উঁচু সাধারণত হয় না। গাছের বৃদ্ধি ভাল । ফল প্রচুর পরিমাণে হলেও নতুন গাছে ফল ধরতে দীর্ঘ সময় লাগে। ফল আকারে C. arabica-র চেয়ে ছোট এবং পাকলে কালো রঙের হয়। বাণিজ্যিক দিক থেকে এটির মূল্য খুব একটা নেই বলে চাষেরও অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয় না। সর্বপ্রকার কফিই Rubiaceae ফ্যামিলীভুক্ত। প্রজাতি ও প্রকার ভেদে অনেক প্রকার কফির গাছ ভারতে জন্মে। তন্মধ্যে মাত্র কয়েকটির ফল থেকে কফি প্রস্তুত হয়ে বাজারে আসে।

আরো পড়ুন:  কেলেলতা দক্ষিণ এশিয়ার ভেষজ প্রজাতি

কফি-এর ভেষজ ব্যবহার

চায়ের মতো কফিও caffeine সমৃদ্ধ। অল্প মাত্রায় দেহ ও মনের আনন্দদায়ক, অধিক মাত্রায় বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। এটি তিক্ত, বিপাকে কটু, উষ্ণবীর্য, বাত ও কফ নাশক, হৃদয়ের বলকারক, নাড়ী উত্তেজক, প্রস্রাবকারক, মস্তিষ্ক, পাকস্থলী ও বৃক্কের উত্তেজক, অশ্মরীসঞ্চয় নিবারক, পচন নিবারক, অগ্নিবর্ধক, নিদ্রা ও তন্দ্রানাশক এবং শ্বাস, কাস, জ্বর, শরীরের জড়তা, অতিসার, শারীরিক ক্লান্তি, হৃদয় ও মনের অবসাদ, স্নায়ুশূল, শিরোরোগ, আধকপালি, বমি, জীর্ণ আমাশয়, উদরাময় এবং মূত্রকৃচ্ছ্র প্রভৃতিতে অল্প মাত্রায় ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যায়।

দন্তক্রিমি ও মুখদৌর্গন্ধে কফির ক্বাথের কবল ধারণ করলে কাজ হয় । হৃদয়াবসাদে কফি পান অতি উত্তম ব্যবস্থা । সুরা, মিঠাবিষ ও আফিং সেবনের পর বিষক্রিয়া দেখা দিলে সেক্ষেত্রে কফির গাঢ় ক্বাথ প্রযোজ্য। কফি সেবনে অস্ত্রের কৃমিগতি স্বাভাবিক হয়, মূত্রে ইউরিক এসিড নির্গম হ্রাস করে এবং শ্রমজনিত শরীর ও মনের অবসাদ থাকে না । এর দ্বারা বেশ কিছুক্ষণের জন্য নিদ্রা জয় করা যায়, অথচ মনও তাজা থাকে । কফি শরীরের বেদনা নষ্ট করে, সেজন্য সন্ধিবাত, আমবাত প্রভৃতি রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা বিধেয়। শিশুর বিসূচিকায় এটি অতিশয় হিতকারী । অশ্মরী এবং জ্বরান্তিক দুর্বলতায় অল্প মাত্রায় ব্যবহার্য। মানসিক শৈথিল্য, প্রলাপ, অপতন্ত্রক, আক্ষেপ প্রভৃতি বাত-প্রধান রোগে প্রয়োগ করা যায় ।

আধকপালে, মাথাধরা, জ্বর এবং বাতে কফির অপক্ব বীজ চূর্ণ ব্যবহৃত হয় । কফি অধিক মাত্রায় পান করলে মাথা ঘোরা, মাথার যন্ত্রণা, বুক ধড়ফড় করা, অস্থিরতা, আক্ষেপ, পরিপাক শক্তির হ্রাস, হৃৎকম্প, পাতলা দাস্ত হওয়া প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয় এবং পক্ষাঘাত পর্যন্তও হতে পারে। অধিক ব্যবহারে অস্ত্রের শিরাগুলি প্রসারিত হয়ে অর্শরোগ হবার সম্ভাবনা থাকে। খুব বেশি মাত্রায় সেবন করলে শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি কমে গিয়ে ধনুষ্টঙ্কারের মত আক্ষেপ উপস্থিত হতে পারে, তখন কৃত্রিম শ্বাসক্রিয়া ভিন্ন জীবন রক্ষা হয়। শরীরে তরুণ প্রদাহ দেখা দিলে এবং অর্শ থাকলে কফি পান না করাই শ্রেয়।

আরো পড়ুন:  ছায়া গুল্ম-এর নানা গুণাগুণের বিবরণ

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্র:

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, সপ্তম মুদ্রণ ১৪২৬, পৃষ্ঠা, ৫৩-৫৫।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি flowersofindia.net থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dinesh Valke

Leave a Comment

error: Content is protected !!