আমাদের সুপরিচিত এবং প্রিয় গাছপালার মধ্যে অন্যতম হলো কাঁঠাল। এর ফল কাটা কাটা এবং সে কাঁটাগুলোর মাথা খুব সূক্ষ্ম; যা হাতে বা চর্মে গেঁথে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
কাঁঠাল গাছ-এর বিবরণ:
কাঁঠাল দীর্ঘজীবী, চিরসবুজ তাই ছায়াতরুর আদর্শ। গোলাকৃতি, কৌণিক কিংবা এলোমেলো সব ধরনের কাঁঠাল গাছই দেখা যায়। পুরানো কাঁঠাল গাছ মহীরুহের মতো বিশাল ও বিস্তৃত। কাণ্ড অমসৃণ, ধূসর এবং সদ্যমোচিত বাকলের স্থান গঢ়ি রক্তিম। পাতা একান্তরে বিন্যস্ত, বিডিম্বাকৃতি, উপর দিক কালচে সবুজ, নিচদিক হালকা সবুজ, খসখসে। কাঁঠাল পাতা গাঢ় কমলা রঙের হয়ে ঝরে পড়ে। এর পাতার বোঁটাসহ সমগ্র শরীরে গাঢ় শ্বেতকষ বিদ্যমান। এর পত্রমুকুল দুটি খড় সাদা, স্বল্পায়ু প্রায় নৌকাকৃতি উপপত্রে আবৃত থাকে এবং পত্রোন্মচনের পরই তা ঝরে পড়ে।
কাঁঠালের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ছিল আর্টোকার্পাস ইন্টেগ্রা যার অর্থ আটোকার্পাস গ্রিক শব্দ- আতাজাতীয় ফল এবং ইন্টেগ্রা ল্যাটিন শব্দ- অখণ্ডপত্রী, নামকরণের এ সূত্র সন্দেহের অবকাশ সৃষ্টি করেছে, কেননা কোনো কোনো নবীন কাঁঠাল গাছে খণ্ডিত পাতা দেখা যায়। সে কারণেই বর্তমান নাম: Artocarpus heterophyllus Lam. (সমনাম: A integra (Thumb) Merr.; A. integrifolia L. f); গোত্র মোর্যাসী।কাঁঠালের মুচিই এর মঞ্জরি। ফুল একলিঙ্গী তাই পুরুষ এবং স্ত্রী স্বতন্ত্র, পুংমঞ্জরী ক্ষুদ্রাকৃতি এবং স্বল্পায়ু।
স্ত্রী মঞ্জরি স্থায়ী এবং পরিণত অবস্থায় বিরাটাকৃতি। প্রধানত মূল কাণ্ডে, শাখায় কদাচিৎ গোড়ায় ঝুলে থাকে। পুংমঞ্জরি পরাগায়নের পর শুকিয়ে ঝরে পড়ে যায়। স্ত্রী-মঞ্জরির তখন বাড়বাড়ন্ত অবস্থা এবং বিরাটাকৃতি ফলে রূপান্তরিত হয়। কাঁঠালের ফল যৌগিক, কারণ তা একটি সমগ্র মঞ্জরির পরিণত অবস্থা। কোনো একক ফুলের নয়। সাধারণত কাঁঠাল ফলের বাকল সবুজ, ম্লান হলুদ বা কিছুটা তামাটে। এর ভেতর জাত-ভেদে হলুদ, মাখন রঙের বা বাদামি। শীতে ফুল হয়, গ্রীষ্মে পাকে। অবশ্য কোনো কোনো সময় একটু এদিক-ওদিক হয়।[১][২]
জাত:
জাত কাঁঠালের বেশ কিছু জাত এ দেশে রয়েছে। তবে এখনো কোন উচ্চ ফলনশীল আধুনিক কোন জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়নি। এ দেশের চাষকৃত জাতসমূহ মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—যথা গালা ও খাজা।
১. গালা বা গলা: যখন কাঠাল ভালভাবে পাকে তখন কোষ অত্যন্ত কোমল, মিষ্টি ও রসাল হয়। তবে কখনো কখনো রসের স্বাদ টক মিষ্টিও হয়ে থাকে। কোষ অপেক্ষাকৃত ছোট হয়। খোসার গায়ে কাঁটাগুলো খুব একটা চ্যাপ্টা হয়। পাকার পর একটু লালচে-হলুদাভ হয়। কোষগুলোকে সহজেই আলাদা করা যায়।
২. খাজা: কোষ আকারে বড় হয়, পাকার পর কম রসাল ও অপেক্ষাকৃত শক্ত বা কচকচে হয়। কোষ চিপলেও সহজে রস বের হয় না। রং ফ্যাকাশে হলুদ ও স্বাদে মোটামুটি মিষ্টি হয়। সহজে হজম হয় না বলে এই কাঁঠাল অনেকে পছন্দ করেন না। খোসার রঙ পাকার পরও সবুজাভ থাকে এবং গায়ের কাঁটাগুলো মোটামুটি চ্যাপ্টা, বড় ও মসৃণ হয়।
এ দুটি জাত ছাড়াও কাঁঠালের আরও জাত আছে। গালা ও খাজা কাঁঠালের মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যের একটি জাত যাকে ‘রসখাজা’ বলা হয়। এছাড়া আছে রুদ্রাক্ষি, সিংগাপুর, সিলোন, বারোমাসী, গোলাপগন্ধা, চম্পাগন্ধা, পদ্মরাজ, হাজারী প্রভৃতি। শুধু হাজারী কাঁঠাল আমাদের দেশে আছে, অন্যগুলো আছে ভারতে।
মাটি ও পরিবেশ:
দোআঁশ ও পলিমাটি কাঁঠাল চাষের জন্য ভাল। তবে সেচ সুবিধা থাকলে লার কাঁকড়ডযুক্ত মাটিতেও এর চাষ করা যায়। বাংলাদেশে অম্লভাবাপন্ন লাল মাটিতে (যেমন—মধুপুর, ভালুকা, রাঙ্গামাটি) কাঠাল ভাল জন্মাতে দেখা যায়। এঁটেল মাটিতেও কাঁঠাল চাষ করা যায় তবে মাটি সুনিষ্কাশিত হওয়া দরকার। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু কাঁঠাল চাষের জন্য উত্তম। শীত প্রধান ও তুষারপাতের এলাকায় এর চাষ করা যায়। বাংলাদেশের জলবায়ু কাঁঠাল চাষের বেশ উপযোগী।
কাঁঠাল গাছ-এর চারা তৈরি:
প্রধানত বীজ থেকেই কাঁঠালের চারা উৎপাদন করা হয়। তবে শাখা কলম, দাবাকলম, অংকুর জোড়কলম, তালিচোখ কলম, কুচি চোখকলম, ফোরকার্ট চোখকলম প্রভৃতির মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা যায়। টব বা পলিথিন ব্যাগে বীজ বপন করে তা থেকে চারা অংকুরিত করা হয়। অংকুরিত চারার বয়স ১-২ বছর হলে উক্ত টব বা ব্যাগ থেকে মূলের কোন ক্ষতিসাধন না করে রোপণের জন্য ব্যবহার করা যায়। জাত বিশুদ্ধতা রক্ষা ও ভাল গুণাগুণ সম্পন্ন ফল পেতে হলে ৮-১০ দিন বয়স্ক চারায় ভাল কোন জাতের অংকুর জোড় করে চারা উৎপাদন করা যায়। এ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনে ভাল ফল পাওয়া গেছে। দেখা গেছে এপ্রিল-মে মাসে এভাবে চারা উৎপাদন করলে তা ৫০-৯০% সফল হয়।[৩]
চাষাবাদের সময়সীমা:
অগ্রহায়ণ পৌষে ফল, তারপরে ফল। জ্যৈষ্ঠ আষাঢ়ে ফল পাকে। আবহাওয়ার তারতম্যে অন্য ঋতুতেও কোন কোন অঞ্চলে কাঁঠাল হয়, এই যেমন মাদ্রাজ অঞ্চলে আশ্বিন-কার্তিক মাসে কাঁঠাল হয়। এর সংস্কৃত নাম পনস, হিন্দীতে কাণথাল। এই Artocarpus গণের ৪০টি প্রজাতি এশিয়া মহাদেশের উষ্ণপ্রধান অঞ্চল সমূহে পাওয়া যায়। এদের ফ্যামিলির নাম Moraceae. ব্যবহার্য অংশ- পাতা, ফল, মূল, আঠা ও কাঠ।[২]
কাঁঠাল গাছ-এর চাষাবাদ:
আগাছা পরিষ্কার করে ভালভাবে চাষ দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। বর্গাকার বা ষড়ভুজী রোপণ পদ্ধতি অনুসরণ করে রোপণের ১০ দিন আগে ১২ মিটার x ১২ মিটার দূরত্বে সব দিকে ১ মিটার আকারে গর্ত খুঁড়তে হবে। গর্ত পরিমিত মাত্রায় সার মিশ্রিত মাটি দ্বারা ভরাট করে দিতে হবে। এজন্য গর্ত প্রতি ২-৩ ঝুড়ি গোবর ও ৩০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
চারার শিকড় খুব দুর্বল প্রকৃতির হওয়ায় তা সহজে ছিড়ে যায় বা নতুন মাটির সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। এজন্য টবে বা পলিথিন ব্যাগে উৎপাদিত চারা মাটিসহ গর্তে রোপণ করা ভাল। এ ছাড়া সরাসরি গর্তে গর্তপ্রতি ৩-৪টি বীজ বপন করা যায়। পরবর্তীতে এ থেকে গজানো সুস্থ সবল চারাটি রেখে বাকি চারাগুলো ফেলে দিতে হবে। গবাদিপশু যেন রোপিত চারা না খেয়ে যায় সেজন্য চারাকে তুলে বাঁশের খাঁচি বা বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা উচিত।
মাটিতে প্রয়োজনীয় রস না থাকলে সার দেয়ার পর সেচ দেয়া উচিত। শুষ্ক মৌসুমে ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দিলে ভাল হয়, তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন জমিতে কোন সময়ই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয়। দীর্ঘমেয়াদী ফলের মতই এর পত্রাঞ্চলের বিস্তৃতি ও ফল ধরতে অনেক সময় লাগে। এই দীর্ঘ সময় অনর্থক বসে না থেকে কাঁঠাল বাগানে বিভিন্ন প্রকার ফসল যেমন— কলা, ঢেঁড়শ, বেগুন, মরিচ, টমেটো, কলাই, ছোলা প্রভৃতির আবাদ করা যেতে পারে। শেষোক্ত ফসল দুটি শুধু বাড়তি আয়ই যোগায় না, জমিতে নাইট্রোজেনের যোগানও দিয়ে থাকে। এ ছাড়া গাছ বড় হয়ে গেলেও ছায়ায় জন্মে এরূপ ফসল যেমন— আদা, হলুদ প্রভৃতির চাষ করা যেতে পারে।
ফল সংগ্রহ
বসন্তের শুরু থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত এঁচোড় বা কাঁচা কাঠাল সংগ্রহ চলে। সাধারণত গ্রীষ্মের শেষ দিকে জুন মাসে ফল পাকা শুরু হয়। তখন ফলের বোঁটার কিছু অংশ রেখে কাণ্ড থেকে ফল সংগ্রহ করা হয়। কাঁচা অবস্থায় ছড়ি দিয়ে আঘাত করলে ঠন ঠন শব্দ হয়। আর পাকা অবস্থায় ড্যাব ড্যাব শব্দ হয়। যদিও সাত-আট বছর বয়স থেকেই গাছে ফল ধরা শুরু হয় কিন্তু ষোড়শী গাছেই সবচেয়ে বেশি ফল ধরে। এ সময় বছরে প্রতিটি গাছ গড়ে ২০০-২৫০টি কাঁঠাল ধরে থাকে। প্রতিটি ফলের ওজন ৩-২৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে অবস্থাভেদে এর তারতম্যও লক্ষ্য করা যায়।
ফল পাকানো ও সংরক্ষণ:
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাঁঠাল পাকানো কোন সমস্যা নয়। কেননা গরম তাপমাত্রা এমনিতেই বেশি থাকে, যার ফলে পরিণত ও পরিপুষ্ট ফল সংগ্রহের পর মেঝে খড় বিছিয়ে সাজিয়ে রাখলেই ৩-৪ দিনের মধ্যে ফল পেকে যায়। কেউ কেউ ফল পাড়ার পর ঘরে তোলার পূর্বে কয়েক ঘন্টা রোদে তাপিয়ে উত্তপ্ত করে নেন। এতে পাকানো তুরান্বিত হয়। স্বাভাবিকভাবে কাঁঠালকে কখনো হিমাগারে সংত্রক্ষণ করা যায় না। তবে ১১.১-১২.৭° সে. তাপমাত্রা ও ৮৫-৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতাযুক্ত ঘরে একে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।[৩]
তথ্যসূত্রঃ
১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার), দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ১৬৪-১৬৫।
২. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৪, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ৪৭-৪৯।
১. মৃত্যুঞ্জয় রায়: বাংলার বিচিত্র ফল, দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ পৃষ্ঠা, ২৩৮-২৪৩।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।
আমার বাড়ী শান্তিনিকেতন। আমাদের দুইটা কাঁঠালগাছ। একটাতে প্রথমবার ফল ধরেছিল কিন্তু তারপরে আর ধরে না। শুধু পুরুষ ফল হয় আর ঝরে যায়। আরেকটা গাছে প্রতিবার অনেক ফল ধরে কিন্তু একটু বড় হবার পরে বোঁটা থেকে ঝরে যায় আর পুষ্টও হয় না।
এর প্রতিকার কি?
আপনি এর প্রতিকার জানালে বাধিত হব।