পরিচিতি: জোড়া নারকেল বা কোকো ডুম বা সমুদ্রফল বা সমুদ্র নারকেল (দ্বিপদ নাম: Lodoicea maldivica বাংলা: লোডোইসি মালডাইভিকা) হচ্ছে লোডোইসি নামের এক-প্রজাতিবিশিষ্ট গণের পাম গাছ। এই নামের সাথে মালডিভ বা মালদ্বীপ শব্দটি জুটেছে কারণ তখন মালদ্বীপ থেকেই এর পরিচিতি হয়েছে সারা বিশ্বে। এদের আদি নিবাস প্রাসলিন, কুরিউজ এবং সেশেলজ দ্বীপসমূহ। এই গণের নাম এসেছে ফরাসি রাজা পঞ্চদশ লুই-এর সম্মানে মূলত লুই (Louis) শব্দের ল্যাটিনকৃত রূপ থেকে।
জোড়া নারকেল বা কোকো ডুম-এর বিবরণ:
জোড়া নারকেল বা কোকো ডুম গাছ বেড়ে ওঠে অতি ধীরে। বেঁচে থাকে প্রায় ৩-৪ শো বছর। এর অঙ্কুরোদ্গম হতে লাগে ৩-৫ বছর, এরপর ১৫ বছর লাগে শুধু কাণ্ড শুরু হতে। ফল ধরতে সময় লাগে ২০-৫০ বছর। ফল পাকতে লাগে ৯-১০ বছর। ১০০ ফুটের ওপরে লম্বা হয় গাছ। প্রায় ২ ফুট লম্বা ১৮-২০ কেজি ওজনের এর ফলবীজ নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বীজ।অনেকটা ডাবের মতো দেখতে কাঁচা ফলের ভেতরটা আমাদের দেশের তালের শাঁসের মত, কিন্তু পাকলে বীজের ভেতরকার শাঁস ভীষণ শক্ত হয়ে যায়।
কোলকাতার বাজারে মাঝে মাঝে বিক্রি হয় একপ্রকার ফলের শাঁস যার প্রচলিত নাম জোড়া নারকেল কারণ ফলটি দেখতে জোড়া দেয়া নারকেলের মতো। এর অনেক গুণের মধ্যে প্রধান গুণ হল, এটি আফ্রোডিসিয়াক, কাজেই খদ্দেরের অভাব হয় না, যদিও কিনতে হয় অনেক মূল্যে। বিক্রেতাকে এই সমুদ্রফলের ঠিকানা জানতে চাইলে সে প্রায়ই বলে, এই ফল সমুদ্রের নিচে হয়, পাকলে ভেসে ওঠে পানির ওপরে তারপর ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে আসে তীরে।
এই ঘটনা প্রথম প্রচার করেছে মালদ্বীপের রাজারা কারণ তাদের জানা ছিল না এই ফল কোত্থেকে ভেসে আসে তাদের দেশে। যখন এর নামকরণ হয়েছে তখন কেউ জানতো না এগুলো সমুদ্র স্রোতে ভেসে আসে সুদূর সেশেলজ্ দ্বীপ থেকে। যখনকার কথা তখন সেশেলজ্ দ্বীপপুঞ্জে লোকবসতি শুরু হয়নি, তাই জানার অবকাশ ছিল না কারও।
যে ফলের ওজন ২০-৩০ কেজি তা উঁচু পামগাছ থেকে পড়ার পরপরই ডুবে যায় সমুদ্রে। অনেক কাল পরে যখন ফলের বহিরাবরণ পচে যায়, অঙ্কুরোদ্গম হতে থাকে, ভেতরটা খালি হয়ে যায় তখনই তা হালকা হয়ে জলের ওপরে ভেসে ওঠে।
এরপর সমুদ্রস্রোতে তার যাত্রা শুরু হয় এবং এক সময় এসে উপস্থিত হয় মালদ্বীপের সমুদ্রতটে। অতীতে মালদ্বীপের রাজার প্রজাদের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল, আহরিত সমুদ্রফল রাজার কাছে জমা না দিলে গর্দান যাবে। কারণ, দ্বীপের রাজা ভারতীয় রাজাদের কাছে তা বিক্রি করবেন সোনার দামে।
জোড়া নারকেল বা কোকো ডুম-এর অবস্থা:
সমুদ্র জোড়া নারকেল বা কোকো ডুম-এর পূর্ণবয়স্ক গাছের সংখ্যা এখন ৮২৮২টি। এখন কেবলমাত্র সেশেলজ্ দ্বীপপুঞ্জের ৩টি দ্বীপেই পাওয়া যায় এই গাছ। এদের লুপ্ত হবার সম্ভাবনা দেখে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে এবং সে কারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে বিপন্ন (Endangered EN) বলে ঘোষণা করেছে।[১]। পরিবেশ আর অগ্নিকাণ্ড জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্যে এদের সংখ্যা দ্রুত কমে গেছে। বর্তমানে কয়েক হাজার গাছের খবর পাওয়া গেছে, যার অনেকগুলি আছে প্রাসলিন দ্বীপের জাতীয় উদ্যানে। ভারতের শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটি সমুদ্র ফলের গাছ আছে যা এখনও বড় গাছ হতে পারেনি।
সমুদ্রে ভেসে ভেসে অঙ্কুরিত অবস্থায় যখন এটা এক সময় মালদ্বীপে পৌঁছেছে এবং সেখান থেকে ভারতে তখন সুখাদ্য জাতীয় কিছু ভেতরে থাকতো বলে মনে হয় না। এখন সেশেল থেকে এটা ভারতে সরাসরি রফতানী হয়। তবে কোলকাতার বাজারে প্রচলিত জোড়া নারকেলের শাঁস নামে চড়া দামে যা বিক্রি হয় তা প্রায়শই বুদ্ধ নারকেল (Pterygota alata)-এর শাঁস। এই গাছের বীজ যাতে রাষ্ট্রের বাইরে অন্য কোথাও সঞ্চারিত না হয় সেজন্যে সেশেল দ্বীপে এই ফল বিক্রির আগে মাঝখান থেকে কেটে দুভাগ করে ভেতরের শাঁস বের করে নেয়া হয়, তারপর জোড়া দেয়া হয় পুনরায়। বীজের ত্বক অত্যন্ত শক্ত হবার কারণে এর ওপরে খোদাই করা হয় অনুপম নক্সা।
সমুদ্র ফলের পুরুষ ও স্ত্রী গাছ ভিন্ন। এই গাছের ফুল আর বীজের আকৃতি দেখে মানুষ একে স্বাভাবিকভাবেই যৌনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে এবং অনুমান করেছে এর যৌনব্যাধি নিরাময়ের ক্ষমতা।
তথ্যসূত্র:
১. “Lodoicea maldivica“, http://www.iucnredlist.org/details/38602/0, The IUCN Red List of Threatened Species। সংগ্রহের তারিখ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮।
২. জায়েদ ফরিদ এবং ফেসবুকের বৃক্ষকথা গ্রুপ
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।