ভূমিকা: সফেদা বা সবেদা (বৈজ্ঞানিক নাম: Manilkara zapota ইংরেজি: Sapodilla, Naseberry, Sapota) হচ্ছে সাপোটাসি পরিবারের মানিলকারা গণের সপুষ্পক একটি বৃক্ষ। এটি ফলজ উদ্ভিদ হিসাবে বাগানে, পুকুরের পাড়ে, রাস্তার ধারে লাগানো হয়ে থাকে।
সফেদা বা সবেদা বিবরণ:
সফেদা মধ্যম আকারের চিরহরিৎ বৃক্ষ। এদের দুধসদৃশ আঠাযুক্তকষ আছে যা চিকল নামে পরিচিত। পত্র সরল, একান্তর, বৃন্তক, শাখাপ্রশাখার শেষ প্রান্তে সমাকীর্ণ, ডিম্বাকার-উপবৃত্তাকার থেকে উপবৃত্তাকার-বল্লমাকার, ৭-১২ x ২.৫-৩.৫ সেমি বা ৩ থেকে ৬ ইঞ্চি , অধচর্মবৎ, অখন্ডিত, গোড়া প্রশস্ত, শীর্ষ স্থূলাগ্র, রোমহীন। এদের পত্রবৃন্ত আধ থেকে এক ইঞ্চি দীর্ঘ।
পুষ্প পত্রকক্ষে, বৃন্তক, উভলিঙ্গ, সাদা, ১.০-১.৫ সেমি চওড়া। বৃত্যংশ ৬টি, দ্বিসারি, বাহিরের ৩টি বৃহৎ, রোমশ, ডিম্বাকার। পাপড়ি ৬টি, যুক্তদলী, উপরের অংশ মুক্ত। পুংকেশর ৬টি, পাপড়ির প্রতিমুখ, ৬টি, বন্ধ্যা পুংকেশরের একান্তর। গর্ভাশয় অনেক কোষী, গর্ভদন্ড ১টি, গর্ভমুন্ড ১টি, সূচালো ।
ফল রসালো বেরী, সাধারণত গোলাকার, ৫-১০ সেমি বা আধ থেকে দুই ইঞ্চি চওড়া, তামাটে বাদামী। শাঁস রসাল, সুমিষ্ট, নরম। বীজ ৫-১২টি, চকচকে কালো, ২ সেমি লম্বা। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে প্রায় সারা বর্ষব্যাপী।[১]
মধ্যমাকৃতি এই তরুর কাণ্ড সরল, উন্নত, শীর্ষ ছত্রাকৃতি ও ছায়াঘন, বাকল ধূসর, অমসৃণ এবং পাতা শাখান্তে গুচ্ছবদ্ধ, ঘনসবুজ। গ্রীষ্ম প্রস্ফুটনের কাল। ফুল তেমন আকর্ষণীয় না হলেও এদের উগ্র গন্ধ দূরবাহী ও দীর্ঘস্থায়ী। আপাতদৃষ্টিতে ফুলের পাপড়ি সংখ্যা অজস্র মনে হলেও মূলত এগুলোর অধিকাংশই রূপান্তরিত পরাগকেশর এবং সেগুলো মূল পাপড়ি অপেক্ষা ছোট। বকুলের সঙ্গে এই ফুলের সাদৃশ্য ঘনিষ্ঠ। বকুল ও সফেদা তো সমগোত্রীয়।[২]
পুষ্প একক, কাক্ষিক, দীর্ঘবৃন্তক, ম্লান-সাদা, প্রায় ১ ইঞ্চি প্রশস্ত। বৃতির ৬ বৃত্যংশের মধ্যে বহিঃস্থ তিনটি বৃহত্তর। পাপড়ি ৬, নিম্নাংশে যুক্ত। পরাগকেশর ৬, কিন্তু উপদলে রূপান্তরিত পরাগকোষশূন্য পরাগকেশর বহুসংখ্যক। গর্ভকোষ অধস্তন, ১০-১২ প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। ফল গোলাকৃতি, মাংসল বাদামি, অমসৃণ। শাঁস রসাল, সুমিষ্ট, নরম, হালকা বাদামি। বীজ ৫ কিংবা ততোধিক, কঠিন, উজ্জ্বল কালো। ক্রোমোসোম সংখ্যা: 2n = ২৬ (Fedorov, 1969).
আবাসস্থল ও চাষাবাদ: ফল শস্য হিসেবে আবাদী যা উচ্চভূমিতে ভালো জন্মে। জোড় কলম দ্বারা এবং সম্ভবত বীজ দ্বারাও বংশবৃদ্ধি ঘটে।
সফেদা বা সবেদা বিস্তৃতি:
ওয়েষ্ট ইন্ডিজ এবং উষ্ণমন্ডলীয় আমেরিকার স্বদেশী। বর্তমানে পৃথিবীর উভয় গোলার্ধের উষ্ণমন্ডলীয় নিম্নভূমিতে আবাদী (Coronel, 1992). বাংলাদেশে এর মিষ্টি ফলের জন্য লাগালো হয়।[১] বাংলা-ভারতে সফেদার প্রসার ও সুখ্যাতি খুবই প্রাচীন। বাংলাদেশে সফেদা সহজলভ্য এবং ফলতরু হিসেবে আদৃত। বর্ষা শেষে ফলের মৌসুমে শহরের অলিতে-গলিতে সফেদা-বিক্রেতাদের হামেশাই দেখা যায়। কাঁচা ও পাকা ফলের বাহ্যিক পার্থক্য খুবই কম বলে ফল পাড়ার সময় বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। কাঁচা সফেদা যেমন কষাটে, অতিপাকা ফলও তেমনি নির্গন্ধ ও স্বাদহীন। দুয়ের মাঝামাঝি অবস্থায়ই সফেদা সবচেয়ে সুস্বাদু।[২]
অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:
সুস্বাদু মিষ্টি ভক্ষণীয় ফলের জন্য মূল্যবান। ফল উচ্চমানের পুষ্টিগুণ সম্পন্ন, ১০০ গ্রাম ফলে রয়েছে ৭৪ গ্রাম পানি, ২৪ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট এবং যথেষ্ট পরিমাণে ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, পটাসিয়াম এবং বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন। বাকলে রয়েছে গ্লুকোসাইড, ট্যানিন, সেপোনিন এবং অ্যালকালয়েড। বীজ শাঁসে রয়েছে তরল চর্বি, স্যাপোনিন এবং তিক্ত স্যাপোটিনিন । ফল রুক্ষ মেজাজ এবং জুরের আক্রমনের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয় (Ghani, 2003). জাতিতাত্বিক ব্যবহার হিসেবে দেখা যায় কালো চকচকে বীজ সম্মান-মুকুট তৈরীতে ব্যবহৃত হয়।
অন্যান্য তথ্য:
বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ১০ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) সফেদা প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে সফেদা সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে এটি সংরক্ষণের তেমন প্রযোজন নেই।[১]
গুণাগুণ:
সফেদার বাকল থেকে সাদা গুঁড়ার আস্তর যখন ধীরে ধীরে খসে পড়ে তখনই ফল পাড়ার সময় আসে। অবশ্য সঠিক সময় বোঝার জন্য দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। আমাদের দেশীয় সফেদা সুমিষ্ট ও সুগন্ধি হলেও আকার ও গুণগত বৈশিষ্ট্যে আমেরিকার সফেদার চেয়ে অনেক নিম্নমানের। ও-দেশে ইদানীং বীজহীন রাক্ষুসে সফেদা পাওয়া যায়, যাদের কোনোটার ওজন আধসেরের মতো। ফলের মূল্যই নয়, গাছের আকৃতির বৈশিষ্ট্যেও পালিত তরুকুলের মধ্যে সফেদা রূপসী। এজন্য একটি সম্পূর্ণ বাগানের পক্ষে সে অপরিহার্য। এদেশে বাগানবিলাসীদের এমন বাগান খুব কমই আছে যা সফেদা শূন্য।[২]
ব্যবহার:
সফেদার ফুল ও ফলের মৌসুম সঠিকভাবে চিহ্নিত নয়। বারোমেসে সফেদা আমাদের দেশে দুষ্প্রাপ্য নয়। তাই অকালে গাছে ফুল ও ফল দেখা যায়। কাঠ লালচে-বাদামি, দৃঢ় এবং দীর্ঘস্থায়ী। ভেষজ হিসেবেও মূল্য অল্প নয়। সফেদার বাকল অরেচক, টনিক, জ্বরহারী এবং বীজ রেচক। দুধকষ চুয়িংগামের উপকরণ এবং আঠায় ছোটখাটো ভাঙা জিনিসপত্র জোড়া দেয়া যায়। বীজ থেকে চারা জন্মানো সহজ হলেও কলম ও জোড়-কলমের ব্যবহারই বেশি। কলমের গাছে মাত্র চার বছরের মধ্যেই ফল ফলে। ঢাকায় দৈবাৎ সফেদা গাছ চোখে পড়ে। অ্যাকসরস গ্রিক নাম, অর্থ জংলী নাশপতি। জাপটা সফেদার মেক্সিকো দেশীয় নাম।
তথ্যসূত্র:
১. এম. আহসান হাবীব (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ১০ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২২৪-২২৫। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
২. দ্বিজেন শর্মা, শ্যামলী নিসর্গ, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, চতুর্থ মুদ্রণ, জানুয়ারি ২০১৬ পৃষ্ঠা ২২০-২২১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।