বকুল নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে ভেষজ গুণ সম্পন্ন ও উপকারি গাছ

বকুল চিরহরিত বৃক্ষ, ৪০ থেকে ৫০ ফুন্ট পর্যন্ত উচু হয়। ছায়া তরু হিসেবে রাস্তার ধারেও যেমন লাগানো হয়, আবার মন্দির প্রাঙ্গণেও তাকে স্থান দেওয়া হয়, ছায়া ও ফুলের সুগন্ধ আছে বলে।

বকুল এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্তী এলাকার বৃক্ষ

পৃথিবীর নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এই গণের ৩০টি প্রজাতি আছে, তার মধ্যে ভারতে ৪টি প্রজাতি বর্তমান। এই গাছ পশ্চিমঘাট পার্বতীয় অঞ্চলে অযত্নে হয়, কিন্তু অন্যান্য স্থানে তাকে লাগানো হয় বা রোপণ করা হয়। এই গাছটিকে ক্ষীরীবৃক্ষের অর্থাৎ যে বৃক্ষের ডাল পাতা ভাঙ্গলে আঠা বেরোয়; সে পর্যায়ে ধরা না হলেও ডাল ভাঙ্গলে বা কাটলে এই গাছের আঠা বেরোয়।

বকুল গাছটি সাধারণের কাছে খুবই পরিচিত। এর ফুলের গন্ধেই সে সকলের কাছে পরিচিত হয়। গ্রীষ্মকাল থেকে শরৎকাল পর্যন্ত এই ফুল প্রতিদিন ফুটতে থাকে; তাছাড়া এমন গাছও আছে যে বারোমাসই কম বেশি ফুল হয়, তাই এই গাছটির আরও দুটি নামকরণ করা হয়েছে ‘সদাপুষ্প’ ও ‘স্থির কুসু’; এই ফুল শুকিয়ে রাখা যায়, পচে যায় না।

এই গাছ থেকে একজাতীয় আঠা বেরোয়। বৈজ্ঞানিকগণ বলেন, এর মধ্যে কোন রাসায়নিক উপাদান নেই।

হিন্দিভাষী অঞ্চলে বকুলকে মৌলসারী বলে, উড়িষ্যার অঞ্চল বিশেষে একে বৌলি বলে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Mimusops elengi Linn., পরিবার Sapotaceae.

ঔষধার্থে ব্যবহার হয় গাছের বা মূলের ছাল, কাঁচা ও পাকা ফল, ফুল ও বীজ।

ব্যবহার

প্রথমেই বলে রাখা ভালো বৈদিক তথ্যে যেসব ইঙ্গিত দেওয়া আছে, সেগুলিকে উপজীব্য করে তাদের গবেষিত ফল চরক বা সুশ্রুত সংহিতায় সামগ্রিক লিপিবদ্ধ করা হয়নি, তবে বৈদিক ও তান্ত্রিক পথানুসারী চক্রদত্ত এ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করেছেন; তাছাড়া বহু প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত কতগুলি যোগ আজও প্রচলিত। তার কয়েকটি এখানে সন্নিবদ্ধ করা হলো।

১. মূত্রকৃচ্ছ্রতায়: বাতশ্লেষ্মা ও পিত্তশ্লেষ্মার ধাত যাদের ঋতুবিশেষে তাঁদের মূত্রবেগ কখনও ঢিলে কখনও কষা হতে দেখা যায়; তাঁদের ধারণা হয় প্রোষ্টেট গ্লান্ড বড় হয়েছে অথবা তাকে ধরে রাখার ক্ষমতা চলে গিয়েছে; এক্ষেত্রে বকুলছাল ১০ গ্রাম একটু কুটে থেঁতো করে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সেইটাকে সকাল, বিকাল ও রাতে ৩ বারে খেতে হবে; এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে। যদি দেখা যায় কোষ্ঠবদ্ধতা আসছে, তবে ৫ গ্রাম ওজন নিয়ে একটু থেঁতো করে, ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করার পর এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে ৩ বারে খেতে হবে।

আরো পড়ুন:  বেল এশিয়ার সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ঔষধিগুণ সম্পন্ন ফল

২. শুক্রতারল্য: দীর্ঘদিন অজীর্ণ ভুগলে শুক্রতারল্য হয়,আবার শরীরের পুষ্টির অভাবেও শুক্রতারল্য হয়,যদি জমার থেকে খরচ বেশী করার প্রবণতা থাকে; তাছাড়া বেশি বয়সেও শুক্রতারল্য এসে জোটে।

অপুষ্টিজনিত শুক্রতারল্য হলে, সেক্ষেত্রে পাকা বকুল ফলের সিরাপ প্রতিদিন আহারের পর এক বেলা ১ চা চামচ করে ঠান্ডা জলে মিশিয়ে ১৫ থেকে ২০ দিন খেলে অপুষ্টিজনিত তারল্য সেরে যাবে।

সিরাপের প্রস্তুত পদ্ধতি: পাকা বকুল ফল ৫০০ গ্রাম, ছোট ফল হলে ৭৫০ গ্রাম নিয়ে চটকে বীজ ও খোসা বাদ দিয়ে ২৫০ গ্রাম মধু মিশিয়ে ৩ দিন ঢেকে রাখতে হবে। তারপর একটা পাতলা ন্যাকড়ার বা গামছা হলেও চলবে, পুঁটলি করে টানিয়ে রাখতে হবে; তা থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে ঝরে পড়ে যাবে। সেইটাই হলো বকুল ফলের সিরাপ।

৩. শ্বেতী রোগ: সব শ্বেতীর রং এক রকম হয় না। যার রং দুধের মতো সাদা হয়ে গিয়েছে, সেগুলি দুঃসাধ্য বলা যেতে পারে। আর এই রকম সাদা দাগ একটা মেদস্বী লোকেরই বেশি হয় অর্থাৎ রোগা লোকের এই রকম সাদা দাগ বেশি হবে না। আর যে দাগগুলি একটু লালচে বা তামাটে রংয়ের, সেগুলি সকলেরই হতে পারে।

এক্ষেত্রে বকুল ছালের ঘন ক্বাথে বকুল বীজ ঘষে সেটা চন্দন ঘষার পাথরে ঘষলেও চলবে। ঐ দাগে আস্তে আস্তে ঘষে লাগাতে হবে, এর দ্বারা ঐ দাগগুলি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে।

ঘন ক্বাথ কি করে করতে হয়: ১০০ গ্রাম ছালকে কুটে এক লিটার জলে সিদ্ধ করে, আধ লিটার থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে তাকে পুনরায় ঘন করে আধ ছটাক আন্দাজ রাখতে হবে, সেইটাই হলো ঘন ক্বাথ। এটি তান্ত্রিকদের ঔষধ। তাঁদের নির্দেশএই ঔষধ ব্যবহারকালে নিরামিষ খাওয়া ভালো।

৪. দাঁতের পোকায়: দাঁতের মাঝখানে গর্ত হয়ে যায় অথচ ধার ঠিক থাকে, সেক্ষেত্রে বকুল ছাল ১০ গ্রাম নিয়ে থেঁতো করে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করতে হবে, এক কাপ অবশিষ্ট থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সকালে ও বিকালে অথবা রাতে প্রতিদিন ২ বার কবল ধারণ করতে হবে অর্থাৎ ক্বাথ মুখে ভরে নিতে হবে, ১০ থেকে ১৫ মিনিট রেখে ফেলে দিতে হবে। প্রতিবার ৭ থেকে ৮ চা চামচ করে নিলেও চলবে। এই রকম ১৫ থেকে ২০ দিন নিয়মিত ব্যবহার করলে বা করালে পোকায় আর দাঁত নষ্ট করবে না।

আরো পড়ুন:  আতা বা নোনা আতা ঔষধি গুণেভরা বাংলাদেশের পরিচিত ফল

৫. অকালে দাঁত নড়ায়: সে যে কোনো কারণেই হোক, ২০ থেকে ২৫ গ্রাম বকুল ছাল ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে নিতে হবে। আর ২ থেকে ৩ টিপ বা নস্যির মতো, পরিমাণ পিপুল চূর্ণ ১০ থেকে ১৫ ফোঁটা মধুর সঙ্গে মিশিয়ে প্রথমে দাঁতের গোড়ায় লাগিয়ে দিতে হবে। এইটা লাগাবার ৫ থেকে ৭ মিনিট বাদে, যে ক্বাথ তৈরী করা আছে সেই ক্বাথকে নিয়ে ৭ থেকে ৮ মিনিট করে মুখে রাখতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় ১০ থেকে ১২ দিন বকুল ছালের ক্বাথ ব্যবহার করলে নড়া দাঁত বসে যাবে।

৬. মাথার যন্ত্রণায়: যেখানে কফের সংযোগ থাকবে সেখানেই কেবল কাজ হবে এই পদ্ধতি। বকুল ফুলের গুঁড়োর বা চূর্ণ আট ভাগের এক ভাগ  ফটকিরির গুঁড়ো মিশিয়ে রেখে দিতে হবে, যাদের মাঝে মাঝে সর্দি বসে মাথায় যন্ত্রণা হয়, তাঁরা এই গুঁড়োর নাস্যিটা ব্যবহার করবেন। তাহলে মাথার যন্ত্রণা সেরে যাবে।

৭. দাঁত পড়া: অল্প বয়সে যাদের দাঁত নড়ে যাচ্ছে বা পড়ে যাচ্ছে, তারা কাঁচা বকুল ফল কিছুদিন চিবিয়ে দেখন, দাঁতের গোড়া শক্ত হয়ে যাবেই, তা না হলে কাঁচা ফলকে পেড়ে শুকিয়ে সেই শুকনো ফলের শাঁসের গুঁড়া দিয়ে দাঁত মাজলে অকালে দাঁত নড়বেও না, আর পড়বেও না।

৮. নাসাজ্বর: এ জ্বরে সাধারণত মাথায় ও ঘাড়ে যন্ত্রণা তো হয়ই, অধিকন্তু সমস্ত শরীরেও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি; এক্ষেত্রে বকুলফুলের চূর্ণের নস্য নিলে ঐ অসুবিধাগুলি চলে যায়।

৯. শিশুদের কোষ্ঠবদ্ধতায়: বকুলবীজের অভ্যন্তরস্থ শাঁসটাকে বাদ দিয়ে শক্ত অংশটাকে মিহি চূর্ণ করে,পুরাতন ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে বর্তি বা বাতি তৈরী করে অথবা পানের বোঁটায় লাগিয়ে শিশুর মলদ্বারে দিলে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই দাস্ত হয়ে যায়। তারপর কোনো স্নেহজাতীয় দ্রব্য,যেমন নারকেল তেল বা ঘি লাগিয়ে দিতে হয়। তাতে বীজের চূর্ণটা অল্প পরিমাণে মিশাতে হয়।

আরো পড়ুন:  আমলকি গাছ ও ফলের ১৩টি ভেষজ গুণাগুণ

১০. পুরাতন আমাশা রোগ: প্রতিদিন কয়েকটি করে পাকা বকুল ফলের শাঁস খেলে এ রোগের উপশম হয়।[১]

এছাড়াও বকুল ফুল-ফুলের রস হৃদযন্ত্রের অসুখ, leucorrhoea, menorrhagia নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। বকুলের শুকনা ফুলের গুড়া মাথা ঠান্ডা রাখে ও মেধা বাড়াতে উপকারী। বকুল গাছের ছাল দিয়ে কাটা-ছেঁড়ার ক্ষত পরিষ্কার করা যায়। এছাড়াও বকুল গাছের ছাল ও তেঁতুল গাছের ছাল সিদ্ধ করে পাচনের মাধ্যমে তৈরি তরল ঔষধ ত্বকের নানারকম রোগ সারাতে ব্যবহৃত হয়। বকুলের কাণ্ড থেকে পাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক ধরনের ঔষধ তৈরি করা হয় যা দাঁতের সমস্যা নিরাময়ে অনেক উপকারী। এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় ফিলিপাইনে। এছাড়াও এই ঔষধ জ্বর ও ডায়রিয়া থেকে আরোগ্য লাভের জন্যে ব্যবহার করে ফিলিপাইনের অধিবাসীরা। স্থানিয় লোকেরা এই তরল পানি দিয়ে গার্গল করে গলার অসুখের নিরাময়ের জন্যে। মুখ ধোয়ার তরল প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে এই তরল ঔষধ যা মাড়ি শক্ত করে। বকুলের পাতা সিদ্ধ করে মাথায় দিলে মাথা ব্যাথা কমে যায়। পাতার রস চোখের জন্যেও উপকারী।

রাসায়নিক গঠন: Saponin, (b) Fatty oil. (c) Sterols.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ 

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ২৬৭-২৭০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!