সোনালু বা সোনারু বা বান্দর লাঠি একটি মাঝারি আকারের বৃক্ষ। এদের চমৎকার ফুল ফোটে এবং বর্তমানে এটি আলংকারিক বৃক্ষ হিসেবেও পরিচিত। এদের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Cassia fistula. প্রাচীনকাল থেকেই এই উদ্ভিদটির ঔষধ হিসাবে ব্যবহার রয়েছে। নিম্নে সেগুলোর বিবরণ দেয়া হলো।
এই একটি মাত্র ভেষজ যেটির দ্বারা প্রাকৃতিক, বৈকৃতিক, নৈমিত্তিক ও রোগ সাঙ্কর্যে এটিকে প্রয়োগ করা যায়। উপমা স্বরুপ বলা যেতে পারে, এই যেমন প্রাকৃতিক রোগ ভাদ্র মাসে পিত্তশ্লেষ্মা জ্বর হয়, বসন্ত ঋতুতে বসন্ত রোগ দেখা দেয়। এইগুলিই প্রাকৃত রোগ। আর বৈকৃতিক রোগ হলও যেটা খাওয়া উচিত নয়; যেমন ডায়বেটিস হয়েছে, জানি যে চিনি খেলে বাড়ে, তবুও খাই; এইটাই হলও শরীরে বিকার সৃষ্টি করা হচ্ছে। তারপর নৈমিত্তিক রোগ যেমন হার্টের দোষ, কোনোই অসুবিধে ছিল না, হঠাৎ একটু পাহাড়ে ওঠার সখ হলও এলো আরও বিপর্যয়। আর একটা উদাহরণ হেপো রোগী, অধৈর্য হয়ে করলো শুক্রক্ষয়, এলো আরও অসুবিধে। তারপর রোগ সাঙ্কর্য যেমন আছে জ্বর, মাথার যন্ত্রণা, তার উপর অর্শের দোষ বর্তমান কারণ এ রোগটা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। এইসবের সঙ্গে যদি পেটের দোষ এসে জোটে, তাহলে রোগীরও প্রাণ ওষ্ঠাগত, চিকিৎসক বিভ্রান্ত; তাই এইসব ক্ষেত্রের মুকাবিলা করার জন্য চরকীয় চিন্তাধারা হলও সোন্দাল বা সোনালু বা বাঁদরলাঠি একমাত্র ভেষজ, যেটা এইসব বাধাকে অতিক্রম করে শরীরকে সুস্থ করতে পারে। এখন এসব ক্ষেত্রের জন্য প্রাচীনপন্থী চিকিৎসক সম্প্রদায় একটি পদ্ধতি অনুসরণ করতেন; সেটা হলও সোন্দল বা সোনালু বা বাঁদরলাঠি ফলের মধ্যেকার মজ্জা বা আঠা অংশ আন্দাজ ৩ থেকে ৪ গ্রাম নিয়ে একটু গরম দুধে বা গরম জলে গুলে, ছেঁকে দুই একদিন সকালের দিকে রোগীকে খাওয়ালে শরীরের সমস্যা নিরাময়ে সহায়ক হবে। তারপর চিকিৎসক সহজেই চিকিৎসা করতে পারবেন।
এই ভেষজটি সম্পর্কে প্রথমেই একটি তথ্য জানা দরকার যে, এটি প্রধানভাবে কাজ করে রসবহ ও রক্তবহ স্রোতের উপর।
১. উদ্ধ্বর্গত রক্তপিত্ত: ব্লডপ্রেসার হলেও নাক দিয়ে রক্ত পড়ে, আবার উধগত রক্তপিত্তেও নাক-মুখ দিয়ে রক্ত আসে; তাহলে এটা কি বােগ—এ বিচারের সহজ পদ্ধতি হ’লেরক্তপিত্তে কোষ্ঠবদ্ধতা থাকবেই আর রাড়পপ্রসারে না থাকাটাই সম্ভব। এক্ষেত্রে সেন্দিালের ফলমজ্জা (আঠা) ৪/৫ গ্রাম আধ কাপ জলে বা দুধে গুলে নিয়ে, ছেকে ওর সঙ্গে একট, চিনি বা মধু মিশিয়ে ২/৩ দিন খেলে ঐ অসুবিধেটার উপশম হয়।
২. উদরী রোগ: যদি পিত্তপ্রধান হয় তাহলে আর রক্ষা নেই; যদি সেটা হয় তবে তাঁদের থাকবে পিপাসা ;এদিকে পেটে জল, দাহ, তার উপর প্রস্রাব হতে চাইছে না; মনে হবে কিডনিতে বুঝি পাথুরী হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক কর্তব্য হলো দুধ এক কাপ, সোনালুর আঠা বা ফল মজ্জা ৮ থেকে ৯ গ্রাম আর জল ৪ কাপ একসঙ্গে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সেই দুধটা সকালের দিকে অর্ধেক ও বিকালের দিকে বাকী অর্ধেকটা খেতে দিতে হবে। যদি সম্ভব হয় ৪ চা চামচ আখের রস এর সঙ্গে মিশিয়ে খেতে দিতে পারলে ভালো হয়। যদি এই সঙ্গে এক চা চামচ আমলকীর রস মিশিয়ে দেওয়া যায় তাহলে আরও ভালো হয়।
৩. ক্ষার মেহে: এই রোগ সব বয়সেই হতে পারে। এই রোগী প্রস্রাব করলে সেখানে সাদা খড়ির মত দাগও যেমন হয় আবার তার সঙ্গে থাকে নাক ঝাঁজানো দুর্গন্ধ। এক্ষেত্রে সোনালু পাতার রস অথবা মূলের ছালের রস এক চা চামচ, তার সঙ্গে ৭ থেকে ৮ চা চামচ গরম জল মিশিয়ে, ঠাণ্ডা হলে, প্রতিদিন সকালে ও বিকালে দুই বারে খেতে হয়। এর দ্বারা ঐ অসুবিধেটা চলে যায়।
৪. অগ্নিমান্দ (শ্লেমাপ্রধান): এদের লক্ষণ দেখা যায় পেটটা থম মেরে আছে, খেলে যে অম্বল হয় বা চোঁয়া ঢেকুর ওঠে তাও নয়, মুখে কিছুই ভালো লাগে না, সে টক, মিষ্টি, ঝাল যাই হোক আবার খেলে যে অসুখ করে তাও নয় অথচ রুচি নেই; এক্ষেত্রে সোনালুর ফলের আঠা ৫ থেকে ৬ গ্রাম, আধা কাপ গরম জলে গুলে অল্প যোয়ান বাটা বা গুঁড়ো আধ গ্রাম আন্দাজ মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে ও বিকালে দুই বারে খেতে হবে। ৩ থেকে ৪ দিন খাওয়ার পর যদি তেমন উপকার না হয়, তাহলে ঐ মাত্রায় দু’বার খেতে হবে অর্থাৎ সকালের দিকে একবার ৫ থেকে ৬ গ্রাম ও বিকালের দিকে একবার ৫ থেকে ৬ গ্রাম মাত্রায় খেতে হবে।
৫. যক্ষারোগীর কোষ্ঠবদ্ধতা: চিকিৎসক সংকটে পড়েন এখানে, কারণ এ রোগী কোনো তীব্র মলভেদক ভেষজের দ্বারা বিরেচন করানো বিপজ্জনক অথচ দাস্ত পরিষ্কার না থাকলেও চলে না। এক্ষেত্রে এই একটিমাত্র ভেষজ, যেটির দ্বারা তার মলভাণ্ডকে উত্ত্যক্ত করে না, তাই সোনালুর ফলের আঠা বা মজ্জা ৫ থেকে ৬ গ্রাম আধ কাপ জলে গুলে, পাতলা কোনো গামছা বা ন্যাকড়ায় ছেঁকে, একটু চিনি বা আধ চা চামচ মধু মিশিয়ে সকালের দিকে খেতে দিলে দাস্ত পরিষ্কার হয়ে যাবে, অথচ দাস্ত হওয়া জনিত দুর্বলতা আসবে না।
৬. গণ্ডমালায় (Scrofula):এই রোগে সোনালু গাছের মূলের ছালের রস করে তার নয্যি নেওয়া এবং ছাল বেঁটে গণ্ডমালায় লাগানো, এর দ্বারা গণ্ডমালা সেরে যাবে, এটা একাদশ খৃষ্টাব্দের চিকিৎসক চক্রপাণি দত্তের গ্রন্থ চক্রদত্ত সিদ্ধ যোগ।
৭. আমবাতে: গাঁটে গাঁটে যন্ত্রণা, তার সঙ্গে ফুলে যায়, কনকনানি ব্যথা, এই যে ক্ষেত্র, এখানে ৬ থেকে ৭ গ্রাম সোনালু পাতা বাটা ২ থেকে ১ চা চামচ ঘিয়ে একটু ভেজে, সকালের দিকে জলসহ খেতে দিলে, ওটা ৩ থেকে ৪ দিনেই সেরে যাবে। তবে এই মাত্রায় খেয়ে যদি দাস্ত পরিষ্কার না হয়, তা হলে একটু মাত্রা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
৮. শূল রোগ: এই নামটিতেই তার রোগের লক্ষণ বুঝানো হয়েছে, কথায় আছে শুলের খোঁচা অর্থাৎ যে ব্যথার অনুভূতি হবে যেনো খোঁচা মারছে; সেইটাই শলের লক্ষণ, অবশ্য সেটা আমের দোষের জন্যেই হোক আর বায়ুর জন্যেই হোক অথবা কফের জন্যেই হোক, কষ্ট হচ্ছে। এক্ষেত্রে সোনালুর আঠা ৫ থেকে ৬ গ্রাম আধ কাপ গরম পানিতে গুলিয়ে, গামছার মতো পাতলা ন্যাড়ায় বা পাতলা কাপড়ে ছেঁকে খেলে ওটা প্রশমিত হবে। তবে এটাও ঠিক এর দ্বারা আসল রোগটা প্রতিকার হয়তো নাও হতে পারে, তার জন্য পৃথক চিকিৎসার প্রয়োজন।
৮. বৃদ্ধকালের কোষ্ঠবদ্ধতা: সোনালু ফলের আঠা বা ফল মজ্জা ৫ থেকে ৭ গ্রাম গরম দুধে চটকে নিয়ে গামছার মতো পাতলা কাপড়ে ছেঁকে সেইটা প্রতিদিন সকালে খেতে হবে। এর দ্বারা দাস্ত স্বাভাবিকভাবেই হয়ে যাবে।
৯. ক্ষতের ব্যথা: কোনো জায়গায় কেটে বা ছিঁড়ে গেলে বিষিয়ে ওঠে, জ্বালা যন্ত্রণা হতে থাকে; এক্ষেত্রে সোনালুর পাতা বেঁটে, তার সঙ্গে অল্প ঘি মিশিয়ে ওখানে লাগালে ব্যথা সেরে যাবে।
১০. কুষ্ঠের ক্ষতে: সোনালু পাতা বেঁটে লাগিয়ে দিলে ওটা থেকে দূষিত রস নির্গত হয়ে রসস্রাব বন্ধ হয়ে যায়।
১১. উপদংশের ক্ষত: সে নারী বা পুরুষ যারই হোক, এই সোনালুর পাত ২০ থেকে ২৫ গ্রাম, ৩ থেকে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে ঐ জলে ক্ষত ধুতে হবে। এর দ্বারা ক্ষতটার উপশম হবে।
১২. ভগন্দর বা ফিস্টুলা (Fistula): এক্ষেত্রে পাতা ও গাছের ছাল একসঙ্গে বেঁটে ব্যাধিতস্থানে লাগাতে হবে, এর দ্বারা ওখানকার ব্যথা ও যন্ত্রণা দু এক দিনের মধ্যেই চলে যাবে, তারপর রসস্রাব হওয়ার পর ক্ষতপূরক কোনো ঘৃতৌষধ (medicated ghrita) লাগাতে হবে।
রাসায়নিক গঠন:
(a) Anthraquinone derivatives, very little tannin, phlobaphenes, small amount of volatile oil, three waxy substances and resinous substances.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য: ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা,২৭৪-২৭৬।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dinesh Valke
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।