পারিজাত বা মান্দার গাছের ১৪টি ঔষধি ব্যবহার

পারিজাত বা মান্দার বা মাদার হচ্ছে কাঁটাযুক্ত একটি উদ্ভিদ। এদের বসন্তে লাল ফুল ফোটে। গ্রামাঞ্চলে কৃষকগণ বেড়ার কাজে মান্দার গাছ ব্যবহার করেন। এই গাছের ভেষজ গুণ রয়েছে এবং রোগ প্রতিকারে কাজে লাগে। নিম্নে সেসব বর্ণনা করা হলো।

মান্দার বা পারিজাত একটি রক্তরাঙা ফুল গাছ

প্রথমে জ্ঞাতব্য বিষয় হলো এই পারিজাত বা মান্দার গাছ  রক্তবহ স্রোতের বিকারজনিত রোগে উপকার দশায়। তবে রসবহ স্রোত দূষিত হলে রক্তবহ স্রোত দূষিত হবে সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু অন্য কারণেও রক্তবহ স্রোত দূষিত হতে পারে, তবে পরে অন্যান্য স্রোতকেও দূষিত করে।

১. উদক মেহে: এই মেহরোগে প্রস্রাবের পরিমাণ বেশি হয়, তবে একটু ঘোলাটে, অনেক সময় পিচ্ছিলও হয়, কিন্তু প্রস্রাবে গন্ধ থাকে না। এদের আর একটি বাহ্য লক্ষণ হবে, তালু বা মুখ গহ্ববের উপরের অংশটা শুকনো হতে থাকে। ক্লোম অর্থাৎ পিপাসার স্থানটাও শুষ্ক হতে থাকে। এই রোগাগ্রস্ত ব্যক্তির আরও একটি বিশেষ লক্ষণ হবে শোনা বা জানা কথা হঠাৎ মনে না আসা। তাঁদের ক্ষেত্রে ২ চা চামচ এই গাছের ছালের রস ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে একবার করে খেতে হবে, যদি দেখা যায় উল্লেখযোগ্য উপকার হচ্ছে না, তখন দু’বেলা খেতে হবে।

২. শিশুদের পু’য়ে লাগা বা রিকেট: যাকে আমরা চলতি কথায় রিকেট বলি। এইসব শিশুর মুখ থাকবে টুলটুলে, কিন্তু শরীরের অন্যান্য অংশটা যেন পাকিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে গাছের মূলের ছালের রস ১০ থেকে ১৫ ফোঁটা একটু দধের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে দিতে হবে।

৩. ক্রিমি রোগ: এই পারিজাত বা মাদার প্রধানভাবে কাজ করে রক্তজ ক্রিমির ক্ষেত্রে । এই রক্তজ ক্রিমি বহুরোগ সৃষ্টির কারণ হয়। এ ভিন্ন পাশ্চাত্য চিকিৎসকগণের মতেও E. N.T. এলাকায় বহু রোগের সৃষ্টি হয়। এটার মধ্যে অনেকগুলি রক্তজ ক্রিমির উপদ্রবে সৃষ্ট, যেক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ শিরঃপীড়ায় কাতর, সেক্ষেত্রে এই গাছের পাতার রস ৪ চা চামচ একটু গরম করে খাওয়াতে হবে, তবে বদ্ধ বৈদ্যগণ সাধারণ ক্রিমিতেও এই রস ব্যবহার করেন। এটা সুশ্রুতের উত্তরতন্ত্রের ৫৪ অধ্যায়ে বলা আছে।

আরো পড়ুন:  মান্দার বা পারিজাত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার রক্ত রাঙা আলংকারিক দৃষ্টিনন্দন ফুল

৪. ধাতু দৌর্বল্যে: ধাতু দৌর্বল্যের একটা উপসর্গ আছে, যাকে বলা যায় বিশিষ্ট লক্ষণ, এদের স্বপনদোষ হলে ভোরের দিকেই হবে, আর উত্তেজনা সেটাও সেই ভোরবেলায়। এক্ষেত্রে এর পাতার রস ৩ থেকে ৪ চা চামচ একটু গরম করে, সকালবেলা একটু দুধে মিশিয়ে, তার সঙ্গে দুই বা এক দানা কর্পূর দিয়ে খেতে হবে। কর্পূর বেশি দিলে কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্য আসবে, তাই সামান্যই দিতে হয়, এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে।

৫. মধ্যকোষ্ঠ রোগ: এর বর্ণনা করতে গেলে এইটাই বলতে হবে যে, ৪ থেকে ৬টা সন্দেশ খেলেই কোষ্ঠবদ্ধতা এসে গেল, আবার একমুঠো বাদাম, কিসমিস খেলো তো বেশি খুলে গেল, এই যাঁদের পেটের অবস্থা, তাঁদেরকে প্রাচীন বৈদ্যগণ বলেছেন এরা মধ্যকোষ্ঠ রোগের রোগী। এদের ক্ষেত্রে এই গাছের পাতার রস এবেলা ২ চা চামচ এবং ওবেলা ২ চা চামচ একটু গরম করে জলসহ খেতে হবে, এর দ্বারা মধ্যকোষ্ঠর সমস্যা থাকবে না। তবে এটা যদি অর্শ রুগিদের দেখা যায় তাহলে প্রতিকার অবশ্য হবে।

৬. মূত্রকৃচ্ছ্রতা রোগ (Strangury): এই কৃচ্ছ্রতার কারণ থাকে অন্য; যাকে বর্তমান যুগে বলা হচ্ছে বি-কোলাই ইনফেকশন। এর সঙ্গে একটু জ্বরও থাকে; এক্ষেত্রে ঐ ক্রিমিই তো এই রোগের কারণ; যার জন্য প্রস্রাব পরীক্ষা করা হয়, তাই পারিজাত বা মান্দার পাতার রস ১ চা চামচ অল্প জল মিশিয়ে একটু গরম করে সকালের দিকে একবার ও বিকালের দিকে একবার খাওয়ালে ঐ ব্যাকটিরিয়াগুলি অর্থাৎ ক্রিমিগুলো ধবংস হয়ে রোগ নিরাময় হবে।

৭. ঋতু দর্শনে: খুবই অল্প বয়সে যাদের মাসিক হয়েছে; ভাল যে হয় তাও নয়, এদিকে শরীরে ভারবাধ হয়, মাসিকের রক্ত একটু দেখা গেল, আবার বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু যন্ত্রণা খুবই হচ্ছে এক্ষেত্রে এই গাছের পাতার রস ৩ থেকে ৪ চা চামচ একটু গরম করে ঐ মাসিকের সময় অর্থাৎ চলাকালে ২ থেকে ৩ দিন খেলে কোনো কষ্ট থাকবে না। তবে এক মাসে সেরে না গেলেও ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে ঐ যন্ত্রণাভোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়

আরো পড়ুন:  ব্যবহার অনুসারে ঔষধি উদ্ভিদের বৈচিত্র্য

৮. অকালে মাসিক বন্ধ হওয়ার উপদ্রব: মাসিক ঋতু বন্ধ হওয়ার সময় হয় নি, অথচ মাসে মাসে অতিরিক্ত স্রাব হচ্ছে। সকল চিকিৎসকের অনুমান এটা বন্ধ হওয়ার পূর্ব লক্ষণ, কিন্তু এই অধিক স্রাব থাকবে না যদি এই ঋতুকালে ৩ থেকে ৪ দিন এই পারিজাত পাতার রস ২ চা চামচ একটু গরম করে প্রতিদিন সকালে ও বিকালে দু’বার খাওয়াতে হবে। এইভাবে ব্যবহার করলে ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে তাঁর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে; তবে স্বাভাবিকভাবে যখন বন্ধ হওয়ার তখন হবে।

৯. মাসিক ঋতুর স্বল্প স্রাব: ঋতু দর্শন হয়েছে বটে, কিন্তু স্রাব ভালো হয় না, তার সঙ্গে ছুঁচ বেঁধানো যন্ত্রণা, এরা কিন্তু প্রায়ই একটু কৃশ হয়; প্রতি মাসেই যন্ত্রণা নিবারক কিছু ঔষধ খেতে হয়। এক্ষেত্রে এই গাছের পাতার রস ২ চা চামচ করে ঐ তিন থেকে চার দিন খেতে হবে এর দ্বারা ঐ যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে, তবে স্রাব ভালো হওয়া না হওয়া সেটা নির্ভর করে শরীর ভালো মন্দের উপরে। এসব রুগীর প্রায়ই অর্শ থাকে দেখা যায়। তবে সেটা ভিতরের আবর্তনীতে, মলদ্বারের মুখের কাছটায় নয়।

১০. স্তনে দুধের অভাব: সবই ভরপুর, কিন্তু দুধের অভাবে সন্তান হা হা করছে এক্ষেত্রে পারিজাত বা মান্দার পাতার রস ২ চা চামচ আর ঝুনো নারকেলের দুধ ৪ থেকে ৫ চা চামচ একসঙ্গে মিশিয়ে, কয়েকদিন সকালের দিকে খেলে স্তনে দুধের অভাব থাকবে না।

১১. অববাহুক রোগ (Stiffness of ankle joint): হাত ঘুরাতেও পারা যাচ্ছে না, আবার উচুতেও তোলা যাচ্ছে না, আর পিঠ চুলকোবারও উপায় নেই, এই রকম সমস্যা হলো অববাহুক রোগের লক্ষণ। এই রোগে এই গাছের মূলের ছালের রস শায়িত অবস্থায় নাকে অর্থাৎ নাসাছিদ্রে টোপ ফেলা, সেটা যাতে গলা দিয়ে নেমে যায়, সেইটা করতে হবে। এই রকম অন্তত: ৩০ থেকে ৪০ ফোঁটা প্রতিদিন নাসাপান করলে কয়েকদিনের মধ্যেই অববাহুক রোগের উপশম হবে বোঝা যাবে।

আরো পড়ুন:  সোনালু বা বান্দর লাঠি গাছের বারোটি ভেষজ ব্যবহার

১২. নতুন জ্বরে: চোখ মুখ ঝামরে জ্বর; যাকে বলা হয় শরীর রসস্থ হয়ে জ্বর হয়েছে, সেক্ষেত্রে এই গাছের ছালের রস এক চা চামচ একটু জল মিশিয়ে ও গরম করে সকালে ও বিকালে দুইবার একটু মধু মিশিয়ে খেতে হবে। এর দ্বারা দু’দিনের মধ্যে জ্বর ছেড়ে যাবে।

১৩. রক্ত আমাশয়: এই গাছের ছালের রস এক বা দুই চা চামচ একটু গরম করে ২ থেকে ৪ চা চামচ দুধ মিশিয়ে ২ থেকে ৩ দিন খেলে রক্তামাশয় সেরে যাবে।

১৪. বাঘি হলে: কু’চকির এদিক বা ওদিক যে দিকেই হোক, আর যে কারণেই হোক, পারিজাত বা মান্দার পাতা বেটে, অল্প গরম করে ওখানে লাগাতে হবে। দুই দিনের মধ্যে ওর টাটানি ও ব্যথাটাও চলে যাবে।

রাসায়নিক গঠন:

(a) Poisonous alkaloids. (b) Saponin. (c) Waxy materials.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ১০৪-১০৭।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dinesh Valke

Leave a Comment

error: Content is protected !!