ভূমিকা: সজনে বা সজনা বা সাজিনা হচ্ছে মোরাসি পরিবারের মোরিঙ্গা গণের একটি বৃক্ষ জাতীয় গাছ। সজনা বাংলাদেশ ও ভারতে একটি বহুল পরিচিত বৃক্ষ, যার কাঁচা লম্বা ফল সবজি হিসেবে খাওয়া হয়, পাতা খাওয়া হয় শাক হিসেবে। সজনা গাছের কাঠ অত্যন্ত নরম, বাকলা আঠাযুক্ত ও কর্কি। সজিনা তিন প্রকারের হয়ে থাকে; নীল, শ্বেত ও রক্ত সজিনা।
বিবরণ: সজনে ছোট আকারের বৃক্ষ, ১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। এদের কান্ড কর্ক সদৃশ বাকলবিশিষ্ট, কচি অবস্থায় সবুজাভ সাদা, অণুরোমশ। পাতা যৌগিক, ত্রিপক্ষল, উপপত্রবিহীন, একান্তর, পক্ষ ৪-৭ জোড়া, প্রতিমুখ, ২.৩ x ১.৫ সেমি পর্যন্ত, উপবৃত্তাকার, দীর্ঘায়ত, ডিম্বাকার বা বিডিম্বাকার, তীক্ষ্ণ বা স্থুলাগ্র।
সজনের পুষ্পমঞ্জরী ছড়ানো এবং অসংখ্য পুষ্পবিশিষ্ট যৌগিক মঞ্জরী, ৮-৩০ সেমি লম্বা। পুষ্প বৃন্তক, উভলিঙ্গ, একপ্রতিসম, ৫-গুণিতক, সাদা। বৃতি ৫টি বৃত্যংশ নিয়ে গঠিত, বৃত্যংশগুলো মুক্ত, প্রায় পাপড়ি সদৃশ, রৈখিক-ভল্লাকার, বৃহত্তম বৃত্যংশ ১.৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা। দলমন্ডল ৫টি পাপড়ি নিয়ে গঠিত, পাপড়িগুলো মুক্ত, অসম, দীর্ঘায়ত-চমসাকার, সাদা। পুংকেশর ৫টি, পুংদন্ড ৭-৮ মিমি লম্বা, বন্ধ্যা পুংকেশরের সাথে একান্তর, পরাগধানী মোম সদৃশ, হলুদ অথবা কমলা। গর্ভপত্র ৩টি, যুক্ত গর্ভপত্র, গর্ভাশয় রোমশ, ১-প্রকোষ্ঠীয়, অমরাবিন্যাস প্রাচীর গাত্রীয়, গর্ভদন্ড সরু এবং ছিদ্রযুক্ত গর্ভমুণ্ড বিশিষ্ট, ডিম্বক অনেক, প্রতিটি অমরা ২ সারিতে সজ্জিত। ফল লম্বা ক্যাপসিউল, ৬০ সেমি পর্যন্ত লম্বা, ৯টি উত্থিত শিরাবিশষ্ট, ঝুলন্ত। বীজ অনেকগুলো, পাখনাবিশিষ্ট। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত, বাংলাদেশে একই প্রজাতির কিছু উদ্ভিদে সারা বৎসর ফুল ও ফল দিতে দেখা যায়।
ক্রোমোসোম সংখ্যা: 2n = ১৪, ২৮ (Kumar and Subramaniam, 1986).
বিস্তৃতি: Moringa oleifera প্রজাতিটি ভারত উপমহাদেশীয় এবং অনেক আফ্রিকান দেশে দেশ্যভূত। বাংলাদেশে ইহা দেশের সর্বত্র প্রধানত ইহার সবুজ ফলের জন্য রোপন করা হয়।
সজনের বিস্তার ও চাষাবাদ পদ্ধতি
সজিনা বাংলাদেশের সর্বত্র, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে সবজি গাছ হিসেবে লাগানো হয়। উদ্ভিদটি নিম্ন উচ্চতায় উত্তমভাবে অভিযোজিত, কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত ভাল জন্মে। ইহা শুষ্কতা সহ্যকারী। উর্বর এবং সুনিষ্কাশিত মৃত্তিকা এই প্রজাতিটির জন্য উপযোগী। ভারতীয় উপমহাদেশে Moringa oleiferaর বংশবিস্তারের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল কর্তিত শাখা কিন্তু আফ্রিকাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বীজদ্বারা বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে। নিম্নমানের ফলের বীজ থেকে চারা গজায় (Bosch, 2004).
এর পাতা অগ্রহায়ণ-মাঘ মাসে হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে এবং মাঘ-ফাল্গুনে থোকা থোকা সাদা ফুল প্রায় পত্রশূন্য গাছ ছেয়ে থাকে। চৈত্র-আষাঢ় মাসের মধ্যে ফল পাকে। ফলের মধ্যে ত্রিকোনাকার অনেক বীজ হয়। বীজ অথবা কাটা ডাল (কাটিং) দিয়ে বংশবিস্তার সম্ভব। কাটিং মাটি ও গোবর (৩:১) মিশ্রিত কাটিং তলায় অথবা পলিথিন ব্যাগে একটু কাত করে লাগাতে হয় এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি দিতে হয়। শেকড় গজালে শেকড়সহ কাটিং পলিথিন ব্যাগে অথবা সরাসরি মাঠে লাগানো যায়।
সাজনা চরম পরিবেশগত অবস্থা সহ্য করতে সক্ষম। তবে ২০ হতে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভালো জন্মায় এবং যেসব এলাকায় ২৫০ থেকে ১৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় সেখানে ভালো জন্মায়। মাটি বেলে দোঁআশ থেকে দোঁয়াশ এবং পিএইচ ৫.০ থেকে ৯.০ সম্পন্ন মাটি সহ্য করতে পারে। সজিনা চাষে সারের তেমন প্রয়োজন হয় না। কারণ সজনার বিস্তৃত ও গভীর শিকড় রয়েছে। তবে ইউরিয়া এবং জৈব সার প্রয়োগ করলে গাছ ভালো হয়। এ বৃক্ষটি বীজ ও ডালের মাধ্যমে বংশবিস্তার করা সম্ভব। তবে আমাদের দেশে বীজ থেকে চারা তৈরি করে চাষাবাদের রীতি এখনো অনুসরণ করা হয় না। কারণ বীজ থেকে চারা তৈরি ব্যয়বহুল। বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে এপ্রিল-মে মাসে গাছ থেকে পাকা ফল সংগ্রহ করতে হবে, তারপর সেটিকে শুকিয়ে ফাটলে বীজ পাওয়া যাবে। এ বীজ শুকনো বায়ুরোধী পাত্রে ১-৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখতে পারি।
জুলাই-আগস্টে বীজতলায় অথবা পলি ব্যাগে বপন করতে পারি। বীজ বপনের আগে বীজগুলোকে ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এতে বীজ থেকে চারা গজাতে সুবিধা হয়। বীজ থেকে চারা বের হতে সময় লাগে ১০ থেকে ২০ দিন। চারা বের হওয়ার পর নিয়মিত সেচ, সার প্রয়োগ ও অন্যান্য যত্ন পরিচর্যা করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে, বীজ থেকে সজিনা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ডাল পুঁতে অঙ্গজ বংশবিস্তারের চেয়ে দেরিতে ফল আসে। আমাদের দেশে ডাল পুঁতে অঙ্গজ উপায়ে বংশ বিস্তার পদ্ধতিটি বেশি ব্যবহৃত হয়। তার কারণ হলো, এটি করতে তেমন দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। আর খরচও কম, অঙ্গজ বংশবিস্তারের জন্য ৪-৫ ব্যাসের বা বেডের ৫-৬ হাত লম্বা নিরোগ ডাল এবং আঘাতমুক্ত ডাল ব্যবহার করা ভালো।
নতুন লাগানো গাছে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে শীঘ্রই শিকড় গজাতে পারে। শুষ্ক ও গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রায় দুই মাস সেচ দিতে হবে। তবে সাজনার গাছ একবার লেগে গেলে তেমন পানির প্রয়োজন হয় না। সজিনার গাছে তুলনামূলক কীট-পতঙ্গ ও রোগ সহনশীলভাবে মাঝে মাঝে প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। যেমন জলাবদ্ধ মাটিতে শিকড় পচা রোগ দেখা দিতে পারে এর কারণ ডিপ্লোডিয়া। কীট-পতঙ্গ শুষ্ক ও ঠাণ্ডায় বেশি আক্রমণ করে। কীট-পতঙ্গ দ্বারা গাছে হলুদ রোগ দেখা যায়। কীট-পতঙ্গের মধ্যে টারমাইটস, এফিড, সাদা মাছি প্রধান।
সজনের অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:
এশিয়াতে ইহার কচি ফল সজি হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয় কিন্তু আফ্রিকানরা ইহার পাতা সালাদ, সপ ও সসে ব্যবহার করে থাকে। কচি পাতার পুষ্টিমান কচি ফল থেকে অনেক বেশী। পশ্চিম আফ্রিকাতে শিশু, গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের অপুষ্টি থেকে পরিত্রাণ পেতে খাদ্য তালিকায় Moringa oleifera এর পত্রচূর্ণ যোগ করা হয় (Bosch, 2004).
বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকার জনসাধারণ কচি পাতা এবং পুষ্প শাক হিসেবে এবং তরকারীতে রান্না করে খেয়ে থাকে। বাতের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কান্ডের বাকলের ক্বাথ ব্যবহৃত হয়। গ্রামের লোকজনের বদ্ধমুল ধারণা এই যে, ইহার ফল জলবসন্ত রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে এই জন্য রোগীর তরকারীর সাথে ইহাকে খেতে দেয়া হয়। সজনে গাছের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গুণ। এই গাছের গুনাগুণ সম্পর্কে জানতে পড়ুন
সজনে গাছের বহুবিধ উপকারিতা ও গুনাগুণ
সংরক্ষণ তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৯ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) সজনে প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে সজনে সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে বসতবাটির বৃক্ষ হিসেবে ইহার বংশবিস্তার উৎসাহিত করা যেতে পারে।
তথ্যসূত্র:
১ আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ৩১-৩২ ।
২. এম এ হাসান, (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৭ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২৫১-২৫৩। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।