শিউলি বা শেফালী বাংলাদেশ ভারতের আলংকারিক সুগন্ধি ফুল

[otw_shortcode_info_box border_type=”bordered” border_color_class=”otw-red-border” border_style=”bordered” rounded_corners=”rounded-10″]বৈজ্ঞানিক নাম: Nyctanthes arbor-tristis L. সমনাম: Bruschia macrocarpa Bertol.; Nyctanthes dentata Blume; Nyctanthes tristis Salisb.; Parilium arbor-tristis (L.) Gaertn.; Scabrita scabra L.; Scabrita triflora L. বাংলা নাম: শিউলি, শেফালী, ইংরেজি নাম: night-flowering jasmine বা parijat. জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস জগৎ/রাজ্য: Plantae – Plants উপরাজ্য: Angiosperms বিভাগ: Eudicots শ্রেণী: Asterids বর্গ: Lamiales পরিবার: Oleaceae গণ: Nyctanthes প্রজাতি: Nyctanthes arbor-tristis L.[/otw_shortcode_info_box]

ভুমিকা: শিউলি (বৈজ্ঞানিক নাম: Nyctanthes arbor-tristis ইংরেজি: night-flowering jasmine বা parijat) হচ্ছে অলিয়াসি পরিবারের নেকটানথি গণের বৃক্ষ। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফুলের তালিকায় শিউলি আছে। 

                                 আরো পড়ুন: শিউলি বা শেফালী গাছের ভেষজ গুণ

বিবরণ: শেফালি বা শিউলি ক্ষুদ্র বৃক্ষ। কচিশাখা রোমশ, চতুষ্কোণী। পত্র ডিম্বাকৃতি, সূক্ষ্মকোণী, বর্ধিত-শীর্ষ, প্রায় ৪ ইঞ্চি দীর্ঘ। পত্রবিন্যাস বিপ্রতীপ। মঞ্জরি নিয়ত, স্বল্পপৌষ্পিক, কাক্ষিক ও প্রান্তিক। ফুল ক্ষুদ্র, অবৃন্তুক চ্যুতদল। পাপড়ি যুক্ত, ৫-৮ অংশে বিভক্ত, সুগন্ধি, নিম্নাংশ নলাকৃতি ইঞ্চির এক চতুর্থাংশ, গাঢ়-কমলা, উর্ধ্বাংশ প্রসারিত, শ্বেত, কোমল আধা ইঞ্চি প্রশস্ত। ফল চ্যাপ্টা, পৌনে এক ইঞ্চি, বিতাম্বুলাকৃতি, দ্বিবীজীয়, ধূসর, শুষ্ক।

শেফালি ক্ষুদ্রাকৃতি বৃক্ষ। কাণ্ড দীর্ঘ এবং বহু শাখায়ন সত্ত্বেও উন্নত, তাই ক্ষেত্রবিশেষে এই গাছকে কৌণিক দেখায়। বাকল সাদাটে-ধূসর ও মসৃণ। বিপ্রতীপভাবে বিন্যস্ত পাতাগুলো ঘন-সবুজ, দন্তর-প্রান্তিক ও সূক্ষ্মকোণী। পত্রবিন্যাস নিবিড় বিধায় শেফালি ছায়াঘন। আয়তন সীমিত বলে শেফালি পথতরুর উপযুক্ত নয়।

শেফালির স্নিগ্ধবর্ণ, মধুগন্ধ শরতের শান্ত শুভ্র শ্রীর প্রতীক। শেফালির বৈজ্ঞানিক নামের শেষাংশ : আরবরট্রেস্টিস্, অর্থ বিষাদিনী তরু। এই নামকরণ একটি প্রাচীন উপকথালগ্ন: ‘সূর্যের দীপ্তিতে বিগলিতা এক রাজকন্যা সূর্যের প্রেমে পড়লেন, প্রবঞ্চিত হলেন এবং শেষে আত্মহত্যা করলেন। তাঁর চিতাভস্ম থেকে অংকুরিত একটি গাছের শাখায় একদিন হতভাগিনী রাজকন্যার সব দুঃখ প্রস্ফুটিত হলো ফুলে ফুলে, তাঁর আশ্চর্য হৃদয়ের সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হলো বর্ণে-গন্ধে। কিন্তু সূর্যের প্রতি প্রবল ঘৃণায় যে ফুটল রাতের আঁধারে, সবার অলক্ষ্যে। ভোর হতে, পূর্ব আকাশে আলোর আভাস ফুটতেই তার ফুলেরা ঝরে পড়ত, মুখ ঢাকত মাটিতে’। এই আমাদের শিউলি।

আরো পড়ুন:  শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমের কষ্ট সহিষ্ণু আলংকারিক ফুল কসমস-এর চাষ ও পরিচর্যা পদ্ধতি

অবশ্য বাংলা কাব্যেও এমন উপলব্ধি অনুপস্থিত নয়। নজরুল শিউলিকে বিধবার হাসির সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুন্দর, শুভ্র, কোমল একটি ফুলের এই ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের বিষাদ এই নামকরণে সত্যি সার্থক।

শিউলি আমাদের পালিত তরুর অন্যতম। সহজে চারা জন্মানো এবং আমাদের আবহাওয়ায় পূর্ণ-অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও এদেশের অরণ্যভূমি শিউলিহীন।

শিউলির আদিনিবাস মধ্য ও উত্তর ভারত। ঢাকায় এ তরু দুষ্প্রাপ্য। প্রাক্তন প্রাদেশিক পরিষদ (বর্তমান জগন্নাথ হল) ও পাবলিক লাইব্রেরির প্রাঙ্গণ ব্যতীত পথের পাশে কিংবা কোনো উন্মুক্ত স্থানে শেফালি তেমন একটা চোখে পড়ে না। অথচ এর ব্যাপক রোপণ শহরের জন্য খুবই জরুরি ছিল।

শীত ও বসন্তে নিষ্পত্র জীর্ণ শেফালি বড়ই হতশ্রী ও বিকর্ষী। গ্রীষ্ম পত্রউদ্গমের কাল। উজ্জ্বল-সবুজে আচ্ছন্ন শেফালির যৌবন শ্রী সুদৃশ্য। শরৎ প্রস্ফুটনের কাল। মঞ্জরি সীমিত, নিয়ত ও স্বল্পপৌষ্পিক হলেও সংখ্যায় অজস্র এবং সেজন্য শেফালি প্রস্ফুটনে ঐশ্বর্যময়ী।

এই ফুলকলিরা মুখ তোলে সন্ধ্যায়। তাই শরৎরাত্রি শিউলিগন্ধে ভরপুর। ক্ষীণায়ু এই ফুলেরা নিশিভোরেই ঝরে পড়ে নিচের পাতায়, তলার ঘাসে। শরতের শিউলিতলা শিশু-কিশোরদের খুবই প্রিয়। কুড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও এই ফুল যেন শেষ হতে চায় না। এই পাপড়িরা বহুক্ষণ গন্ধ বিলায়, বোটার হলুদ টিকে থাকে বহুদিন। শেফালির পাপড়িরা যুক্ত : নিচে গাঢ় কমলা, ওপরটা মুক্ত ছড়ানো, দুধসাদা ও সুগন্ধি। পরাগকেশর পাপড়ি নলের গভীরে অদৃশ্য থাকে। ফল শুকনো, চ্যাপ্টা, ধূসর এবং বসন্তের আগ অবধি গাছে টিকে থাকে। শিউলি তলায়ই ফলেরা ঝরে পড়ে এবং সেখানেই অজস্র চারা জন্মে।

বাঙালির মানসলোকে শরৎ বিশিষ্ট মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। কাকচক্ষু নদী, গভীর নীলাকাশ, রজতশুভ্র মেঘপুঞ্জ, উজ্জ্বল দিনের হিরণ-হলুদ আলো, আন্দোলিত কাশবনের মঞ্জরি, পদ্ম-শাপলা-শালুকে আচ্ছন্ন জলাভূমি এই ঋতুর অনুষঙ্গ। কিন্তু এসব ছাপিয়ে প্রস্ফুটিত শেফালিকে মধুগন্ধে কোনো সন্ধ্যায়ই কেবল শরতের আগমনীকে গভীরভাবে অনুভব করা যায়। শিশিরসিক্ত দূর্বায় শিউলির নির্ঝরেই তো শরতের আগমনী পথের আলপনা আঁকা হয়। আমরা আশৈশব তাকে দিয়েই শরৎকে চিনি।

আরো পড়ুন:  ঢোলপাতা বা কানশিরে তৃণের সাতটি ভেষজ উপকারিতা

শিউলি হিন্দুদের পূজা এবং মালায় ব্যবহৃত হয়। ফুলের বোঁটার হলুদ রং উজ্জ্বল, কিন্তু অস্থায়ী। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তাদের কসায়বস্ত্র এ দিয়ে রং দেন। মিষ্টান্নেও এই হলুদ ব্যবহার্য। পাতা খুবই তিতা এবং জ্বর-উপশমে কার্যকর। বীজ চর্মরোগের ঔষধ। কাঠ মূল্যহীন।

‘নিকটেনথা’ গ্রিক শব্দ, অর্থ হলো নিশিপুষ্প। শিউলি ব্যতীত কোনো বাগানই পূর্ণ নয়। আমাদের সৌন্দর্য চেতনার অনুষঙ্গ হিসেবে এই তরুটি অবশ্যই যত্ন ও সমাদর দাবি করতে পারে। পাবলিক লাইব্রেরির দেয়ালঘেঁষা সেই শিউলি গাছটি আজও আছে, প্রস্ফুটিত হয়, গন্ধ বিলায়।

সাহিত্যে ব্যবহার: যারা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক পড়েছেন লবটুলিয়ার জঙ্গলের শিউলির বিশাল অরণ্য এবং তীব্র সৌরভ-প্লাবিত এক সন্ধ্যায় নায়কের সম্মোহিত অবস্থার কথা তারা সবাই জানেন। রবিন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘কেন সুদূর গগনে গগনে/ আছো মিলায়ে পবনে পবনে/ কোন কিরণে কিরণে ঝলিয়া/ যাও শিশিরে শিশিরে গলিয়া/ ওগো শেফালী বনের মনের কামনা।’

তথ্যসূত্র:

১. দ্বিজেন শর্মা, শ্যামলী নিসর্গ, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, চতুর্থ মুদ্রণ, জানুয়ারি ২০১৬ পৃষ্ঠা ২২২-২২৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!