অশোক গাছের ছাল, বীজ দিয়ে ভেষজ ঔষধ তৈরি হয়। এই গাছ বহু শাখাবিশিষ্ট ছায়াতরু, বর্তমানে পথের ধারে একে রোপণ করতে দেখা যায়। এদের বৈজ্ঞানিক নাম: Saraca asoca. এই গাছ দীর্ঘদিনের হলে ২৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে দেখা যায়। পাতার ডাঁটায় সাধারণতঃ ৫ থেকে ৬ জোড়া পাতা থাকে।
অশোক দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঔষধি গাছ
লৌকিক ব্যবহারঃ প্রথমেই বলে রাখি, বায়ু, পিত্ত, কফ এদের স্বাভাবিক ক্রিয়া হতে থাকলে আমরা নীরোগ থাকি; সেটার যখনই অসমবণ্টন চলে অর্থাৎ কোনো কারণে বিগড়ে তখনই শরীরে অস্বস্তি বোধ করি। এই অশোককে সাধারণত প্রয়োগ করা হয়েছে যেখানে বায়ুবিকার, সে পিত্ত বা কফ যেটাই তার অনুবন্ধী হোক। তাই চরক সুশ্রুমতাদি গ্রন্থে এটিকে প্রয়োগ করা হয়েছে বায়ুবিকারের ক্ষেত্রে।
১. স্নায়ুগত বাত: প্রায়ই মাংসপেশীগুলি হঠাৎ শান্ত হয়ে সঙ্কুচিত হয় , যন্ত্রণার সৃষ্টি করে, সেক্ষেত্রে ১২ গ্রাম অশোক ছাল একটু কুটে নিয়ে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে, এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে সেই জলে ১ গ্রাম আন্দাজ সৈন্ধব লবণ মিশিয়ে সকালে ও বিকালে দুইবারে খেতে হবে। এর দ্বারা স্নায়ুগত বাতের উপশম হবে। তবে এখানে একটি সাবধান করে দিই, যাঁরা হাই ব্লাড প্রেসারে ভুগছেন, তাঁরা এটা ব্যবহার করবেন না।
২. শ্বেত বা রক্ত প্রদরে: যেখানে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে অল্প অল্প ঝিরঝির করে স্রাব হতে থাকে- সে সাদাই হোক আর রক্তই হোক, সেক্ষেত্রে অশোক ছাল কাঁচা হলে ২০ থেকে ২৫ গ্রাম আর শুকনো হলে ১২ গ্রাম একটু কুটে নিয়ে ১২৫ মিলিলিটার অর্থাৎ প্রায় আধ পোয়া দুধ ও জল ৫০০ মিলিলিটার প্রায় আধ সের একসঙ্গে মিশিয়ে সিদ্ধ করে, আন্দাজ ১২৫ মিলিলিটার অর্থাৎ আধ পোয়া থাকতে নামিয়ে, গরম অবস্থায় ছেঁকে বিকালের দিকে খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে।
৩. রক্তযুক্ত অর্শ: যেখানে দেখা যায় মলদ্বার থেকে কাঁচা রক্ত পড়ছে অথচ বলিতে কোনো জ্বালা-যন্ত্রণা নেই, সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে এটা বায়ুর প্রাধান্য, তাই ১০ গ্রাম আন্দাজ অশোক গাছের ছাল কুটে ১ গ্লাস বা ২০০ মিলিলিটার গরম জলে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে তারপরে ছেঁকে, প্রত্যহ সকালে ও বিকালে দুবার খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ রক্তপড়া বন্ধ হবে।
৪. হৃদ দৌর্বল্যে: বাজ পড়ার শব্দে, বন্দুকের বা বোমার আওয়াজে, এমনকি জোরে আলমারি বন্ধ করার শব্দেও বুক কেঁপে ওঠে। এই রকম ছোটখাটো আওয়াজে ভয় হয়ে হৃৎকম্প উপস্থিত হয়, এটাও তো হৃদ দৌর্বল্য। এই রকম অবস্থায় অশোক ছাল ৫ থেকে ৭ গ্রাম একটু কুটে নিয়ে, এক কাপ গরম জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা বাদে ওটাকে ছেঁকে নিয়ে খেতে হবে। তবে এই ছালের ক্বাথ দিয়ে যথাযথ নিয়মে ঘি তৈরী করে সেই ঘি ৬ গ্রাম বা আধ তোলা মাত্রায় খেলে ওটা সেরে যাবে।
৫. নাড়ী সরে আসায়: প্রসব করানোর দোষে অথবা বহু সন্তানের মা হলে, মায়েদের অনেকের জরায়ুর নাড়ীটা ঝুলে আসে যেমন, আবার এদিকে তার সঙ্কোচনের শক্তিও কমে যায়; তারই পরিণতিতে বসবার সময় কারও ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত শব্দও হয়, এটা কিন্তু শিথিলতার বিশেষ লক্ষণ, তাই এই ক্ষেত্রে অশোক গাছের ছাল ১০ থেকে ১২ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে প্রত্যহ খেতে হবে।
৬. মৃতবৎসায়: মা হওয়ার ইচ্ছে কিন্তু গর্ভ হচ্ছে না। অথচ এমন কোনো বাঁধার কারণও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর যদি বা সন্তানসম্ভবা হলেন সেটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এক্ষেত্রে অশোক ছাল ১৪ থেকে ১৫ গ্রাম সেটা ২০ গ্রাম পর্যন্ত নেওয়া যাবে, ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে, একটু দুধ মিশিয়ে প্রত্যহ একবার করে খেতে হবে। তবে মাসিক বন্ধ হওয়ার পর এবং পরের মাসে মাসিক ঋতু হওয়া পর্যন্ত পুরো ২৬ থেকে ২৭ দিন খেতে হবে।
৭. আমসুংযুক্ত মল: যে আম বায়ুতে শুকিয়ে চিমসে হয়ে যায়, অবশ্য ধরে নিতে হবে এটা ক্রিমির উপদ্রবে সৃষ্ট হচ্ছে, সেক্ষেত্রে অশোক বীজ চূর্ণ করে আধ গ্রাম মাত্রায় দু’বেলা একটু গরম জল সহ খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে।
৮. তৃষ্ণা রোগে: ইচ্ছা জাগে ঠান্ডা জল খাই, কিন্তু যত খাই-পিপাসা আর মিটছে না; আরও বেড়ে যাচ্ছে, জল খেয়ে পেট ঢাক। এখন প্রশ্ন হলো এটা কেনো হচ্ছে? আয়ুর্বেদের চিন্তাধারা হলো—কোনো উষ্ণ দ্রব্য সেবনের পর অথবা রোদ থেকে ঘুরে এলে রসবহ স্রোতের উষ্ণতা আসে, অপরদিকে তার অগ্নিবলও কমে যায়; তাই ওটা অগ্নির সমধর্মিতা সৃষ্টি করতে পারে না, সেই জন্যই তার এই চাহিদা। এক্ষেত্রে অশোক ছাল ১০ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে, সকালে ও বিকালে খেতে হবে, এর দ্বারা পিপাসা রোগটা সেরে যাবে।
বাহ্য প্রয়োগ
৯. চর্মের কর্কশতায়ঃ: খসখসে চামড়া, সাত রকম মেখেও চামড়ার ঔজ্জ্বল্য রাখা যায় না; বুঝতে হবে বায়ু বিকৃত হয়ে মাংসবহ স্রোতকেই দুষিত করছে। এক্ষেত্রে অশোক বীজ বেটে হলুদের মত মাখলে ওটা সেরে যাবে। আর এটা যদি সংগ্রহ করা সম্ভব না হয় তা হলে অশোক ছালের ক্বাথ একটু ঘন করে গায়ে লাগিয়ে এক/দেড় ঘন্টা বাদ স্নান করতে হবে।
১০. দাহ রোগে: যাঁদের পিপাসা হয়, তাঁদের অনেকের শরীরে জ্বালা হতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে অশোক গাছের ছাল ২০ থেকে ২৫ গ্রাম আন্দাজ করে ৪ থেকে ৫ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে সেই ক্বাথ দিয়ে শরীরটা মুছে দিতে হবে, তারপর ঘণ্টাখানেক বাদে গোসল করতে হবে। এটির ব্যবহারে গায়ের দাহটা কমে যাবে।
১১. রক্তবন্ধে: কোনো জায়গায় কেটে গেলে অশোক ছালের মিহি গুড়ো সেখানে টিপে দিয়ে বেঁধে রাখলে রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যাবে।
১২. বিষাক্ত কীটের দংশনে বা স্পর্শে লেগে: যদি সেখানে ফুলে যায়, সেখানে অশোক ছালের ক্বাথ বার বার সেচন করলে ঐ বিষুনিটা কেটে যাবে।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা,৩৮-৪৪।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Sailesh
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।