ভূমিকা: শ্যাওড়া বা শেওড়া বা শাহাড়া (বৈজ্ঞানিক নাম: Streblus asper) হচ্ছে মোরাসি পরিবারের স্ট্রেবলাস গণের একটি সপুষ্পক চিরসবুজ উদ্ভিদ। চলতি কথায় আমরা একে শাঁড়া গাছ বলে থাকি। বাংলায় একটা কিংবদন্তী আছে যে, এ গাছে পেত্নী বা প্রেতিনী বাস করে, তাই কোনো কুরূপা মেয়ের রূপের সঙ্গে তুলনা করে বলে থাকে, ‘শাঁড়া গাছের পেত্নী’। অবশ্য পরবতীকালে এর আরো একটি নাম ভূতাবাসও বলা হয়েছে।
এ নাম রাখার আর একটি কারণও থাকতে পারে, বৈদিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে এ গাছের মূলদেশে সাপ ও বিছে থাকতে ভালবাসে ; হয়তো বা কল্যাণকামী বৈদ্যককুল মানুষের সংস্কারকে কাজে লাগিয়ে এই গাছের সান্নিধ্যে লোক যাতে রাত বেরাতে না যায়, তারই ইঙ্গিত থাকতে পারে; অথবা অন্য কিছু। এই গাছটিকে হিন্দি ভাষাভাষী অঞ্চলে শাহোড়া বা শিহোড় বলে, উড়িষ্যার অঞ্চল বিশেষে একে বলে শাহাড়া, সংস্কৃত নাম যে শাখোটক, এটা পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে।[১]
বৃক্ষের বিবরণ: শ্যাওড়া ছোট আকারের চিরহরিৎ বৃক্ষ, ১৪ মিটার পর্যন্ত উঁচু, বাকল গাঢ় ধূসর, কর্কশ, শাখা-প্রশাখা অধিকাংশক্ষেত্রেই ঝুলন্ত, দূরাপসারি, এমনকি নিচের দিকের শাখা-প্রশাখাসমূহ আনুভূমিক, উপশাখাসমূহ খর্বাকার ও দৃঢ় রোমাবৃত, কচি অবস্থায় বায়ুরন্ধ্রগুলো সুস্পষ্ট। পল্লব বাদামী। পাতা দ্বি-সারি, অণুপর্ণী, উপপত্র ২-৫ মিমি লম্বা, ভল্লাকার, চেপটা রোমাবৃত, আশুপাতী, ফলক অবৃন্তক অথবা খর্বাকার বৃন্তবিশিষ্ট, বৃন্ত ৩ মিমি পর্যন্ত লম্বা, রোমশ, পত্রফলক উপবৃত্তাকার-ডিম্বাকার থেকে উপবৃত্তাকার, ২.০-১০.৫x১.০-৫.৫ সেমি, চর্মবৎ, নিচের প্রান্ত স্থুলাগ্র থেকে হৃৎপিণ্ডাকার, কিনারা অখন্ড বা অনিয়মিতভাবে সভঙ্গ, পার্শ্বশিরা ৪-৭ জোড়া, নিচের দিকে স্ফীত, মূলীয় পার্শ্বশিরা ১ জোড়া, খর্বাকার।
উভলিঙ্গ পুষ্পমঞ্জরী মুণ্ডাকার এবং একটি কেন্দ্রীয় স্ত্রী পুষ্পবিশিষ্ট যাহা অনেকগুলো পুং পুষ্প কর্তৃক বেষ্টিত। পুং পুষ্পমঞ্জরী একক অথবা জোড়বদ্ধ, মুণ্ডাকার, মঞ্জরীদন্ড ০.৫-১.৫ সেমি লম্বা, বিক্ষিপ্তভাবে অণুরোমাবৃত থেকে মসৃণ, পাদদেশে ১-২টি মঞ্জরীপত্র বিদ্যমান এবং অগ্রভাগে কয়েকটি ক্ষুদ্রাকার মঞ্জরীপত্র বর্তমান, সরু উপবৃত্তাকার, মঞ্জরীপত্রিকা ২টি, বৃতির পাদদেশে অবস্থিত, মঞ্জরীপত্র অপেক্ষা বৃহদাকার। পুং পুষ্প: প্রায় অবৃন্তক, সুগন্ধি, পুষ্পপুট ১ সেমি লম্বা, অণুরোমশ, পুংকেশর সাদা। স্ত্রী পুষ্পমঞ্জরী মঞ্জরীদন্ডক, মঞ্জরীপত্র ১টি বা ২টি, মঞ্জরীদন্ডের পাদদেশে অবস্থিত, ক্ষুদ্রাকার, মঞ্জরীপত্রিকা ২টি, বৃতির পাদদেশে অবস্থিত।
স্ত্রী পুষ্প: সবুজ, একক, রোমশ মঞ্জরীদন্ডের শীর্ষে অবস্থিত, বৃতির খন্ডকগুলো রোমশ, গর্ভাশয় গোলকাকার, গর্ভদন্ড ২ মিমি (প্রায়) লম্বা, অগ্রভাগ শাখান্বিত, ফলের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় ৬-১২ মিমি বৃদ্ধি পায়। ফল ড্রুপ, হলুদ থেকে কমলা, গোলকাকার, অবিদারী, অপরিপক্ক অবস্থায় বৃতির খন্ডকসমূহ দ্বারা আবৃত, সরস পাদদেশবিহীন। বীজ গোলকাকার, ৪ মিমি ব্যাসবিশিষ্ট, ধূসরাভ সাদা। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে ফেব্রুয়ারী থেকে জুন মাসের মধ্যে।[২] ক্রোমোসোম সংখ্যা : 2n = ২৬ (Mehra and Gill, 1974).
চাষাবাদ ও আবাসস্থল: শ্যাওড়া গাছ গৌণ অরণ্য, উন্মুক্ত প্রান্তর, নিম্নভূমি এবং গ্রামের ঝোপ-ঝাড় জন্মে। বংশ বিস্তার হয় বীজের সাহায্যে। বিশেষ কোনো যত্নের প্রযোজন নেই।
বিস্তৃতি: শ্যাওড়া গাছ ভুটান, কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, নেপাল, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম। বাংলাদেশে এই প্রজাতিটি সর্বত্র সহজেই চোখে পড়ে। এই গাছ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিবাঙ্কুর, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি ভারতের অধিকাংশ প্রদেশেই বিক্ষিপ্তভাবে জন্মে, তবে খুব উচু পাহাড়িয়া অঞ্চলে হতে দেখা যায় না।
অর্থনৈতিক ব্যবহার ওগুরুত্ব: শ্যাওড়া গাছ আলসার এবং সাইনাস (sinuses) চিকিৎসায় শিকড় ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়। বাকলের ক্বাথ ডায়রিয়া, আমাশয় এবং জ্বরে ব্যবহৃত হয়। দুগ্ধবৎ তরুক্ষীর জীবাণুনাশক গুণাবলী সম্পন্ন, এবং পায়ের গোড়ালী ব্যথা এবং হাত ভাঙ্গায় প্রয়োগ করা হয় (Kirtikar et al., 1935), কাঠ এবং গজদন্ত মসৃণ করতে ইহার পাতা ব্যবহৃত হয়। জাতিতাত্বিক ব্যবহার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে শ্রীলংকায় ইহার পাতা গো-মহিষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[২] ভেষজ চিকিৎসায় গাছের ও মূলের ছাল, পাতা ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। গাছের ডাল ও পাতা বিলের মাছের খাদ্য জন্মানোতে মাছের আবাসস্থলে নিক্ষেপ করা হয়।
অন্যান্য তথ্য: শ্যাওড়া দীর্ঘদিনে তিলে তিলে বাড়ে। গাছ ১৫ থেকে ২০ ফুটের বেশি সাধারণত উচু হয় না এবং এই গাছের শাখা প্রশাখাগুলি সোজা বড় হয় না। এদের পাতা খসখসে কাকডুমারের (Ficus hispida) পাতার মতো। এই গাছের পাতাগুলি এত ঘন বিশিষ্ট যে গাছের নিচে রৌদ্র পৌছোয় না। এইজন্যই এর নাম দেওয়া হয়েছে শাখোটক। শাখা+উটক=শাখোটক, উটক শব্দের অর্থ ছাদ। পাতা ছিঁড়লে বা গাছ কাটলে দুধি বা ক্ষীরা বের হয়।
মার্চ থেকে এপ্রিল মাসে ফুল হয়, ফলের আকারে মটরের মতো হলুদ রংয়ের হয়। ফল পাকে জুন মাসে। এর আর একটি নাম ক্ষীরনাশ, কারণ এর পাতা ছাগীকে খাওয়ালে দুধ চলে যায়। এই গাছটির সম্পর্কে একটা মজার কথা জেনে রাখা ভালো মেদিনীপুরের অঞ্চলবিশেষে এই গাছেরও বিয়ে হয়; যাঁরা ‘বউ খেগো’ অর্থাৎ যাঁদের বউ বাঁচে না, তাঁদের পুনরায় বিয়ের দিনে এই গাছের সঙ্গে আগে মালা বদল করে তারপর বিয়ে করে থাকেন। এই ভূতাবাস নামীয় গাছটির উপযোগিতায় এর আর এক তান্ত্রিক প্রক্রিয়া কিনা। আর একটি তথ্য জানানোর আছে ছাগল চুরি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই গাছের একটি পাতা ছাগলের জিভের তলায় দিয়ে দেয়, তাহলে সে জোরে ডাকতে পারে না, কেবল গোঁ গোঁ শব্দ করে।[১]
সংরক্ষণ তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৯ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) শ্যাওড়া প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে শ্যাওড়া সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে শীঘ্র সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন নেই।[২]
তথ্যসূত্র:
১ আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ২৬১।
২. এম অলিউর রহমান, (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ ৭ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২৪৯-২৫০। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Vinayaraj
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।