বড় ছাতিম হচ্ছে এশিয়ার ভেষজ বৃক্ষ এর তেরোটি ভেষজ ব্যবহার

ভূমিকা: বড় ছাতিম হচ্ছে (বোটানিকাল নাম: Alstonia scholaris) এপোসিনাসি পরিবারের এলস্টোনিয়া গণের বৃহৎ ও চিরসবুজ বৃক্ষ। পত্রাচ্ছাদিত বড় ছাতিম গাছগুলি ৪o/৫০ ফুট পর্যন্ত উচু হয়। গাছের পুরু ছালের ভিতরটা সাদা ও দানাযুক্ত কিন্তু উপরটা খসখসে, গাছের সমগ্রাংশে সাদা দুধের মত আঠা (ক্ষীরা) আছে, পাতাগুলির আকার অনেকটা মনসা পাতার মত। এই গাছ জন্মে সমগ্র বাংলা, দক্ষিণ ও উত্তর ভারতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুট পর্যন্ত উচুতেও। শরৎকালে ফুল ও শীতকালে সরু বরবটীর শিম্বির মত ফল হয়। এর ফুলের উৎকৃষ্ট গন্ধ থাকলেও সেটি তীব্র। ভেষজ হিসেবে বড় ছাতিম পাওয়া না গেলে ছোট ছাতিম (বৈজ্ঞানিক নাম: Alstonia macrophylla) ব্যবহার করা যেতে পারে। বড় ছাতিম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন

বড় ছাতিম এশিয়ার ঔষধি বৃক্ষ

বড় ছাতিম হচ্ছে ঔষধার্থে ব্যবহৃত উদ্ভিদ। এর ত্বক (ছাল), পাতা, ফল ও ক্ষীর (আঠা)। ঔষধের ব্যবহার্য মাত্রা হচ্ছে ছালচূর্ণ দেড় থেকে দু’গ্রাম, ফুলচূর্ণ আধ গ্রাম থেকে দু’গ্রাম, ক্ষীর সিকি গ্রাম থেকে আধ গ্রাম।

রোগ প্রতিকারে ছাতিমের ব্যবহার:

বড় ছাতিম হচ্ছে রসবহ ও রক্তবহ স্রোতের রোগ সারাতে ব্যবহৃত।

১. কুষ্ঠ: কোন জায়গায় লাল বা কাল দাগ দেখা দিচ্ছে, সে জায়গাটা একটু উচু এবং অসাড়তা আসছে, সেক্ষেত্রে ছাতিম ছালচূর্ণ এক গ্রাম মাত্রায় এক চা-চামচ, গুলঞ্চের রস মিশিয়ে খাওয়া, আর ১০/১২ গ্রাম ছাল ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে ঐ জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা। অথবা ৪০/৪৫ গ্রাম ছালকে থেতো করে আধ সের জলে খানিকসময় সিদ্ধ করে, ছেকে সেই জল স্নানের জলে মিশিয়ে স্নান করা।

২. জ্বরে: (পুরানো) – জ্বর প্রায় মাঝে মাঝে হচ্ছে, মুখে অরুচি, দাস্ত পরিষ্কার হয় না, যকৃত প্লীহায় ব্যথা, আস্তে আস্তে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে ১০/১২ গ্রাম ছাতিমছাল ৩/৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে (শুষ্ক হ’লে ৫/৬ গ্রাম), ছেকে নিয়ে সেই জল দু’বেলায় ভাগ করে খেতে হয়, এর দ্বারা দুই-এক দিনের মধ্যেই জ্বর ছেড়ে যাবে। এর সঙ্গে নাটা করঞ্জের Caesalpinia bonduc বীজের শাঁস ২ বা ৩ গ্রেণ (১৫০-২০০ মিলি গ্রাম) মাত্রায় খেলে ভালো থাকবেন।

আরো পড়ুন:  নয়নতারা এপোসিনাসি পরিবারের একটি আলংকারিক ফুল

৩. হিক্কাশ্বাসে: (পিত্তানুগত হিক্কাশ্বাসে) এক্ষেত্রে কফের আধিক্য থাকবেই, কিন্তু পিত্তের লক্ষণও থাকবে, সেক্ষেত্রে ছাতিম ছালের রস আধ চা-চামচ (৩o/৪o ফোঁটা) সিকি কাপ দুধে মিশিয়ে (৭/৮ চা-চামচের কম না হয়) খেতে হয়। ছাল কাঁচা সংগ্রহ না হলে ছালচূর্ণ দেড়/দুই গ্রাম দুধ ও পিপুল চূর্ণ মধ্যে মিলিয়ে খেতে হয়। পিপুল চূর্ণে ২/৩  রতি (১৫০—২০০ মিলিগ্রাম) নিলেই হবে।

৪. দন্ত পোকা: দাঁতের পোকার যন্ত্রণায় ছাতিমের আঠা (ক্ষীর) ঐ পোকা লাগা দাঁতের ছিদ্রে দিয়ে দিতে হয়। এগুলি আয়ুর্বেদের প্রাচীন গ্রন্থ বাগভটে বলা আছে ।

৫. হাঁপানি: (শ্বাসকষ্ট) যদি দেখা যায় বিশেষ সর্দির প্রকোপ নেই অথচ হাঁপের টান বেশী, তখান ছাতিমের ফুলে চূর্ণ এক বা দেড় গ্রাম, তার সঙ্গে পিপুল চূর্ণে ৩/৪ গ্রেণ (২oo/২৫o মিলিগ্রাম) মাত্রায় মিশিয়ে দই-এর মাতের সঙ্গে খেতে হবে।

৬. স্তন্যদুগ্ধের স্বল্পতা: বুকের দুধ কমে গিয়েছে, অথবা ভাল হয়নি, সেক্ষেত্রে ৫/৬ গ্রাম ছাতিম ছাল থেতো করে, ২ কাপ জলে সিদ্ধ করে আধা কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে, সেই জলের সঙ্গে আধা কাপ দুধ মিশিয়ে খেতে হবে। এর দ্বারা বুকের দুধ বেড়ে যায়। এভিন্ন স্তনের দুধ আঠার মত হ’লে এই ক্বাথে জল মিশিয়ে খেলে ঐ দোষটা নষ্ট হবে।

৭. গাঁটের ব্যথায়: বাতের জন্য যাদের ব্যথা হয় তাঁরা ৭/৮ গ্রাম ছালকে ৩  কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে ঐ ক্কাথাটা খাবেন, এর দ্বারা ঐ ব্যথার উপশম হবে।

৮. সর্দি বসায়: বুকে শ্লেষ্মা বসে গিয়েছে, সেক্ষেত্রে দুধে পানি মিশিয়ে তাতে ১ গ্রাম ছাতিমছাল চূর্ণ দিয়ে অল্প খানিকক্ষণ ফুটিয়ে সেইটা খেতে হবে অথবা ঐ চূর্ণ ঐ গরম জল মিশানো দুধ দিয়ে খেতে হবে। এর দ্বারা বুকের সর্দি তরল হয়ে বের হবে।

৯. অগ্নিমান্দ্যে: অম্লপ্রধান বা এসিডিটি প্রধান অগ্নিমান্দ্যে যাঁরা ভুগছেন, তাঁরা ছাতিমছাল অথবা ফুল চূর্ণ আধ গ্রাম (৫০০ মিলিগ্রাম) মাত্রায় গরম পানিতে মিশিয়ে দু’বেলা খবেন ।

আরো পড়ুন:  স্বর্ণচাঁপা ফুল, ফল, গাছের ছালের নানাবিধ ভেষজ গুণাগুণ

১০. শ্বাসকষ্ট: শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে (হাঁপানিজনিত), ছাতিম ফুল চূর্ণ (মিহি) আধ বা ১ গ্রাম মাত্রায় ২/৩ গ্রেণ (২০০ মিলিগ্রাম) লবণ মিশিয়ে অল্প গরম পানি সহ খেতে হয়, এর দ্বারা শ্বাসকষ্টের উপশম হয়।

১১. রক্তগুন্মে: গর্ভের সব লক্ষণ, কেবল বুকে দুধ আসে না, আর পেটে কুনকুন করে ব্যথা ধরে, এটা গুন্মের লক্ষণ, এক্ষেত্রে কয়েকদিন দু’বেলা ছাতিম চূর্ণ ২/৩ গ্রাম মাত্রায় খেতে হবে,এর দ্বারা ঐ রক্তগুন্মটা ভেঙ্গে গিয়ে স্রাব হয়ে যাবে,অথচ যন্ত্রণা হবে না,আর বায়ু জন্য গুন্মে হ’লে সেটা কয়েকদিনেই চুপসে যাবে।

১২. দুষ্ট ব্রণে: যে ব্রণের ক্ষত কিছুতেই ভালো হয়ে উঠতে চায় না, সেক্ষেত্রে ছাতিমের আঠা (ক্ষীর) শুকিয়ে গুড়ো করে ক্ষতের উপর ছিটিয়ে দিলে ঠিক হয়ে উঠবে!

১৩. পাইয়োরিয়ায়: ছাতিমের আঠা ৫/১০ ফোঁটা গরম জলে মিশিয়ে সেই জলে দিয়ে গারগেল (gargle) করলে, যদি সম্ভব হয় ২/৫ মিনিট ঐ জলটা মুখে রেখে তারপর ফেলে দিয়ে-এইভাবে একদিন অন্তর করলে পাইয়োরিয়া সেরে যায়।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা: ১৫-২০।

1 thought on “বড় ছাতিম হচ্ছে এশিয়ার ভেষজ বৃক্ষ এর তেরোটি ভেষজ ব্যবহার”

Leave a Comment

error: Content is protected !!