শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট গাছ। এটি বহৎ বৃক্ষের পর্যায়ে পড়ে। সাধারণতঃ ৩০-৪০ ফুট পর্যন্ত উচু হয়। এর ছাল ধূসর বর্ণ, প্রায় ২ ইঞ্চি পর, হয়। কচিপাতা ধূসর বর্ণ ও সুক্ষ্মরোমশ। পাতা ৯ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়, দেখতে অনেকটা কনকচাঁপা ফলের (Michelia Champaca) পাতার মত হ’লেও আগার দিকটা (অগ্রভাগ) সুচালো নয়। রং গাঢ় সবুজ। ডালের ডগায় পাতাগুলি যেন ছত্রাকারে সাজানো। পাতার বোঁটা নলাকার, ১/১২ ইঞ্চি লম্বা।
ফল নরম, রসে অম্লমধর ও শ্বেতাভ, দেখতে অনেকটা মনাক্কার মত। এতে একটা মিষ্ট গন্ধ আছে যার জন্য কুকুর, শিয়াল ও ভালকের (ভল্লক) ফুলগুলি খুব প্রিয়। ফলের গঠন অনেকটা খোসাসমেত ছোট আকারের সুপারির মত। শাঁসযুক্ত, কাঁচা অবস্থায় সবুজ, পাকলে হলদেটে হয়ে থাকে। ফলে ১৪টি বীজ থাকে। এর থেকে তেল তৈরী হয়। শীতে পাতা ঝরে যায়, বসতে নতন পাতা ও ফল একই সঙ্গে আসে, তারপরে ফল, সেটা পাকে শরৎকালে।
ভারত ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল এবং মালয়ে এই গণের (Genus) ৩০টি প্রজাতি বর্তমান। সাধারণতঃ মধ্যভারতের বনাঞ্চলে, বোম্বাই প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষভাবে গুজরাট অঞ্চলে ও কুমায়ুনে প্রচুর পরিমাণে এই গাছ দেখা যায়। তাছাড়া ভারতের সব প্রদেশেই অল্পবিস্তর আছে।
পাশ্চাত্য উদ্ভিদ বিজ্ঞানীগণ পূর্বে এই গণের দুইটি প্রজাতিকে এই পর্যায়ে গণ্য করতেন। প্রথমটির নাম Bassia longifolia। এর পত্র দীর্ঘ। আর দ্বিতীয়টির নাম Bassia latifolia। এর পত্র একটু হ্রস্ব এবং পুষ্পদন্ডও হ্রস্ব, কিন্তু বর্তমানে এই দুইটিকে পৃথক প্রজাতি বলে ধরা হয় না, একই প্রজাতির অন্তর্গত করা হয়েছে; তবে প্রাচীন নিঘণ্টুকারদের বক্তব্যে দেখা যায় যে, মধূক ও জলমধুক দুইটি ভেষজের উল্লেখ।
জলমধুক নামে যেটিকে বর্ণনা করেছেন সেটি অপেক্ষাকৃত নিম্নভূমিতে জন্মে এবং তার শাখা-প্রশাখা বেশী হয় না, যার জন্য ফলও কম হয়। আর যেটি মধূক সেটি অপেক্ষাকৃত উচ্চ ভূমিতে জন্মে। সেই গাছগলির শাখা-প্রশাখা বহু হয় এবং পাতাগুলি অপেক্ষাকৃত হ্রস্ব ও পুষ্পদণ্ডও হ্রস্ব হয়। সেই গাছে ফল ও ফল প্রচুর হয়। তাই প্রাচীনগ্রন্থে দেখা যায় মধুক ও জলমধুকে দুইটি পৃথক গাছের উল্লেখ। এর সংস্কৃত নাম মধক। বাংলা এবং হিন্দী নাম মহুয়া। বোটানিক্যাল নাম Madhuca longifolia. ও ফ্যামিলি Sapotaceae.
ব্যবহার্য অংশ— পাতা, ছাল, ফল, ফল, বীজ ও বীজের তেল। মন্তব্য— এখানে একট, সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়, এই জলমধকে বলতে যষ্টিমধই বা হয় না কেন?
মহুয়া গাছের উপকারিতা:
১. অগ্নিমান্দ্যে: যে অগ্নিমান্দ্য বায়ু ও পিত্ত জন্য হয়ে। সেক্ষেত্রে মহয়া ফুল ৫. গ্রাম বেটে সরবতের মত করে খেতে হবে। এর দ্বারা কয়েকদিনের মধ্যেই ওটা সেরে যাবে, আর একটা কথা, এর জন্য শরীরে যে দাহ হয় সেটাও আর থাকবে না।
২. কাসিতে: সে যে কোন প্রকারের কাসি হোক না কেন, ৫ গ্রাম মহুয়া ফুল অল্প জল দিয়ে চন্দনের মত করে বাটতে হবে, তারপর তার সঙ্গে অন্ততঃ এক বা দেড় কাপ জল মিশিয়ে লস্যি তৈরীর মত ফেটিয়ে নিতে হবে, সেইটাই সারাদিনে কয়েকবারে অল্প অল্প করে খেতে হবে। এর দ্বারা ওই কাসিটার উপশম হবে এবং কয়েকদিন খেলে সেরে যাবে।
৩. রক্তপিত্ত রোগে: মহুয়া গাছের শুক্রা ছালের ছাই ৫০০ মি.গ্রা. এবং তার সাথে আধা চামচ মধু দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর ঐ মিশ্রণে গাওয়া ঘি সামান্য। গরম করে মধুর মতো একই পরিমাণ মিশিয়ে ভালোভাবে মেখে সারা দিনে দু’বার করে খাওয়া দরকার। রোগ প্রথম অবস্থায় ধরা পড়লে তিন থেকে চার দিন নিয়ম মেনে খেলে উপকার পাওয়া যাবে। তবে রোগ জটিল হলে আট দশ দিন ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
মহুয়া ছালের ছাই যেভাবে তৈরি করা যায় সেটা শিখে রাখা জরুরি। গাছের শুকনা ছাল টুকরা করে একটি পরিষ্কার মাটির পাত্রে রেখে মুখে সারা চাপা দিয়ে চুলায় বসাতে হবে। তবে মাঝে মাঝে পাত্রের মুখ থেকে ঢাকনা সরিয়ে দেখা দরকার ঠিক মতো ছাল পুড়ছে কিনা। কারণ তাপ বেশি হলে পুড়ে শেষে আগুন জ্বলে উঠতে পারে। পোড়ানোর কাজ সম্পূর্ণ হলে পাত্র চুলা থেকে নামিয়ে নিয়ে ঠাণ্ডা করতে হবে এরপরে মিহি করে গুড়া করে নিতে হবে।
৪. ক্রিমির উপদ্রবে: বালক অথবা বয়স্ক মানুষের পেটে ছোট ক্রিমি হলে সারা দিনের মধ্যে তিনবার পাঁচ ফোটা করে মহুয়া বীজের তেল খেলে ক্রিমি মরে যাবে। তবে বীজের তেল একই নিয়মে তিন থেকে চারদিন খাওয়া দরকার।
৫. অর্শ রোগে: শুকনা মহুয়া ফুলকে সামান্য গাওয়া ঘিয়ে ভেজে দিনে এক থেকে দু’বার অর্শের বলিতে এবং মলদ্বারে ব্যবহার কলে উপশম হয়। এতে অর্শরোগের স্থায়ীভাবে রোগমুক্তি ঘটে না, তবে সাময়িকভাবে রোগী আরাম পায়।
বাহ্য ব্যবহার
৬. বাতের যন্ত্রণায়: অল্প জল দিয়ে মহয়া ফুল বেটে, গরম করে ঐ যন্ত্রণার স্থানটায় প্রলেপ দিলে ফুলোটাও কমে যাবে। এভিন্ন মহয়া বীজের তেল মালিশ করলেও বাতের যন্ত্রণা কমে যায়। তবে তেলটা অল্প গরম করে নিতে হয়। এই তেল সাধারণতঃ পাওয়া যায় সাঁওতাল পল্লীতে।
৭. ক্ষতে: সে পচনশীল হোক আর যেকোন প্রকারেরই হোক মহুয়া। বীজের তলে ন্যাকড়া ভিজিয়ে অথবা তুলো ভিজিয়ে ওই ক্ষতের উপর বসিয়ে দিতে হয়। এর দ্বারা পচানিটা কমে যাবে এবং ঘাও শুকিয়ে যাবে।
৭. মাথার যন্ত্রণায়: সে যে কোন কারণেই হোক, মহুয়া বীজের তেল মালিশ করলে যন্ত্রণার উপশম হবে।
CHEMICAL COMPOSITION
Madhuca indica Gmel.
Analysis of seeds:– Moisture 7-8%; fatty oils 51.1%; (oleic, palmitic, stearic, linoleic, myristic and arachidic);: Protein (8%); ash 2.7%; fibre 10.3%; sterols and hydrocarbon; illipene. Analysis of cake:- Moisture 7.2; oil 8%; protein 15%; carbohydrates 48%; ash 6.4%; saponin viz., mowrin, bassic acid. Analysis of flowers :— Moisture 18.6%; protein 4.4%; fat .5%; sugars 72.9%; ash 2.7%; inorganic matter. viz., phosphorus, calcium, iron, magnesium, copper, vitamins viz., ascorbic acid, vitamin-A, thiamine, riboflavin, niacin, folic acid; panthothanic acid, biotin and inositol. Analysis of leaves:— Moisture 78.95%; organic matter 19.6%; N.O. 43%; mineral matter 1.45%; potash .43%; phosphoric acid .087% and silica .10%.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৫, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৩, পৃষ্ঠা, ৭২-৭৪।
২. আঃ খালেক মোল্লা সম্পাদিত;লোকমান হেকিমের কবিরাজী চিকিৎসা; মণিহার বুক ডিপো, ঢাকা, অক্টোবর ২০০৯; পৃষ্ঠা ৯৭-৯৮।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।
মহুয়া ফল সম্পর্কে আপনার প্রকাশিত লেখাটি চমৎকার লেগেছে। দয়া করে আপনি কি আমাকে মহুয়া গাছের চারা বাংলাদেশে কোথায় পাওয়া যায় জানাবেন কি? উত্তর পেলে উপকৃত হব। ভুল হলে ক্ষমা করবেন।
এনামুল কবির
ই-মেল — sajroint@gmail.com
ঢাকার নার্সারিগুলোতে পাবেন, তবে আগে অর্ডার দিতে হতে পারে। ময়মনসিংহের ত্রিশালে একটি বড় নার্সারি আছে, ওরাও দিতে পারবে।