পিতরাজ বা রয়না বিশাল, দর্শনীয় চিরসবুজ বৃক্ষ। ঘন ছড়ানো পল্লবিত মুকুট এবং একটি সোজা গুঁড়ি সম্পন্ন যার উচ্চতা ১৫ মিটারের মতো। বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং ময়মনসিংহে দেখা যায়। বাকল গাঢ় খয়েরি, পুরু, অমসৃণ, ককসদৃশ ফাটা এবং ফাটাগুলো লালচে। পাতা অসমপক্ষল, পত্রক উপবৃত্তাকৃতি বা ডিম্বাকৃতি। পত্রদণ্ডের দুদিকে সমান্তরালভাবে এবং অগ্রভাগে পত্রক হয়। পুষ্পদণ্ডে স্ত্রী পুরুষভেদে দুরকমের ফুল ফোটে। ফল গোলাকৃতি, মসৃণ শাঁসযুক্ত এবং ঈষৎ লাল বা ফিকে পীত বর্ণের হয়ে থাকে। বর্ষাকালে ফুল এবং পরে ফল হয়। বীজ স্কারলেট এরিলসহ আয়তাকৃতি, তৈলাক্ত ।
অন্যান্য নাম: বাংলাদেশে রয়না নামে পরিচিত এ উদ্ভিদটির বেশ কয়েকটি নাম আছে- দাড়িমপুষ্প, রোহিত, সদাপ্রসূন, প্লীহত্ন, দাড়িমচ্ছদ, তিক্তরাজ, পীতরাজ। বিভিন্ন ভাষায় এর কয়েকটি নাম আছে সংস্কৃতে- রোহিতক; হিন্দিতে- হরিণহরা; মারাঠায়- রোহদা, রোহিড়া; উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম- Aphanarmixis polystachya (Wall.) Park (সমনাম- Amoora rohituka W. L. A.) গোত্র- মেলিয়্যাসী।
প্রাচীন শাস্ত্রে:
রয়না ‘রোহিতক’ নামেই সর্বত্র পরিচিত। সুপ্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র সমূহে রোহিতকের উল্লেখ দেখা যায় মূলত রক্তসম্পর্কিত ব্যাধি নিরসনের জন্য। চরকের চিকিৎসাস্থানের ১৮ অধ্যায়ের বলা হয়েছে প্লীহা, যকৃৎ বেশ বৃদ্ধি পেলেও রয়নার বাটা (কল্ক) যথাযথ পাকের নিয়মে তৈরি করে প্রয়োগ করলে ঐ রোগ নিরাময় হবে। এর দ্বারা উদর রোগেও নিরাময়তা আসবে। চিকিৎসাস্থানের বলা হয়েছে- কফ-পিত্তবিকারজনিত মেহরোগে আক্রান্ত হয়ে রয়নার ফুল মধুসহ বেটে খেলেও উপকার হবে। চিকিৎসাস্থানের ৩০ অধ্যায়ে বলা হয়েছে- শ্বেত বা রক্তপ্রদরে রয়নার শিকড়ের ছাল ঠাণ্ডা পানিতে বেটে মাত্রামতো খেলে তা সেরে যাবে।
আধুনিক চিকিৎসায়:
বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফমুলারি ১৯৯২-তে দুটি ওষুধে রোহিতক ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে রোহিতকারিষ্ট-তে রয়নার ছাল ব্যবহার করা হয় এবং ওষুধটি প্লীহা, যকৃৎ, উদর, অষ্ঠিলা, গ্রহণী, কামলা, শোথ ও অরুচি প্রশমক বলে উল্লেখিত। রোহিতক লৌহ নামক ওষুধটিতেও এর ছাল ব্যবহার করা হয়। এটি প্লীহা, যকৃৎ বৃদ্ধি এবং অগ্রমাংস প্রশমক বলে ব্যবহার্য। এ ছাড়া আরও দুটি ওষুধ যথা রোহিতক মৃত এবং রোহিতকাদ্য চূর্ণ-তে রয়না ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু সে ওষুধ দুটি ফর্মুলারীতে উল্লেখ করা হয়নি।
পিতরাজ বা রয়না-এর ঔষধ হিসাবে ব্যবহার
বাংলাদেশে রয়না গাছ পর্যাপ্ত পাওয়া যায়। তাই একক ভাবে এ গাছ কি কি লক্ষণে ব্যবহার করা যায় সে সম্পর্কে জানা দরকার।
১. রক্তবিকারজনিত সমস্যা: রক্তবিকারজনিত অর্শে অর্থাৎ মাঝেমধ্যেই রক্তদাস্ত হয়, পিপাসা এবং অরুচি থাকে, বলিগুলোর মুখ ঠিক জোকের মতো হয় সেক্ষেত্রে রয়না মূলের ছাল ৫ গ্রাম টুকরো করে ৪ কাপ পানিতে সেদ্ধ করে এক কাপ থাকতে ছেকে নিয়ে সকালে অর্ধেক এবং বিকালে অর্ধেকটা সমপরিমাণ দুধ মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
২. রক্ত প্রদর: রক্ত প্রদরে শুরুতেই যদি রয়না মূলের ছাল খাওয়ানো যায় তা হলে সহজেই এ রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। মূলের ছাল ৫ গ্রাম পূর্বোক্ত নিয়মে সেদ্ধ করে আধ কাপ থাকতে নামিয়ে অর্ধেকটা সকালে এবং বাকি অর্ধেকটা বিকালে ক্বাথ-এর দ্বিগুণ পরিমাণ দুধ মিশিয়ে খেতে হবে।
৩. মোটা হওয়া রোগ সারাতে: মোটা হওয়া রোগে যেক্ষেত্রে পায়ের উপরের অংশ এবং নিতম্ব অস্বাভাবিক ভারী হয় সেক্ষেত্রে রোহিতক ছাল ৫-৭ গ্রাম ৪ কাপ পানিতে ভালো করে সেদ্ধ করে এক কাপ মতো থাকতে নামিয়ে ঘেঁকে নিয়ে এ ক্বাথটার সঙ্গে সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে দু বেলায় খেতে হবে।
যকৃতের SGPT এবং SGOT বৃদ্ধি হলে এ ওষুধ তা প্রশমন করে। ক্রিমিরোগ, মেহরোগও একই নিয়মে খেলে উপকার হয়।
বাংলাদেশী পিতরাজ বা রয়নার বীজে একটি লিমোনয়ড-রোহিটুকিন পৃথক করা হয়েছে। বাষ্প পাতনের সাহায্যে বীজ থেকে হালকা হলুদ রঙের বান তেল নিষ্কাশন করা হয়েছে যার গন্ধটা অদ্ভুত রকমের। শুষ্ক বাকল থেকে টেট্রানরট্রাইটারপেনয়ড, এফানামিক্সিনিন। পৃথক করা হয়েছে।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার), দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ১৪৩-১৪৪।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dinesh Valk
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।