
প্রচলিত নাম ডেউয়া গাছ হলেও এ নামের বিস্তর ব্যতিক্রম স্থানে স্থানে ধরা পড়ে। কোথাও এটি ডাহু, ঢেয়ু, ডেফল, ডেহুয়া বা ডেলোমাদার। সংস্কৃতে লকুচ; হিন্দিতে লকুচ: ইংরেজিতে: Monkey jack. বৈজ্ঞানিক নাম: Artocarpus lakoocha Buch. Ham (সমনাম: A. lackoocha Roxb) গোত্র মোর্যাসী।
ডেউয়া গাছ-এর বিবরণ:
বৃহৎ পাতাঝরা বৃক্ষ ২০ মিটারের মতো উঁচু হতে পারে। ডেউয়া গাছ-এর গুড়ি বড়, সোজা এবং মাথার দিকে পল্লব ছড়ানো। বাকল ধূসর, খসখসে। ছোট ছোট গোলাকৃতি টুকরা ছাল ওঠে, যার ভিতর দিক লালচে। সমগ্র গাছেই শ্বেতকষ আছে। পাতা বড়, ১২ থেকে ২৪ সেমি লম্বা ৮-১৪ সেমি চওড়া। খসখসে দেখতে, কতকটা কাকডুমুরের (Ficus hispida) পাতার মতো, কিন্তু আকারে বড়, উপবৃত্তাকৃতি, আয়তাকৃতি বা ডিম্বাকৃতি। গোড়া চওড়া, কীলকাকৃতি, পক্ষবৎ উপখণ্ডিত। স্ত্রী ও পুরুষ ভেদে ফুল দুই প্রকারের; পুরুষ মুণ্ড উপবৃত্তাকৃতি, পুষ্পপুট ২ (অথকাত) মুণ্ডখণ্ড, মঞ্জরিপত্র দৃঢ় বৃন্তযুক্ত; স্ত্রীপুষ্পমুণ্ড গর্ভদণ্ড পেলটেট মঞ্জরিপত্রের মধ্য দিয়ে উদাত নিচু প্যাপিলার মধ্য দিয়ে। বের হয়। সিনকার্প ৬-১২ সেমি লম্বা। প্রায় গোলাকৃতি, হালকা খণ্ডিত, হলুদ, শুকালে খয়েরি, পৃষ্ঠদেশ অনিয়মিত প্যাপিলেট, রোমশ, অসংখ্য স্থায়ী বৃতিযুক্ত; ফল মাংসল, কাঁঠালের কোয়ার মতো ছোট কোয়াবিশিষ্ট যার মধ্যে বীজও থাকে। স্বাদে মধুরাম্ল। সাধারণত চৈত্রে ফুল এবং আষাঢ় মাসের দিকে ফল পাকতে শুরু করে।
ডেউয়া গাছ-এর প্রাচীন শাস্ত্রে:
চরক সংহিতার সূত্রস্থানের ২৬ অধ্যায়ে লকুচ বা ডেলোমাদার বা ডেউয়াকে মধু এবং দুধ এবং অপর একস্থানে মাষকলায়ের সুপ, গুড় ও ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে ওগুলো সংযোগ বিরুদ্ধ। অর্থাৎ সে সময়ও গভীর পর্যবেক্ষণ করে ডেউয়া কিসের সঙ্গে খেলে ক্ষতি হতে পারে তাও নির্দেশনা হিসেবে এসেছে যেমন আমরা বলি মাংস ও দুধ একসঙ্গে খেতে নেই, খুব গুরুপাক।
সুশ্রুত সংহিতার সূত্রস্থানের ৪৬ অধ্যায়ে ১৫৪ শ্লোকে বলা হয়েছে এটি ত্রিদোষ (বায়ু-পিত্ত-কফ)-জনক, বিষ্টম্ভকারক এবং শুক্রনাশক। চক্রপাণি দত্ত বলেছেন ডেউয়া তিক্তকষায় রস, উষ্ণবীর্য, লঘুপাক, কফদোষনাশক, দাহকর এবং মলসংগ্রাহী। এটা অপক্ক বা কাঁচা লকুচ বা ডেউয়া সম্বন্ধে। কিন্তু ভাবপ্রকাশকার বলেছেন কাঁচা লকুচই উষ্ণবীর্য এবং পাকা হলে সেটা গুরুপাক। সুপক্ক হলে মধুর অম্নরসযুক্ত; তখন সেটা বায়ু ও পিত্তদোষ দূর করে। তাই পরিষ্কার বোঝা গেল যে ডেউয়া আহার্য এবং ভেষজ হিসাবে উপযোগী।
ব্যবহার্য অংশ: ডেউয়া একটি ভেষজ গাছও বটে এর ছাল গুঁড়ো করে যে কোনো ক্ষতে লাগালে ক্ষত শুকিয়ে যায়। ফল কফ বর্ধক, কাম উদ্দীপক ও ক্ষুধা বর্ধক।
ডেউয়া গাছ-এর ভেষজ গুণাগুণ:
১. পেট পরিষ্কার করতে: দাস্ত পরিষ্কার করার জন্য কাঁচা ডেউয়া ফল থেতলিয়ে এক-দেড় চা-চামচ রস এক কাপ গরম পানিতে মিশিয়ে খেলে দাস্ত পরিষ্কার হয় এবং
২. শরীরের চর্বি কমাতে: এক কাপ ঠাণ্ডা পানিতে মিশিয়ে কয়েকদিন খেলে মেদ কমতে শুরু করবে। তবে মেদ বাড়বার কারণ এবং খাদ্যদ্রব্য পরিহার করতে হবে।
৩. শুক্রাণু বাড়াতে: শুক্রস্বল্পতায় (আধুনিক কালের পরীক্ষায় যদি তা ধরা পড়ে) পাকা ডেউয়া ফলের রস এক-দেড় চা-চামচ একটু চিনি মিশিয়ে মাসখানেক ধরে খেলে শুক্রের আধিক্য ঘটবে।
৪. ত্বকের সমস্যা দূর করতে: ছালের গুঁড়া ও ক্বাথ গায়ের চামড়ার রুক্ষতায় বাহ্য প্রয়োগ করা হয়।
৫. ব্রণ ও ফোঁড়া সারাতে: মুখের ব্রণ ও ফোঁড়া থেকে দূষিত পুঁজ বের করার জন্য ছালের পুলটিশ উপকারী।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার), দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ১৬৬-১৬৭।