কুকুরচিতা বা মেন্দা গাছ-এর নয়টি ভেষজ গুণ

কুকুরচিতা বা মেন্দা গাছ-এর কাঠ হরিদ্রাভ-ধূসর কিংবা ধূসর-বাদামী রঙের, বেশ শক্ত, নানাবিধ গৃহকর্মাদির কাজে ব্যবহৃত হয়। পাতার কোল থেকে পুষ্পদণ্ড বেরোয়, সেটি খুবই ছোট এবং পুষ্পদণ্ডের মাথায় ছাতার মতো ছোট ছোট হরিদ্রাভ বর্ণের ফুল ফোটে। এর অনেক ভেষজ উপকারিতা আছে।

কুকুরচিতা বা মেন্দা গাছ-এর ভেষজ ব্যবহার

১. অতিসারে: প্রতিদিন ২/৩ বার পাতলা দাস্ত, তবে জলের মত নয়; খাচ্ছে-দাচ্ছে ঘুরছে, অথচ কোন কিছুতে শান্তি নেই; মাঝে মাঝে পেটটা ফাঁপে, ভুটভাট শব্দ হয়, দীর্ঘদিনের হলে সেটা যে একটা রোগ, তা আর মনেই থাকে না, একটু বাড়াবাড়ি না হলে চিকিৎসাও বন্ধ; এই পরিস্থিতিতে নিম্নলিখিত চিকিৎসা ভালো উপশম পাওয়া যাবে।

শুকনো মেদা লকড়ী ( Litsea glutinosa ) ছালের মিহি চূর্ণ ১ গ্রাম মাত্রায় দিনে ২-৩ বার ঠাণ্ডা জল সহ খেতে হবে। সহজপাচ্য লঘু আহার এ সময় গ্রহণীয়। এই যোগটি মাসখানিক ব্যবহার করলে বুঝতে পারবেন শরীরের অবস্থার উন্নতি। প্রয়োজনে আরও কিছুদিন ১-২ বার খাওয়া যেতে পারে।

২. জীর্ণ প্রবাহিকায়: দীর্ঘ দিনের আমাশায় যখন কেউ ভুগতে থাকেন, তখন শরীরের অবস্থাটা যে কি রকম হয়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যে বুঝতে পারে না। এই আমাশয় যদি রক্ত মিশ্রিত হয় তাহলে তো আরও ভয়ের বিষয়। এক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে মেদা লকড়ীর ছাল চূর্ণ দু-এক মাস লাগাতার ব্যবহার করতে পারলে এবং লঘু ও সহজপাচ্য আহার গ্রহণ করলে দীর্ঘদিনের কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

৩. স্বপ্নদোষে: যে স্বপ্নদর্শনের দ্বারা শরীরের ধাতুক্ষয় হয়, সেই স্বপ্ন দেখাটাই ক্ষতিকর অর্থাৎ দোষের, তাই রোগটারও নাম হলো স্বপ্নদোষ। দীর্ঘদিন চলতে থাকলে শরীরে অবসাদ আসে, আর পরবর্তীকালে সেটা যৌন-জীবনের উপর প্রতিফলিত হয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপাকেও ফেলে দেয়। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত দু’টি মুষ্টিযোগের যেকোন একটি ব্যবহার করতে পারলেই চলবে । তবে মাস তিনেকের মত ব্যবহার করতেই হবে ।

ক. শুকনো মেদা লকড়ী ছালের মিহি চূর্ণ ২ গ্রাম মাত্রায় দিনে ২ বার আন্দাজ ১ কাপ পরিমাণ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে। দুধ গরম করার পর ঠাণ্ডা হলে ব্যবহার্য। আর, না পেলে ঠাণ্ডা জল দিয়েই খাবেন।

আরো পড়ুন:  রাজমা লতানো বর্ষজীবী ভেষজ উদ্ভিদ

খ. মেদা লকড়ীর কাঁচা পাতা ২। ৩টি জলে বেটে তার সঙ্গে আন্দাজ কাপ দেড়েক জল এবং প্রয়োজনমত চিনি মিশিয়ে সরবতের মত করে সকালের দিকে একবার এবং শিকালের দিকে আর একবার খেতে হবে। অবশ্য বেটে নিলে ছিবড়েগুলো খাওয়া হয়ে, তাই পাতাগুলোকে না বেটে ভালভাবে জলে চটকে ফেলে দিলেও চলবে। জলটি তখন এক প্রকার পিচ্ছিল তরলে পরিণত হবে। তারপর প্রয়োজনমত চিনি মিশিয়ে নিলেই উত্তম পানীয় প্রস্তুত হয়, খেতে খুব একটা খারাপ লাগে না।

৪. শ্বেতপ্রদরে: যদি মেয়েটির বয়স বেশি না হয়, সবে যৌবন-প্রাপ্তি হয়েছে কিংবা সামান্য কিছুদিন স্বামীগৃহে বসবাস করছে, হয়তো বা কারো বয়স ২৫। ৩০ বছর, বিয়ে হয়নি, কেউ বা এক বাচ্চার মা, অথচ বয়স ২০। ২২-এর ভেতর, ছিপছিপে গড়ন, রাগ-রাগ ভাব সর্বদা, খুঁত-খুঁতে ধাত, নানা কারণে মনে অশান্তি, তারা যখন সাদা লাগে ভুগতে থাকে, তখন মেদা লকড়ীর কাঁচা পাতা ২। ৩টি কাপ দেড়েক ঠাণ্ডা জলে ভালভাবে চটকে নিয়ে পাতাগুলো ফেলে দিয়ে ওতে সামান্য চিনি ও অল্প পরিমাণে (আন্দাজ আধ কাপ) দুধ (গরম করার পর ঠাণ্ডা হলে) মিশিয়ে সরবতের মত তৈরী করে সকালে খালি পেটে একবার এবং এভাবে বিকালের দিকে আর একবার মাসখানিক খেলে সাদা স্রাবটা কমে যাবে। তারপর মাঝে মাঝে খেতে পারলে খুব ভাল হয়। এর দ্বারা শরীরে চাঞ্চল্যও বিনষ্ট হয়, শরীরে কোন দাহ থাকলে সেটিও চলে যায়।

৫. কামাসাদে বা কামোত্তেজনা হ্রাসে: দীর্ঘদিন ধরে ভোগ-বাসনা চরিতার্থ করতে করতে একটা অবসাদ এসে গেছে, মনের মধ্যে সাধ জাগে অথচ আস্বাদ গ্রহণে অতৃপ্তি, এটা আবার দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে নানা প্রকার বিপদের সম্ভবনা সৃষ্টি হতে পারে। এই অবস্থাটা নারী-পুরুষ উভয়েরই আসে। মেয়েদের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি এবং ৩। ৪টি সন্তানের মা হলে কাম-প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে মনের মধ্যে একটা অনীহা আসে। অল্পবয়সী মেয়েদেরও এটা আসতে পারে, অনেক কারণের মধ্যে দু’একটি হলো—অত্যধিক সাদা| স্রাবে ভোগা, দুর্বলতা, চিত্তচাঞ্চল্য প্রভৃতি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মন চায়, শরীর পারে না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে শরীর চায় তো মন সায় দেয় না। এমতাবস্থায় শুকনো কুকুরচিতা বা মেন্দা গাছ-এর ছাল চূর্ণ ২ গ্রাম মাত্রায় দিনে ২ বার অর্থাৎ সকালে ও সন্ধ্যায় আন্দাজ আধকাপ গাভীর দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে। আর প্রতিদিন বিকালের দিকে একবার করে মেদা লকড়ী কাঁচা পাতা ২। ৩টি জলে চটকে চিনি সহযোগে সরবত করে খেলে আরও ভাল হয়। বিশেষতঃ যাদের অত্যধিক সাদা স্রাব কিংবা স্বপ্নদোষজনিত কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাদের পক্ষে অতি উত্তম ব্যবস্থা । এভাবে ২। ৩ মাস ব্যবহার করা উচিত ।

আরো পড়ুন:  গামার বা গামারি গাছের ভেষজ গুণাগুণ

৬. স্তন্যাল্পতায়: প্রসবের পর থেকেই প্রসূতাকে খুব সাবধানে রাখতে না পারলে বুকের দুধে ঘাটতি আসতে পারে এবং ক্রমাগত অবহেলায় তা একেবারে শুকিয়ে যেতে পারে। এ অবস্থার যাতে সৃষ্টি হতে না পারে, সেদিকে নজর দেওয়াটাই সবচেয়ে ভাল। প্রসবের ১০। ১৫ দিন পর থেকে শুকনো মেদা লকড়ীর ছাল চূর্ণ ১ গ্রাম মাত্রায় দিনে বার (সকালে ও সন্ধ্যায়) আন্দাজ আধ কাপ গরম দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে। আর বিকালের দিকে একবার করে কাঁচা পাতা চটকে খাওয়া উচিত। এভাবে ৫। ৬ মাস করতে পারলে বুকের দুধেও যেমন টান পড়বে না, তেমনি কোন প্রকার পেটের গোলমাল, সাদা স্রাব, দুর্বলতা প্রভৃতি আসতে পারবে না এবং যৌনজীবনে কোন প্রকার অবসাদের সৃষ্টি হবে না। এক্ষেত্রে গাছের ছালের পরিবর্তে মূলের ছাল ব্যবহার করতে পারলে আরো ভাল। না পাওয়া গেলে গাছের ছালই ব্যবহার করা উচিত। পাতা একদিন সংগ্রহ করলে ৫ । ৭ দিন ভালভাবে থাকে। সামান্য সামান্য শুকিয়ে গেলেও ক্ষতি নেই। চটকে খাওয়া চলবে।

৭. মচকানো ব্যথা ও ফোলায়: কাঁচা অথবা শুকনো ছাল, না পেলে পাতা জলে বেঁটে অল্প গরম করার পর ঈষদুষ্ণ অবস্থায় প্রলেপ দিতে হবে। রাত্রিতে প্রলেপ না দেওয়াই উচিত। তবে ঘটনাটি যদি রাত্রে ঘটে, তখন তো কিছু করার নেই, প্রলেপ দিতেই হবে। আর তা না হলে সকালের পর দিয়ে সন্ধ্যার দিকে ফেলে দেওয়াই ভাল। এটি এমনই পিচ্ছিল ও শুকিয়ে গেলে শক্ত হয়ে যায় যে, জোর করে ছাড়াতে গেলে যেখানে লোম আছে, তা ছিঁড়ে গিয়ে নতুন কোন বিপত্তির সৃষ্টি হতে পারে। সেদিকেও নজর দেওয়া উচিত। দু’একদিন প্রলেপ দিলে কমে যাবে।

৮. বাতের ব্যথা ও ফোলায়: উপরিউক্ত পদ্ধতিতে শুকনো ছাল বেঁটে সকালের দিকে প্রলেপ দিয়ে সন্ধ্যার পূর্বে তুলে ফেলতে হবে। এভাবে কয়েকদিন করলে ব্যথা ও ফোলা কমবে ঠিকই, কিন্তু সেটিকে চিরস্থায়ী করতে হলে প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র খেতে হবে। তা না হলে এর দ্বারা ব্যথা-ফোলা-যন্ত্রণার সাময়িক উপশম হবে মাত্র ।

আরো পড়ুন:  দেশি গোবুরা এশিয়ার ভেষজ গুণসম্পন্ন বর্ষজীবী বীরুৎ

৯. বৃশ্চিক-বোলতা প্রভৃতির হুলের জ্বালায়: সঙ্গে সঙ্গে কাঁচা অথবা শুকনো ছাল অল্প গরম করে বসিয়ে দিন, কিছুক্ষণ পরেই যন্ত্রণা চলে যায়, স্থানটি ফুলে গেলে তা জাতে থাকে, আর বাড়তে পারে না। শুকনো ছাল বাজারে পাওয়া যায়, তার সামান্য একটু সংগ্রহ করে বাড়িতে রেখে দিলে কাজেই না লাগতে পারে তাহলে ছালগুলিকে ভালভাবে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে মুখবন্ধ শুকনো পাত্রে রেখে দিতে হবে। প্রয়োজনমত গুঁড়ো করে নিলেই চলবে ।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্র:

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, সপ্তম মুদ্রণ ১৪২৬, পৃষ্ঠা, ১৭৩-১৭৪।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি flowersofindia.net থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Thingnam Girija

Leave a Comment

error: Content is protected !!