সাদা তুঁত গাছের নানাবিধ ভেষজ প্রয়োগের বিবরণ

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে এটির আদি জন্মস্থান চীন দেশ। বর্তমানে ভারতের বহু প্রদেশে, বিশেষতঃ উত্তর ভারত, সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গে রেশম পোকার খাদ্যের জন্য চাষ করা হয়।

সাদা তুঁত-এর পরিচয়:

সাদা তুঁত মাঝারি ধরনের গাছ, লম্বায় ১০ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। গাছের ছাল ধূসর রঙের, কাঠ খুব একটা শক্ত না হলেও নানাবিধ খেলার সরঞ্জাম ও গৃহাদি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পাতা ২-৫ ইঞ্চি লম্বা, ডিম্বাকৃতি। শীতকালে ফুল, পরে ফল। ফল লম্বা, গায়ে সরু কাঁটা থাকে, পাকে বসন্তকালে।

অন্যান্য নাম:

একে সংস্কৃতে তূত, তূঁদ; বাংলায় তূত, তূঁত; হিন্দীতে তূরী, সাহুড় বলে। এর বোটানিক্যাল নাম Morus alba Linn, পূর্বে এটির নাম ছিল Morus indica Linn., Morus atropurpurea Roxb, ; তবে এই দুটিকে অনেকেই alba-এর varieties বলেও মনে করেন। ফ্যামিলী Moraceae. আর একটি প্রজাতির নাম Morus laevigata, এটি আসাম, সিকিম প্রভৃতি স্থানে অধিক জন্মে । এর কাঠ খুব শক্ত, গৃহাদি, আসবাবপত্র ও খেলার সাজ-সরঞ্জাম নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হয়।

প্রকারভেদ:

সমগ্র বিশ্বে এই গণের ১২টি প্রজাতি আছে, তার মধ্যে মাত্র ৪/৫টি ভারতে পাওয়া যায়। এই প্রজাতিগুলির প্রায় সবগুলির পাতা রেশম পোকার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তবে alba প্রজাতিটিকে রেশম পোকারা একটু বেশি পছন্দ করে। সমস্ত প্রজাতির ফল পাকলে সুস্বাদু হয় এবং খাদ্য হিসেবে ব্যবহার্য। ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ—পাতা, ফল, মূল ও ছাল।

সাদা তুঁত-এর ব্যবহার

১. গলরোগ: মুখে ও গলায় প্রদাহ, এটি নানা কারণে হতে পারে, বিশেষতঃ যাঁরা ধূমপান করেন বা নস্যি নিয়ে থাকেন বা জদা পান খেতে অভ্যস্ত, তাঁরা এতে সহজে আক্রান্ত হন। এছাড়া ধোঁয়া ও ধুলোর মধ্যে কাজ করলে, অধিক কথা বললে প্রদাহ হতে পারে, কোন ক্ষেত্রে ঘায়ের সৃষ্টিও হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রের চিকিৎসায় অবহেলা করলে বিপদের ঝুঁকি থেকে যায়। তাই প্রথমাবস্থায় ভালভাবে চিকিৎসা আরম্ভ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে গাছের ছাল ১০ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে, ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে সেটিকে সকালে ও বৈকালে দু’বারে খেতে হবে। এই সঙ্গে তুঁত পাতা সিদ্ধ জলে দিনে ২ বার করে গার্গল করতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে অসুবিধেটা চলে যাবে, তবে যে কারণে হচ্ছে তা থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। ফেরিনজাইটিস ও টনসিলাইটিসে এভাবে ব্যবহার করলে ভাল ফল হয়। গার্গল করার জন্য সাদা তুঁত পাতা ৮/১০টি নিয়ে ২ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে ব্যবহার করতে হবে।

আরো পড়ুন:  পুষ্কর মূল গুল্মের সাতটি ভেষজ গুণাগুণ

২. বারোমেসে সর্দিতে: সর্দি, তা সে কি গ্রীষ্ম, কি শীত আর কি বর্ষা, সর্বদা লেগেই আছে, সেই সঙ্গে কারো কারো আবার আমাশার ধাত, কারুর আবার একটুতেই হাঁপ ধরে, অথচ হাঁপানির রোগীও নয় এবং হার্টের রোগীও নয়, এক্ষেত্রে গাছের ছাল ও পাতা সমানভাগে মোট ১০ গ্রাম নিয়ে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে, সেটিকে সকালে ও বৈকালে ২ বারে খেতে হবে। সেই সঙ্গে অধিক ঠাণ্ডা জিনিস খাওয়া ও ব্যবহার করা চলবে না এবং ঈষদুষ্ণ জলে কিছুদিন স্নানও করতে হবে। কিছুদিন করতে পারলে দীর্ঘদিনের এই ঝামেলার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। প্রথম ৫/৭ দিন প্রত্যহ ব্যবহার করার পর আরও কিছুদিন একদিন অন্তর ব্যবহার করলেই হবে ।

৩. স্বরভঙ্গে: প্রচলিত কথায় গলাবসা বা গলাভাঙ্গা। এটি সাধারণতঃ ঠাণ্ডা লাগলে, ঠাণ্ডা দ্রব্য ব্যবহার করলে, সর্দি-কাসি হলে, বৃষ্টিতে ভিজলে, রাত্রি জাগরণে ও বেশি চেঁচালে হয়ে থাকে। তবে অন্য কোন রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা দিলে প্রথমে সেই রোগটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে এবং আনুষঙ্গিকভাবে গলাবসার চিকিৎসা চলবে। সাধারণভাবে গলাবসা দেখা দিলে ৮/১০টি তুঁত পাতা ২ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে, হালকা গরম অবস্থায় কুল্লি (গার্গল) করতে হবে। ২/৩ দিন সকালে ও বৈকালে দু’বার করতে হবে, পরে খুব প্রয়োজন হলে প্রত্যহ একবার আরও কয়েকদিন ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্য রোগের সঙ্গে গলাবসা দেখা দিলে এই মুষ্টিযোগটি ব্যবহার করা চলে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করাই বিধেয়।

৪. পিপাসায়: নানা অবস্থায় নানা কারণে পিপাসা দেখা দেয়। গরমের দিনে। তাপমাত্রা অধিক হলে শরীরের জলীয়াংশ বেশি পরিমাণে নষ্ট হয় এবং ঘন ঘন জল খাওয়ার ইচ্ছা জাগে, তখন জল খেলেও এমন-কি শরবত খেলেও পিপাসার নিবৃত্তি হয় না বহু ক্ষেত্রেই, অথচ পেটটি জয়ঢাক হতে থাকে। আবার এও ঠিক যে মধুমেহ বা অম্লপিত্তে আক্রান্তও নয়। এই যে ক্ষেত্র এক্ষেত্রে পাকা তুঁত ফলের রস ২/৩ চা-চামচ মাত্রায় ২/৩ ঘণ্টা অন্তর ৩/৪ বার খেলেই পিপাসার নিবৃত্তি হবে।

আরো পড়ুন:  দেশি কচুয়া পূর্ব এশিয়ায় জন্মানো চিরহরিৎ বৃক্ষ

৫. অগ্নিমান্দ্যে: ক্ষুধা নাই বললেই চলে, ইচ্ছা জাগে, কিন্তু বসে উঠে পড়তে হয়; পরীক্ষা করে দেখা গেছে উদরে কোন প্রকার ক্রিমিরও উপদ্রব নেই, লিভারের অবস্থা মোটামুটি ভালোই, এক্ষেত্রে ঘাটতি হচ্ছে হজমকারক রসের। যার ফলে দেহে দাহ বা জ্বালা-জ্বালা ভাব অনুভূত হয়, দিনকে দিন শরীরের বল কমতে থাকে, পেটে বায়ু জমে, কোষ্ঠবদ্ধতা দেখা দেয়; পরে মনে এক প্রকার ভীতির সঞ্চার হয়; এই যে ক্ষেত্র, এক্ষেত্রে পাকা তুঁত ফলের রস ২/৩ চা-চামচ মাত্রায় সকালে খালি পেটে একবার এবং বৈকালে গার খেতে হবে। ৮/১০ দিন খেলে উপকারটা উপলব্ধি করতে পারবেন, তবে মাসখানিক খাওয়া প্রয়োজন। এটির ব্যবহারে একসঙ্গে সব দোষগুলোই চলে যাবে এবং স্বাভাবিক সুস্থ জীবন ফিরে আসা সম্ভব হবে।

৬. সন্ধিবাতে: গাঁটে গাঁটে ব্যথা, ফোলা নেই, সেক্ষেত্রে অন্যান্য ঔষধ সেবনের সঙ্গে যদি তুঁত পাতা বেটে গরম করে ব্যথিত স্থানে প্রলেপ দেন, তাহলে সত্বর উপকার পাওয়া যায়। পাতার পরিমাণ প্রয়োজন অনুসারেই হবে। প্রলেপ একটু পুরু করে দেওয়া প্রয়োজন। দিনের বেলায় প্রলেপ দিয়ে সন্ধ্যার পূর্বে ফেলে দিতে হবে। সাধারণতঃ যেসব পা ব্যথা, যন্ত্রণা দেখা যায়, তাতেও এ যোগটি চমৎকার কাজ করে। তবে ৫/৭ দিন তার করতেই হবে।

CHEMICAL COMPOSITION

Morus indica Linn.

Leaves contain: Crude protein 16-39%, soluble sugars 7.6-26%, calcium 0.7.2.7%, iron 0.05-0.12%, terpenes (citral, linalyl acetate, linalol, terpinyl acetate, hexanol, B-sitosterol), glutathione, vitamins (Vitamin-B1, vitamin-D, vitamin-C, folic acid, folinic acid, carotene), protamin, diamino acids and monoamino acids (arginine 0.89%, histidine 0.49%, lysine 0.35%, cystine 0.01%, phenyl alanine, leucine, valine, tyrosine, proline, alanine, glutamic acid, glycine, serine, apertic acid, threonine, sarcosine, y-amino butyric acid, pipecolic acid and 5-hydroxy pipecolic acid), volatile substance (n-butanol, B-yhexanol, methyl-ethyl acetaldehyde, n-butylaldehyde, Taobutylaldehyde, valeraldehyde, hexaldehyde, a-3-hexanal, acetone, methyl ethyl ketone, methyl hexyl ketone, butylamine, acetic, propionic and isobutyric acid), calcium malate, succinic and tartaric neid, xanthophyll, isoquencitrin, adenine, choline, trigonelline and Tannins. Fruits contain: moisture 87.5%, protein 1.5%, fat 0.4% carbohydrates 16.3%, fibre 1.4%, mineral matter 0.9%, calcium 80 mg. phosphorous 40 me iron 1.9%, carotene (as vitamin-A), thiamine, nicotinic acid, riboflavin, ascorbic acid and a flavonoid (eriodictyol). feed contains: Yellow drying oil 25-35%, fatty acids. Wood contains: morin, maclurin, 2,4,6,4′-tetrahydroxy benzophenone, 1.4.3, 5′-tetrahydroxy stilbene, dihydromorin, dihydrokaempferol,

আরো পড়ুন:  কুকুরশোঁকা দক্ষিণ এশিয়ায় জন্মানো ভেষজ বিরুৎ

hydroquercetin and tannin 32%. Dark contains: steroidal sapogenine and c-amyrine. Hoot contains: anthelmintic and astringent substances.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৯, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৫, পৃষ্ঠা, ৯৪-৯৭।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: LazareJean-Pol GRANDMONT

Leave a Comment

error: Content is protected !!