মায়াফল গাছ-এর তেরটি ভেষজ গুণাগুণ

মায়াফল-গুলি ( Quercus infcctoria) ছিদ্রহীন হলেই ভাল, তা না পাওয়া গেলে ছিদ্রযুক্তগুলি নিতেই হবে । আবার মিশ্রিতও নেওয়া চলে। ওগুলিকে ভালভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে গুঁড়ো করার পর ছেঁকে নিয়ে দুইভাগে ভাগ করতে পারলে ভাল হয়। যেমন–মিহিচূর্ণকে একটি শুষ্ক পাত্রে রাখতে হবে এবং ছাঁকার পর মোটা সিটে অংশগুলিকে ফেলে না দিয়ে সেগুলিকেও সংরক্ষণ করা উচিত, কারণ এগুলিকে সিদ্ধ করলে যে ক্বাথ বেরোবে, তা দিয়ে গার্গল প্রভৃতি করা যাবে। এবারে কিভাবে ব্যবহার করবেন, সেটাই লক্ষ করুন।

মায়াফল-এর ভেষজ ব্যবহার

১. পুরাতন অতিসারে: দীর্ঘদিন ধরে পাতলা দাস্ত হতে থাকলে শরীর দুর্বল হতে থাকে এবং সেইসঙ্গে পাকস্থলী থেকে পায়ু পর্যন্ত এই দীর্ঘ পথের কোথায় যে কি বিপত্তির সৃষ্টিও হতে পারে। পাতলা দাস্ত ১০। ১৫ দিন ধরে চলতে থাকলে এবং প্রচলিত ঔষধ ব্যবহারে না ভাল হলে তখন এই যোগটি ১০। ১৫ দিন ব্যবহার করে দেখতে পারেন। শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এটি একটি নিরাপদ ঔষধ। এক্ষেত্রে বয়সানুপাতে ১০০ মিলিগ্রাম থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় মায়াফলের মিহিচূর্ণ মধু অথবা জলসহ সকালে একবার এবং ঐ মাত্রায় বিকালে একবার খেলে উপকার পাওয়া যাবে।

২. প্রবাহিকায়: আমাশা হলেই সেটি যাতে সপ্তাহখানিকের মধ্যে একেবারে চলে যায়, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। রোগটি সামান্য হলেও দীর্ঘদিন শরীরে বসবাস করতে দিলে এটিই বিরাট সমস্যায় ফেলে দিতে পারে। এক্ষেত্রে মায়াফলচূর্ণ পূর্বোক্ত মাত্রায় ও সহপানে ১০। ১৫ দিন ব্যবহার করলে উপকার পাবেন। প্রয়োজনে একবার করে আরও কিছুদিন খেলে ভাল হয়।

৩. অর্শে বা রক্তার্শে: অর্শের বলি থেকে যে সর্বদা রক্ত পড়বে, তা ঠিক নয়। কারো আবার বলি ভেতরে থাকার জন্য বাইরে থেকে দেখা যায় না, কেবল মাঝে মাঝে রক্তস্রাব হয়। এক্ষেত্রে ২৫০ মিলিগ্রাম মাত্রায় মায়াফল চূর্ণ সকালে ও সন্ধ্যায় দু’বার খাওয়া প্রয়োজন। এর দ্বারা রক্তস্রাবটা কমবে। আর এই চূর্ণ সামান্য জলে গুলে মলমের মত করে দিনে ২। ৩ বার বলিতে লাগালে বলিটা ধীরে ধীরে চুপসে যাবে। যে ক্ষেত্রে বলি আছে, অথচ রক্ত পড়ছে না, সেক্ষেত্রে ঔষধটি খাওয়া ও লাগানো দুটোই করা উচিত। আর যখন কেবল রক্ত পড়ে, কোন বলি বাইরে বেরিয়ে নেই, তখন কেবল ঔষধটি খেতে হবে । এমতাবস্থায় ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করা এবং লঘু ও সহজপাচ্য আহার গ্রহণ একান্তই বাঞ্ছনীয় ।

৪. প্রদরে: শ্বেতপ্রদর কিংবা রক্তপ্রদর যেটাই হোক না কেন, সবক্ষেত্রেই মায়াফল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে কোনো কোনো অবস্থায় কিভাবে কি করলে ভাল হবে, তা অতি সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করা হলও। শ্বেতপ্রদর বা সাদা স্রাবের ইতিহাসটা রক্তপ্রদরের সঙ্গে মেলে না। তাই রক্তপ্রদর অর্থাৎ অত্যধিক কিংবা মাঝে মাঝে যোনিদ্বার দিয়ে নিয়ম-বহির্ভূত রক্তস্রাব হতে থাকলে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চিকিৎসা শুরু করাই মঙ্গল। নিম্নোক্ত যোগগুলি এক্ষেত্রে কখন ব্যবহার করতে পারেন, সেটাই শুনুন। যখন তখন মাসিক স্রাব হচ্ছে, কোন মাসে ২ বার, কোন মাসে হচ্ছে তো হচ্ছেই, ১০। ১৫ দিনেও থামছে না, বয়সটা চল্লিশের কাছাকাছি, স্তনে ভারবোধ ও ব্যথা, তখন ধারাবাহিক পরীক্ষা করাতে থাকুন এবং সেইসঙ্গে এই ঔষধটিও ব্যবহার করুন। আর যদি তেমন কোন দোষ ধরা পড়লো না, তাহলে ২। ৩ মাস ধরে এটি ব্যবহার করাই শ্রেয়। শ্বেতপ্রদর বা সাদা স্রাব নানা অবস্থায় নানা কারণে আসে, দীর্ঘদিনের হলে যোনি দেশে কিংবা জরায়ুগাত্রে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এটা প্রথম প্রথম ক্ষতিকর না হলেও অধিক হলে বড়ই অস্বস্তিকর, পরের দিকে কোন কোন অবস্থায় বিপদেরও সৃষ্টি করে। এই সাদাস্রাবের ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম অন্য ঔষধ ব্যবহার করে যখন ফল বিশেষ পাওয়া যায় না, কিংবা সাময়িকভাবে পাওয়া যায়, তখন এই ঔষধটি ২। ৩ মাস ধরে লাগাতার ব্যবহার করতে পারেন। দীর্ঘদিনের জন্য সুফল পেতে চাইলে কতকগুলি নিয়ম মেনে চলতে হবে, তা হলো— খিটখিটে মেজাজ ও দুশ্চিন্তা, অত্যধিক যৌনজীবনযাপন অথবা যৌনজীবন যাপনের কোন অসুবিধা না থাকা সত্ত্বেও তা থেকে দূরে থাকা, খুব তেল-ঘি-চর্বি জাতীয় ও মুখরোচক ভাজাভুজি, ফুচকা প্রভৃতি খাওয়া, পুকুরে কোমর অবধি নেমে বা কোমর ডুবিয়ে বসে স্নান করা, নিয়মিত যৌনাঙ্গ পরিষ্কার না করা, অধিক দৌড়-ঝাঁপ করা প্রভৃতি থেকে দূরে থাকা অর্থাৎ এগুলি ত্যাগ করা। রক্তপ্রদরের ক্ষেত্রেও এগুলি মেনে চলা উচিত, বিশেষতঃ চিকিৎসা চলাকালীন কড়াকড়িভাবে। মায়াফল ব্যবহার করার নিয়ম-

আরো পড়ুন:  কালমেঘ-এর ভেষজ গুণাগুণ ও ঘরোয়াভাবে প্রয়োগ পদ্ধতির বর্ণনা

(ক) মায়াফলের মিহিচূর্ণ ২৫০-৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় ( রোগের প্রাবল্য অনুযায়ী মাত্রা কম-বেশি করে নিলে চলবে, তাতে একটু বেশি হলেও ক্ষতি নেই) সকালে জলযোগের পর একবার এবং এভাবে বিকালে একবার খেতে হবে। এই চূর্ণটি খেয়ে ঠাণ্ডা জল খেতে পারেন, অথবা এটিকে মধু কিংবা দুধের সঙ্গে মিশিয়েও খেতে পারেন।

(খ) মায়াফলের মিহিচূর্ণ করার সময় যে পরিত্যক্ত মোটা দানাগুলি বা সিটোগুলি পড়ে থাকে, সেগুলি নিতে পারেন, অথবা গোটা মায়াফল নিয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করেও নেওয়া যাবে, সেটির পরিমাণ হবে ৫ গ্রাম এবং তাতে কাপ তিনেক জল দিয়ে ফোটাতে ফোটাতে আন্দাজ কাপখানিক থাকতে নামিয়ে, খুব ভালভাবে ছেঁকে, হালকা গরম গরম অবস্থায় সেটির দ্বারা ডুসের সাহায্যে যোনি গহ্বরটিকে ধুয়ে ফেলতে হবে। ঐ সময় পরিষ্কার ন্যাকড়া বা তুলোয় করে ঐ ক্বাথ খানিকটা নিয়ে যোনিগা ভালভাবে মুছে ফেলা উচিত। এটি ঠিক স্নানের পর করতে পারলে ঝামেলা অনেকটা কমে। প্রয়োজনে আর একবার রাত্রে শোয়ার সময় নেওয়া যেতে পারে। যেক্ষেত্রে ডুস দেবার ততটা প্রয়োজন নেই, সেক্ষেত্রে ঐ ক্বাথে ন্যাকড়া বা তুলো ভিজিয়ে তা দিয়ে যতটা সম্ভব যোনিদেশ পরিষ্কার করে নিলে চলবে।

৫. যোনিশৈথিল্যে: অধিক সন্তানের জননী হলে কিংবা সঠিক পদ্ধতিতে সন্তান প্রসব না করাতে পারলে, অথবা বেশ কয়েকবার গর্ভপাত করালে, তাছাড়া বয়স চল্লিশের ওপারে চলে গেলে স্বাভাবিকভাবে এ শিথিলতা এসে থাকে। এক্ষেত্রে পূর্বলিখিত উপায়ে মায়াফল চূর্ণ ২৫০ মিলিগ্রাম মাত্রায় দিনে ২ বার খেতে হবে এবং ঐ দিয়ে প্রস্তুত হালকা গরম ক্বাথ দিয়ে প্রথম মাসখানিক দু’বার, তারপরের মাস দুই কেবল রাত্রে শোয়ার সময় একবার এবং এরপর সপ্তাহে ২। ৩ বার ক’রে আরও কিছুদিন যোনিগহ্বরে ডুস দিতে হবে। এর দ্বারা হারিয়ে যাওয়া দিনের তৃপ্তি ফিরে না পেলেও মনের শান্তি বিঘ্নিত হবে না।

আরো পড়ুন:  বড় ছাতিম এশিয়ার চিরহরিৎ, পর্ণমোচী বনাঞ্চলে জন্মানো ঔষধি বৃক্ষ

৬. গুদভ্রংশে: এটিতে শিশুরাই অধিক আক্রান্ত হয়। অত্যধিক অতিসারে ও প্রবাহিকায় ভুগতে ভুগতে গুদনলিকা (anus) পায়খানা করার পর নেমে পড়ে। এর পর যখন আমাশা বা অতিসার থাকে না, তখন কোঁত দিয়ে দাস্ত করতে গেলে ওটা বেরিয়ে আসে। কোন কোন সময় সেটিকে ভেতরে ঢোকানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার নিজের অথবা মায়ের নখের দ্বারা ছিড়ে গিয়ে রক্তপাত ঘটতে পারে। এমতাবস্থায় ১০০ মিলিগ্রাম (শিশুদের জন্য) মাত্রায় মায়াফল চূর্ণ মধুসহ দিনে ২ বার খেতে হবে এবং ঐ চূর্ণ জলে গুলে গুহ্যদেশে পাতলা করে লাগাতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।

৭. মুখের ক্ষতে: মায়াফলের মিহিচূর্ণ ২৫০ মিলিগ্রাম মাত্রায় দু’বেলা মধুসহ খেতে হবে এবং মায়াফলের ক্বাথ হালকা গরম অবস্থায় নিয়ে প্রত্যহ দু’বার গার্গল করতে হবে।

৮. টনসিলের প্রদাহে: এক্ষেত্রে মায়াফল চূর্ণ দু’বেলা মধুসহ কিংবা জলসহ খাওয়া এবং ঐ ফলের ঈষদুষ্ণ ক্বাথ দিয়ে গার্গল করা উচিত।

৯. স্তনবৃত্তের ফাটা দাগে: মায়াফলের মিহিচূর্ণ ফুটন্ত গরম জলকে ঠাণ্ডা করে সেই জল দিয়ে মলমের মত গুলে স্তনের বোঁটায় সকালের দিকে একবার এবং দুপুরের দিকে একবার লাগাতে হবে। যেসব মায়েদেরকে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে হয়, তারাও এটি ব্যবহার করতে পারেন। দুধ খাওয়াবার সময় ঝেড়ে ফেলে দিলেই হবে, কারণ ওটি শিশুর পেটে গেলে কোন ক্ষতি নেই, বরং বলকর এবং হঠাৎ করে শিশু কফ-কাসিতে আক্রান্ত হবে না। দুধ খাওয়ানোর পর পুনরায় একটু লাগিয়ে নেবেন। এভাবে ৪। ৫ দিন করলেই উপকার পাবেন। তবে দাঁতওয়ালা শিশু থেকে সাবধান, ওরা বোঁটা কাটার তালে থাকে।

১০. খোস-পাঁচড়া-একজিমায়: মায়াফলের মিহিচূর্ণ জলে গুলে প্রত্যহ দুইবার করে লাগালে উপকার পাবেন।

১১. ক্ষতে: তা সে তাজাই হোক কিংবা পুরাতন হোক, মায়াফলের ক্বাথ গরম থাকা অবস্থায় ঘা ধুয়ে তারপর ওরই মিহিচূর্ণ তার উপর ছড়িয়ে দিতে হবে।

আরো পড়ুন:  কালকেয়া বা কেলেওকড়া উদ্ভিদের সাতটি ভেষজ গুণাগুণ

১২. শ্বাস-কাসে: শিশুদের বেলায় ৫০-১০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় এবং বয়স্কদের জন্য ২৫০–৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় দিনে ২ বার করে মায়াফলের মিহিচূর্ণ মধু, দুধ কিংবা জলসহ খাওয়াতে হবে। যেক্ষেত্রে গার্গল করা সম্ভব হবে, সেক্ষেত্রে তা অবশ্যই করা উচিত। কফ বসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে মধু ব্যবহার না করে দুধ কিংবা জল ব্যবহারই শ্রেয়।

১৩. দাঁত নড়ায়: যেকোনো গুঁড়ো মাজনের সঙ্গে মিশিয়ে (মাজন ৩ ভাগ ও মায়াফলের মিহিচূর্ণ ১ ভাগ) প্রত্যহ ২ বার করে দাঁত মাজলে নড়া দাঁত বসে যায়। তাছাড়া মাঢ়ী বা মাড়ি সুস্থ থাকে। অবশ্য দাঁতে অল্প একটু কালো ছোপ ধরার সম্ভাবনা আছে, তার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। সেক্ষেত্রে মাজনের মাত্রা বাড়িয়ে মায়াফলের মাত্রা কমাতে হয় ।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্র:

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, সপ্তম মুদ্রণ ১৪২৬, পৃষ্ঠা, ২০৯-২১০।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Krzysztof Ziarnek, Kenraiz

Leave a Comment

error: Content is protected !!