শাল গাছের ১৮ টি ভেষজ গুণাগুণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি

শাল গাছ সরল ও খুব লম্বা, এতে শাখা-প্রশাখা খুব কম হয়। ছোট গাছের ছাল মসণ; কিন্তু বড় গাছের ছাল ফাটা ফাটা, পরে ১-২ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। পাতা লম্বায় ৬-১০ ইঞ্চি, চওড়ায় ৪-৬ ইঞ্চি, আকারে আয়তাকার এবং পাতার গোড়ার দিকটা ডিম্বাকৃতি, অগ্রভাগ ক্রমশ সরু। শাল গাছের কাঠ খুবই মজবুত, এটি ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র তৈরীর কাজে তো লাগেই, এছাড়া মজবুত ও ভারি কাঠের যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই শালকে আমাদের প্রয়োজন। এজন্য জঙ্গলের পর জঙ্গল মানুষের প্রয়োজনে শেষ হয়ে যায়। তাই সরকারী প্রচেষ্টায় এখন এর চাষ হচ্ছে। ফুলগুলি নরম, রোমশ ও শ্বেতবর্ণের পাপড়ি হলদে আভাযুক্ত। সাধারণতঃ বসন্তের প্রারম্ভে গাছ পত্রহীন হয়, তারপর যখন নতুন পাতা গজাতে শুরু করে, ঠিক সেই সময় গাছে ফুল আসে, আকারে অনেকটা ঝুমকোর মত। সাদা ফুল, পাপড়িগুলো হলদে আঠাযুক্ত, তাই সমগ্র ফলটাকে শ্বেতবর্ণ না ব’লে হরিদ্রাভ-শ্বেত বর্ণের বললে বোধ হয় ঠিক হবে। তারপর ফল হয়, বর্ষার প্রারম্ভে পাকতে শুরু করে। ফলগলি আকারে ছোট, লম্বায় ২ ইঞ্চির বেশী হয় না। গাছের আঠাকে ধনা বলা হয়, ধনা আগনে ফেললে যে ধোঁয়া বেরোয়, তা জীবাণুনাশক ও সুগন্ধযুক্ত।

শালের গাছ হিমালয় পাহাড়, আসাম, ছোটনাগপুর, উত্তরবঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাংশ, পাঞ্জাব, খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া পাহাড়, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, বিশাখাপত্তনম প্রভৃতির জঙ্গলে এবং ৫০০০ ফট উচু পর্যন্ত স্থানেও জন্মে। বর্তমানে ঐসব জঙ্গলে এবং নতুন তৈরী জঙ্গলে সরকারী প্রচেষ্টায় শালগাছ লাগানো হচ্ছে। ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ—পত্র ও আঠা।

একে সংস্কৃতে শাল, বাংলায় শাল, শাল গাছ, শাল কাঠ; হিন্দীতে শাল, দামার, সাখ, সাল; উড়িষ্যার অঞ্চল বিশেষে সব্ব, সেকওয়া; বোম্বাই অঞ্চলে রালধনা বলে। ইংরেজীতে এটিকে The Sal tree বলা হয়। এর বোটানিক্যাল নাম Shorea robusta Gaertn. f., পরিবার Dipterocarpaceae.

শাল গাছের উপকারিতা

১. প্রমেহ রোগে: এই সমস্যা দীর্ঘদিনের হয়ে গেলে মধুমেহ, আসাটাই স্বাভাবিক। সুতরাং প্রথমাবস্থায় শাল সার ২০ গ্রাম থেতো করে (কাঁচা হ’লে ভাল হয়) ৫০০ মিলিলিটার জলে সিদ্ধ করার পর ১০০ মিলিলিটার থাকতে নামিয়ে ছেঁকে ওই জলটা দুবেলায় খেতে হবে। এর দ্বারা কয়েকদিনের মধ্যেই ওটার উপশম হবে।

২. মেদো রোগে: এটার সঙ্গে স্থৌল্য রোগের কোন সম্পর্ক নেই। এই মেদো রোগের কারণ থাকে আলু, ঘৃত, তৈল জাতীয় জিনিস ও মিষ্টি কিম্বা শ্বেতসার জাতীয় জিনিসের অত্যধিক সেবা আর তার সঙ্গে কায়িক শ্রমের অভাব। আর স্থৌল্য রোগের কারণ থাকে আমাদের শরীরের মধ্যে যে গ্রন্থি আছে, তারই বিষম বণ্টন ব্যবস্থা —তাতেই আসে স্থৌল্যরোগ। এটির বিশিষ্ট লক্ষণ হলো নিম্নঙ্গ অস্বাভাবিক মোটা, শক্ত ও ভারী হ’তে থাকে। এক্ষেত্রের বক্তব্য, যেখানে মেদ বৃদ্ধি হয়েছে, সেটার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করতে হবে। মোটকথা, যেখানেই দেখা যাবে যে সমভাবেই সর্বাঙ্গ মোটা হয়েছে সেটাই মেদ বৃদ্ধি হয়েছে ধরে নিতে হবে।

আরো পড়ুন:  কাওয়াটুটি বাংলাদেশের পাহাড়িঞ্চলে জন্মানো উপকারী বৃক্ষ

কচি শাল গাছের কাঠ ২৫ গ্রাম (কাঁচা হলে ভাল হয়) বেশ ক’রে থেতো করার পর ৪। ৫ কাপ জলে সিদ্ধ করে আন্দাজ দেড় কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে এটাকে দু’বেলায় খেতে হবে। এইভাবে ২ সপ্তাহ খাওয়ার পর মেদ নিশ্চয়ই কমে যাবে। এর সঙ্গে আহারের দিকটাও মেনে চলতে হবে, অর্থাৎ দুবেলা ভাত, মিষ্টি আলু একেবারে খাওয়া নিষেধ। ভাত একবেলা ও রুটি একবেলা খেতে হবে।

৩. জননেন্দ্রিয়ের রোগে: আয়ুর্বেদিক সংজ্ঞায় একে বলা হয় যোনি রোগ। এরোগ মোটামুটি বিশ প্রকারের। তার মধ্যে যেক্ষেত্রে এটি ব্যবহার্য সেটি হলো, জননেন্দ্রিয়ের মুখের কাছে সাদা সাদা কফের মত এসে জমে; কোন কোন ক্ষেত্রে সরের মতও বিবরের পাশে জমে যায়, আর ভিতরটা সর্বদা পিচ্ছিল থাকে। এটা ক্ষয়মূলক শ্বেতপ্রদর রোগ। এক্ষেত্রে কচি শাল গাছের কাঁচা কাঠ ২৫ গ্রাম ভালভাবে থেতো ক’রে ৪। ৫ কাপ জলে সিদ্ধ করার পর যখন আন্দাজ দেড় কাপ থাকবে তখন নামিয়ে ছেঁকে ঠাণ্ডা হলে ওই জলটা দু’বেলায় খেতে হবে। শুধু তাই নয়, যদি সম্ভব হয় এই হিসেবে আর একটা জল তৈরী করে ছে’কে সেই জলে পিচকারি বা ডুস, নিয়ে ধয়ে দিতে হবে। তাহলে এটা তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।

৪. ক্রিমিতে: ক্রিমির উপদ্রব আছে, শুধু তাই নয়; মাঝে মাঝে মলের সঙ্গেও পড়ে, সেক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে ক্বাথ তৈরী করে বয়সানপাতে মাত্রা ঠিক ক’রে সালে বৈকালে ২ বার খাওয়ালে কয়েকদিনের মধ্যেই ওই উপদ্রব কমে যায়।

৫. ঘর্ম রোগে: যাঁরা পিত্ত-শ্লেষ্মা কিম্বা শ্লেষ্মা-পিত্তের প্রকৃতির লোক, তাঁরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অশোরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এদের দেহটা সাধারণতঃ কৃশ থাকে না। অল্প শ্রমেই ঘাম হয়। গরম সহ্য করতে পারেন না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই এদের হাঁপানি হয়। এইসব লক্ষণের সঙ্গে মিশে গেলে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে কচি শাল গাছের ছাল ২০ গ্রাম ৪। ৫ কাপ জলে সিদ্ধ করে আন্দাজ এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছে’কে ওই জলটা দু’বেলায় খেতে হবে। সপ্তাহ দুইয়ের মধ্যে এর উপকারিতা উপলব্ধি করা যাবে।

পাতার ব্যবহার

৬. প্রমেহ রোগে: শালপাতা (কচি এবং কাঁচা) ২০। ২৫ গ্রাম থেতো করার পর তাকে ৪।৫ কাপ জলে সিদ্ধ ক’রো আন্দাজ এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে সেই জলটা দু’বেলায় খেতে হবে। এটাতেও প্রমেহ রোগের উপশম হয়।

৭. ক্রিমিতে: কচি শালপাতা অল্প জল দিয়ে থেতো করে তার রস ১ চামচ ও তার সঙ্গে একটু, জল মিশিয়ে গরম করে, ঠাণ্ডা হ’লে সেই রসটা খাওয়াতে হবে। তবে বালকদের মাত্রা অর্ধেক।

৮. শিরো রোগে: বায়ুর জন্য মাথার রোগে, প্রায়শঃ বৈকালের দিকে মাথাটা ভারা হয়, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে জ্ব্বরও হয়, মাথা টলে, বুকেও ভার বোধ হয়, সেই সময় ২। ৩টি শালপাতা ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে আন্দাজ এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে ওই ক্বাথটা সকালে বৈকালে দু’বারে খেতে হবে।

আরো পড়ুন:  বন মটমটিয়া দক্ষিণ এশিয়ায় জন্মানো ভেষজ বিরুৎ

৯. রক্তপিত্ত রোগে: এই রোগ প্রবল হ’লে, রক্ত বমন হতে থাকবে। তবে এই রক্ত হঠাৎ বন্ধ করতে নেই, এ সম্বন্ধে চিকিৎসাশাস্ত্রে গভীর আলোচনা করা হয়েছে, সেইজন্য যাতে ধীরে ধীরে বমির বেগ এবং রক্ত ওঠাটা কমে আসে তার জন্য শালপাতা ২০/ ২৫ গ্রাম ৩। ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে আন্দাজ দুই কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে সেই জলটা ৩। ৪ বারে একটু একটু, করে খেতে হয়। এভিন্ন ২ গ্রাম ধুনো গরমজলে (২ কাপ জলে) ৪।৫ ঘন্টা বাদ সেটা ছে’কে সেই জলটা ৩।৪ বারে খেতে হবে। এটাতে রক্তপিত্তের আরাম হয়।

১০. রক্ত আমাশয়ে: এই রোগটি গ্রহণী রোগের প্রথমাবস্থা। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধদের বিপদ বেশী। এক্ষেত্রে ধুনোর মিহি চূর্ণ ২৫০ মিলিগ্রাম মাত্রায় প্রত্যহ দুইবার অথবা তিনবার করে জলসহ খেতে হবে। তবে বালকের মাত্রা অর্ধেক।

১১. অম্লরোগে: চলতি কথায় আমরা একে অম্বলের রোগ বলি। যাঁদের অল্প হয় অথচ বহিঃপ্রকাশ কম, সে রোগকে আমরা “চোরা অম্বল” বলি। এর ফলে অনেকের ঘুসঘুসে জ্বরও হয়, অরুচি হয়, প্রস্রাব কমে যায়, এসবের একটু, লক্ষণ দেখা দিলেই ধুনোর মিহি গুঁড়া ২০০ মিলিগ্রাম প্রত্যহ দু’বার করে ঠাণ্ডা জলসহ খেতে হবে। এর দ্বারা চোরা অম্বল কমে যাবে।

১২. গনোরিয়ায়: এও এক ধরনের শোথ (লিঙ্গমূলে) শুক্রমেহ রোগ, আবার অনেক সময় কোঁৎ দিলে লিঙ্গের অগ্রভাগ থেকে কফের মত কিছুটা নিঃসৃত হয়। ওটা শুক্র নয়। জননগ্রন্থির উত্তেজনায় রসনিঃসরণ। এটা দেখা দিলে বুঝতে হবে অগ্নিমান্দ্য তো আগে হয়েইছে এবং তার সঙ্গে শরীরের কৃশতাও হচ্ছে। ওই সময় প্রত্যহ দু’বেলা একটু, দধি কিম্বা বেদানার রস সহ ২৫০ মিলিগ্রাম ধনোর গড়ে (মিহি) খেতে হবে। এর দ্বারা ওই অসুবিধেটা চ’লে যাবে।

শাল গাছের বাহ্য ব্যবহার (রসক্রিয়া প্রক্রিয়া)

প্রস্তুত বিধি- শালকাঠের সারাংশ কুটে নিতে হবে। তারপর তার ৮ গুণ জলে সিদ্ধ করে সিকি ভাগ (চতুর্থাংশ) থাকতে নামিয়ে ছেকে তাকে মদ , অগ্নিতে বসিয়ে ঘনসার করতে হবে (Solid extract), তারপর তাকে ব্যবহার করার সময় পরিমাণ মত জল মিশিয়ে পাতলা করে নিয়ে ব্যবহার করতে হবে।

১৩. কানের পুজে: অল্প জলে একটুখানি গুলে নিয়ে ফোঁটা দিলে (দিনে একবার) ২।৪ দিনের মধ্যেই কানের পুজ পড়া বন্ধ হয়ে যাবে এবং একেবারে সেরে যাবে।

১৪. ফোড়ায়: কচি শালপাতা বেটে অল্প গরম করে প্রলেপ দিলে পাকিয়ে দেবে, পরে ঐ শালেরই কচি পাতা সেঁকে নিয়ে ফোড়ার মুখের কাছটায় আলগা ভাবে চেপে বেধে রাখতে হবে। এর দ্বারা ভালভাবে পেকে ফেটে যাবে। তারপর ঐ শালেরই কচি কাঠ সিদ্ধ জল দিয়ে ধুয়ে দিলে তাড়াতাড়ি ওটা শুকিয়ে যাবে।

আরো পড়ুন:  দুধকলমি লতার দশটি ভেষজ উপকারিতা ও প্রয়োগ

১৫. ক্ষতে পোকা হলে: ওই কাঠের কাথ দিয়ে ধোয়ালে পোকা আর থাকবে না এবং আর হবেও না।

১৬. কুচকি ফোলায়: এমনকি বাগী হ’লেও কচি শালপাতা বেটে অল্প গরম ক’রে ওখানটায় পুরু করে প্রলেপ দিলে দুই-এক দিনের মধ্যে ব্যথা ও ফুলা দুই-ই কমবে।

১৭. ফোড়া পাকাতে: ঘি অল্প গরম করে তার সঙ্গে ধুনোর মিহি গুঁড়া মিশিয়ে (অল্প পরিমাণে) সেটা মাঝখান ছেড়ে ওপরটায় লাগিয়ে দিলে ওটা দু-এক দিনের মধ্যেই পেকে যাবে, আবার ওই ঘি আরও একটু গরম করে ধুনোটাকে মিশিয়ে (একট, আঠা হবে) পুনরায় প্রলেপ দিলে ফোড়ার পুঁজ বেরিয়ে যাবে।

১৮. চুলকণায়: ১০। ১২টি পাতা দুই লিটার জলে সিদ্ধ ক’রে আদাজ এক লিটার থাকতে নামিয়ে, ছেকে, ওই জলটা সমস্ত শরীরে লাগিয়ে একটু ঘষে দিয়ে। তারপর ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করে ফেলতে হয়। এর দ্বারা গায়ের দুর্গন্ধও চ’লে যায় এবং চুলকণাও সেরে যায়।

CHEMICAL COMPOSITION

Shorea robusta Gaertn. Analysis of wood :— moisture 12.5%; cellulose 44.04%; lignin 32.44%; pentosans 17.50% and ash 0.53%. Analysis of spent bark:– moisture 13.46% cellulose 52.19%; lignin 25.8%; pentosans 15.6%; ash 5.97% and furfural 9.1%, Analysis of heart wood :- Hopeaphenol; lencoanthocyanidine; triterpenoids; a terpene alcohol; a neutral compound and waxy material. Analysis of seeds:— Moisture 5.23%; protein 6.16%; ether extract 16.77; crude fibre 4.81; N-free extract 63.25; calcium 18%; ash 3.78% and fatty oil 19.20%. Fatty oils :– Palmitic; stearic, arachidic; oleic and linoleinc. Bark and leaves contain:-Tannin, resin and essential oil. Analysis of oil:—Homocatechol; monomethyl ether; homocatechol dimethyl ether; oxygenated aromatic compounds; an unidentified phenol and hydrocarbons. Oil cake contains :– Starch 50%; protein 10-12%; threonine 7.8%; arginine 6.8%; histadine 4.8% and lysine 5.7%.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৫, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৩, পৃষ্ঠা, ৩০-৩৪।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: FarEnd2018

Leave a Comment

error: Content is protected !!