বিলুপ্তপ্রায় গাছ: বাজনা
বৈজ্ঞানিক নাম: Zanthoxylum rhetsa (Roxb.) DC.
সমনাম: Zanthoxylum limonella (Dennst.) Alston; Zanthoxylum budrunga (Roxb.) DC.; Zanthoxylum oxyphyllum F.-Vill.; Fagara budrunga Roxb.; Fagara rhetsa Roxb.; Fagara piperita Blanco
বাংলা ও স্থানীয় নাম: বাজনা (ঢাকা ও চট্টগ্রাম), বারনা (পার্বত্য চট্টগ্রাম), বাজরাং (সিলেট), তাম্বল, বাদ্রাং, কাঁটা হরিনা, বাযিনালি ইত্যাদি।
ইংরেজি নাম: Prickly tree ,cape yellowwood, Indian pepper, Indian Ivy-nue.

জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ/রাজ্য: Plantae – Plants
শ্রেণী: Eudicots
উপশ্রেণি: Rosids
বর্গ: Sapindales
পরিবার: Rutaceae
গণ: Zanthoxylum
প্রজাতি: CZanthoxylum rhetsa (Roxb.) DC.
বিবরণ: বাজনা মধ্যম আকৃতির ডালপালা বিশিষ্ট কন্টকযুক্তপাতাঝরা বৃক্ষ,উচ্চতায় ১২-২০মিটার এবং গাছের বেড় ৭৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। বাজনাগাছের সব অংশই সুগন্ধযুক্ত হওয়ায় এটি সুগন্ধি গাছ হিসেবে পরিচিত। এদের গুঁড়ি কাণ্ড সরল, সোজা, গোলাকার এবং প্রধান কান্ডসহ ডালপালার গায়ে বেশ মোটা মজবুত তীক্ষ্ণ বড় বড় কাঁটা বিদ্যমান। বাকল পুরু, মসৃণ, নরম ও হালকা হলদেটে বর্ণের।
বাজনা গাছের পাতা যৌগিক এবং ডালপালার আগায় গুচ্ছাকারে সজ্জিত। পত্রফলক লম্বায় ৩০-৭৫ সেন্টিমিটার এবং পত্রক সংখ্যা ১৬-২৫টি। বিপরীতমুখীভাবে সজ্জিত পত্রকগুলো লম্বায় ৬-১৪ সেন্টিমিটার ও চওড়ায় ১.৫-৩.০ সেন্টিমিটার এবংপাতার কিনারা সামান্য খাঁজকাটা। শীতকালে পাতা ঝরে যায়। পাতায় তীব্র ঝাঁঝালো সুঘ্রাণ রয়েছে। মার্চ-এপ্রিল মাসে গাছে গজানো নতুন পাতার সাথে ডালপালার মাথায় ২৫ সেন্টিমিটার লম্বাটে শাখান্বিত পুষ্পবিন্যাসে থোকায় থোকায় হালকা হলুদ বর্ণের ছোট ফুল ফোটে। গাছে থোকায় থোকায় ছোট গোলাকার ফল ধরে। ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে পরিপক্কফল কমলা বা লালচে-হলুদ বর্ণ ধারণ করে। ফলের মধ্যে কালো বর্ণের শক্ত ধরনের একটি মাত্র বীজ থাকে। প্রতি কেজিতে বীজের সংখ্যা ১৮,০০০-১৯,০০০টি। সাধারণ তাপমাত্রায় বীজের আয়ুষ্কাল ৩০-৬০দিন।
প্রজনন ও বংশবিস্তার: সাধারণত বন এলাকায় বীজজাত চারা দিয়ে বাজনার বংশবিস্তার হয়। নার্সারিতে আগস্ট-সেপ্টেম্বরমাসে সংগৃহীত বীজ পলিব্যাগে বপন করতে হয়। বীজত্বক শক্ত বিধায় বীজ বপনের পূর্বে গরম পানি বা পাতলা এসিডে শোধন করে নিলে বীজ গজানোর হার বৃদ্ধি পায়। চারা গজানো বা বীজের অঙ্কুরোদগমের হার শতকরা প্রায় ৫০-৬০ ভাগ। চারা গজাতে সময় লাগে ১৫-২০দিন।
ভৌগোলিক বিস্তৃতি: বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও পাপুয়া নিউ গিনি। শ্রীলঙ্কায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাজনা গাছের চাষ হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে বিস্তৃতি ও প্রাপ্তিস্থান: চট্টগ্রাম,পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেটের মিশ্র চিরসবুজ বনে এবং ঢাকা, গাজীপুর, টাংগাইল ও ময়ময়নসিংহের পাতাঝরা শাল বনে বিক্ষিপ্তভাবে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো বাজনা গাছ দেখা যায়। এ ছাড়া সাভার, গাজীপুর, জয়দেবপুর, নরসিংদী, মনোহরদী, শিবপুর ও বেলাবো গ্রামাঞ্চলে লাগানো বাজনার গাছ রয়েছে। ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে লাগানো বাজনার কিছু গাছ রয়েছে।
গুরুত্ব ও ব্যবহার: কাঠ হলদে-ধূসর বর্ণের,মাঝারি শক্ত ও সুন্দর পালিশ নেয়ায় সৌখিন আসবাবপত্র তৈরি করা হয়। এ ছাড়া তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধের জন্য গবাদিপশুর হাত থেকে কৃষি ফসল রক্ষার্থে ডালপালা দিয়ে বেড়া প্রদান করা হয়। বাজনা একটি উত্তম ভোজ্যতেল প্রদানকারী বৃক্ষ। এ গাছের বাকল, পাতা, ফুল, ফল ও বীজ – সবই সুগন্ধযুক্ত। এ গাছের বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। পাতায় তৈলগ্রন্থি বা পেলুসিড থাকায় তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ বের হয়। কচি পাতা রান্ন করে এবং বাকল, ফল ও বীজ মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শ্রীলঙ্কাথেকে বাজনার বীজ মসলা হিসেবে চীন ও ইরানে রপ্তানি হয়ে থাকে। অনেকে বাকল রোদে শুকিয়ে কুচি কুচি করে কেটে পানের মসলা হিসেবে খেয়ে থাকেন। বীজে ২১ থেকে ২২ ভাগ ভোজ্য তেল থাকে। তেলের গুণাগুণ সরিষার তেলের মতো। বীজ থেকে সংগৃহীত তেল নানা রকম আয়ুর্বেদ ওষুধ তৈরি করা হয় যা শরীরকে সুস্থ রেখে দেহের তেজ বৃদ্ধি করে। তেল চর্মরোগে উপকারী। গাজীপুর অঞ্চলে বাজনার বীজ ছেঁচে বা গুঁড়ো করে পানির সাথে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে ভাসমান তেল তোলা হয়। সদ্য তেলের স্বাদ ও ঘ্রাণ অনেকটা ঘিয়ের মতো যা গরম ভাতের সাথে খাওয়া হয়। তেল বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না, কটু গন্ধ হয়ে খাওয়ার অনুপযোগী হয়।
সংরক্ষণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ: ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ৮ ও ২২ নম্বর সেকশনে লাগানো বাজনার কিছু গাছ সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।এ ছাড়া আরণ্যক ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এর সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাজনার চারা লাগিয়ে প্রজাতিটিকে সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।