পরিচিতি: ঘোড়া গুলঞ্চ, গুলঞ্চ লতা বা গুড়ুচ (বৈজ্ঞানিক নাম: Tinospora sinensis) হচ্ছে মেনিস্পারমাসি পরিবারের টিনোস্পোরা গণের একটি লতানো সপুষ্পক উদ্ভিদ। এই লতার আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এটি ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ও মায়ানমারে সহজে পাওয়া যায়।
দীর্ঘদিনের হলে খুবই মোটা হয়, এই ঘোড়া গুলঞ্চ লতা আঙ্গুলের মত মোটা হলে, সরু, সুতার মতো শিকড় বেরিয়ে ঝুলতে থাকে (Aerial roots)। লতার গায়ের ছালগুলি কাগজের মতো পাতলা, ভিতরটা যেন একগোছা সুতা দিয়ে পাকানো দড়ি, স্বাদে তিক্ত ও পিচ্ছিল। পাতা দেখতে অনেকটা পানের মতো হলেও সাদৃশ্যে হৃৎপিন্ডাকৃতি, শীতকালে পাতা পড়ে বসন্তে আবার নতুন পাতা বেরোয়। ছোট ছোট হরিদ্রাভ সাদা ফুল; ফল হয় মটরের মতো। সাধারণত এর দুটি প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। একটির বোটানিক্যাল নাম Tinospora sinensis. এই গুলঞ্চকে সাধারণ লোকজন বলে থাকে ‘ঘোড়া গুলঞ্চ’, এটি স্বাদে স্বল্প তিতা। আর একটি প্রজাতি পাওয়া যায়, তার লতাগুলির গায়ে বুটি বুটি দানা হয়, একে বলা হয় ‘পদ্ম গুলঞ্চ’। এই লতাগাছের পাতাগুলি একটু রোমশ এবং আকারে বড়। এই লতার রসে পিচ্ছিলতা অনেক বেশী এবং স্বাদে খুবই তিতা। এই প্রজাতির বোটানিক্যাল নাম Tinospora crispa Miers.
আরো পড়ুনঃ গুলঞ্চ লতার ঔষধি গুণাগুণ
ভারতের প্রায় সর্বত্রই এই দুই প্রজাতির লতা পাওয়া যায়। ঔষধার্থে ব্যবহার হয় পাতা ও সমগ্র লতা। এখানে আর একটা কথা বলা দরকার, আমাদের প্রাচীন বনৌষধির গ্রন্থ রাজনিঘণ্টুতে আর এক প্রকার গুড়চীর উল্লেখ দেখা যায়, তাকে বলা হয়েছে ‘কন্দোৎদ্ভবা’, যার অর্থ হল কন্দো থেকে উৎপত্তি। তারই আরও নাম দেওয়া হয়েছে। ‘পিন্ডামৃতা’, ‘কন্দরোহিণী’, ‘রসায়নী’। এই নামের গুলঞ্চ কিন্তু আমাদের কাছে অপরিচিত হয়েই আছে; অবশ্য আমাদের পূর্বসুরী প্রাচীন বৈদ্যগণেরও ঐ একই প্রতিধ্বনি।
ব্যবহার, আকার-আকৃতি এবং গুণকে কেন্দ্র করে অনেক লতার মত এরও রয়েছে অনেক নাম, তবে তা সোমলতার মত চরম বিভ্রান্তির পর্যায়ে পৌঁছায়নি। মোটামুটিভাবে সারা উপমহাদেশেই একে গুড়ুচ, গুড়ূচী বা গিলোয় নামে চিহ্নিত করা হয়। পৌরাণিক কাহিনীতে গিলোয়কে মনে করা হয় স্বর্গের আরক যা খেয়ে দেবদেবীরা তাদের যৌবন অক্ষুণ্ণ রাখেন। এর অভূত গুণ বিচার করে একে অমৃতবল্লী বলা হয়েছে হিন্দি-সংস্কৃতে। বাংলায় একে গুলঞ্চ বলে যা হয়ত গুড়ুচ শব্দ থেকেই এসেছে। পদ্ম গুলঞ্চ পাহাড়ে, বাংলাদেশের পার্বত্য চটগ্রামের দিকে বেশি দেখা যায়।
প্রাচীন বাংলায় গুড় শব্দটির অর্থ আত্মরক্ষণ। এই লতা আত্মরক্ষা করতে পারে। আঙ্গুলের সমান মোটা কাণ্ড হলে এর সন্ধি থেকে সুতোর মত এক ধরণের ঝুরি নামে। ঝুরিসহ এই লতা কেটে এনে ঘরে রাখলে এটা দীর্ঘিদিন বেঁচে থাকতে পারে। প্রথমে লতাটি এর ঝুরি থেকে একটু একটু করে রস খেয়ে বেঁচে থাকে এরপর শুকোতে থাকে বেশ ধীর গতিতে।
ঘোড়া গুলঞ্চ লতা গাছের ঝুরি বেশ শক্ত এবং সূক্ষ্ম যে কারণে প্রাচীনকালে এক সময় সেলাইয়ের কাজে ক্যাটগাটের মত এর ব্যবহার হয়েছে সার্জারিতে। এর কাণ্ড ছিন্ন করে নতুন গাছ জন্মানো যায় বলে এর এক নাম ছিন্নরুহা। তিব্বতে এর চাষ করা হয় কাণ্ডকে ছিন্ন করে। ফসল তোলা হয় গ্রীষ্মে ও বসন্তে। বসন্তে এর কার্যকরি তিক্ততা বেশি থাকে আর বসন্তে বা শিশির মৌসুমে এর উৎপাদন হয় সবচে বেশি। এর ফুল হয় শাদাটে, ফল হয় মটর আকারের, পাকলে কমলা-লাল হয়ে ওঠে। লতার ছাল খুব পাতলা, নখ দিয়ে সহজে আঁচড়ে নিলে এর ভেতর থেকে বের হয়ে পড়ে পেঁচানো দড়ির মত কাণ্ড। এই কাণ্ডকে টুকরো করে কেটে পাউডার তৈরি করা হয় যা ব্যবহৃত হয় ট্যাবলেট এবং ক্যাপসিউল হিশেবে। কাণ্ড এবং শেকড় থেকে তৈরি রসায়ন ছাড়াও গুলঞ্চ রস থেকে ঘৃত এবং তেল উদ্ধার করা যায়। পাকা আমের রস থেকে আমসত্ত্ব তৈরি হয়, গুলঞ্চ লতার সবুজ কাণ্ডের রস থেকে তৈরি করা যায় গুলঞ্চসত্ত্ব যা নানবিধ চিকিৎসায় কাজে লাগে।
ব্যবহার: গুলঞ্চের ব্যবহারের কোনো শেষ নেই। ম্যালেরিয়া, ভাইরাস, শ্বাসরোগ, বসন্ত, জন্ডিস, ডায়াবেটিস, রক্তস্বল্পতা, জ্বালাপোড়া, বাতব্যাধি, শূলব্যথা, অর্শ, ডায়েরিয়া, আমাশয়, যকৃৎব্যাধি, পিত্তবমন, মস্তিষ্কের রোগ, প্রমেহ, মেদবৃদ্ধি, উচ্চচাপ, কৃমি, হৃদরোগ, ক্যান্সার প্রভৃতি কিছু রোগের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে, কিছু রয়েছে গবেষণাধীন। ভারত ও তিব্বতের মত মালয়েশিয়াতেও গুলঞ্চ থেকে তৈরি কিছু ওষুধ বাজারজাত করা হয়েছে।
গুলঞ্চ লতা শুধু আমাদের এই উপমহাদেশ নয়, সারা পৃথিবীর জন্যেই রোগ নিরাময়ে এক আশীর্বাদ স্বরূপ। এর সুষ্ঠু চাষাবাদ নিয়ে পরিকল্পনা এখন থেকেই করা প্রয়োজন বলে মনে হয়।
বি. দ্র: উদ্ভিদের ঔষধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ১৬৭-১৭১।
২. ফেসবুক গ্রুপ বৃক্ষকথার জায়েদ ফরিদ-এর লেখা থেকে
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।