পরিচিতি: শৃঙ্গাটকের ভাষানাম পানিফল। পানিতেই ফল হয় বলে এর নাম পানিফল; যদিও দক্ষিণ ভারত ছাড়া সব ভারতীয় ভাষানাম প্রায় একই, তবে অনেকটা সংস্কৃত-নির্ভর শিঙ্গাড়াও বলে কিন্তু বৈদিক ও সংহিতাগত নাম শৃঙ্গাট বা শৃঙ্গাটক। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলের বহু জলাশয় এবং ঝিলে চাষ করা হয়। উড়িষ্যার অঞ্চলবিশেষে এটিকে শিঙ্গাড়া বলে।
পানিফল বা শিঙ্গাড়া একটি ভাসমান বিস্তৃত জলজ উদ্ভিদ, এই জল সঞ্চারী শৈবাল সদৃশ (শেওলা) ভেষজগুলির পাতা ২/৩ ইঞ্চি চওড়া এবং ৩/৪ ইঞ্চি লম্বা হয়, পাতার কিনারাগুলি করাতের ন্যায় বড় দাঁতবিশিষ্ট। পাতার বোঁটা ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি এবং পশমময়। ফলগুলি ত্রিকোণাকার কিন্তু মোটা। এই ফলের দুই কোণে দুটি ধারালো কাঁটা হয়। ভাদ্র আশ্বিন থেকে ফল হতে শুরু হয় এবং মাঘ ফাল্গুন পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়, তারপর পুরনো পাতা পচে যেতে থাকে। এটির বোটানিকাল নাম Trapa natans Makino., পরিবার Onagraceae.
এই গণের আর একটি প্রজাতি আছে। এটি প্রধানত ভারতের ছোটনাগপুর অঞ্চলে দেখা যায়, এর পাতাগুলি আকারে ছোট, এই গাছের ফলগুলির চারকোণে চারটি কাঁটা আছে, তার মধ্যে দুটি কাঁটা অপেক্ষাকৃত ছোট, ফল ঐ এক সময়েই হয়। এটির বোটানিকাল নাম Trapa incisa, ঔষধার্থে ব্যবহার হয় ফল ও গাছ।
রোগ প্রতিকারে
এটি প্রধানভাবে কাজ করে রসবহ স্রোতের উপর।
১. পেটের দোষ ও তার সঙ্গে প্রমোহ: এই ক্ষেত্রটি একটু বিচিত্র, এর সঙ্গে প্রমেহ থাকলেই মল-সঙ্কোচ হয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রে শুকনো পানিফলের শাঁস গুড়ো করে ছেঁকে নিয়ে, সেটা এক বা দুই চা চামচ, সিকি কাপ গরম দুধে গুলে সকালে ও বিকালে দুবার খেলে প্রথমে পেটের দোষটা সেরে যাবে, তারপর মেহ রোগটা আস্তে আস্তে নিরাময় হবে।
২. পিত্তের জ্বালায়: শরৎকালে যারা পিত্তের জ্বালা অনুভব করেন তাদের দেখা যায় শ্লেষ্মা প্রধান প্রকৃতি এবং পিত্ত তার অনুষঙ্গী। এইসব লোকের শরৎকালে এই উপসর্গটা দেখা দেয়, এক্ষেত্রে পানিফল বেটে ৫/৭ গ্রাম করে দুইবেলা খেতে হবে। আর গোসলের পূর্বে পানিফল বাটা গায়ে মেখে গোসল করতে হবে। এর দ্বারা ঐ পিত্তের দহটা বা গা-হাত-পা জ্বালা কমে যাবে।
৩. শরৎকালের আমাশায়: অনেকের দেখা যায়, শ্রাবণ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত পেটটা নরম হয় এবং মলের সঙ্গে মাঝে মাঝে রক্তও পড়ে। এক্ষেত্রে শুকনো পানিফলের শাঁস ১৫/২০ গ্রাম একটু থেতো করে ২ কাপ ঠান্ডা জলে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে, সেটাকে ছেঁকে, সকাল থেকে ৩/৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই জলটা খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ দাস্তটা পাতলা আর থাকে না।
৪. ভ্রম রোগে: অনেক সময় মনে এসেও স্মৃতিতে ধরা যাচ্ছে না, আবার এও দেখা যায়—কোথায় কি রাখছেন সেটা মনে থাকছে না, এদের ক্ষেত্রে শুকনো পানিফলের শাঁস সুজির মতো গুড়ো করে, ঘিয়ে ভেজে, দুধ চিনি দিয়ে হালুয়ার মতো রান্না করে প্রত্যহ খাওয়া, এর দ্বারা ঐ ভুলে যাওয়াটা আর থাকবে না, তবে এটাও ঠিক যে, ৭২ বৎসর বয়সের পর এটা হওয়া স্বাভাবিক। তার পূর্বে হলেই চিকিৎসার ক্ষেত্র।
৫. আগন্তুক শোথে: একে পাশ্চাত্য চিকিৎসকগণ এলার্জি বলে থাকেন। আয়ুর্বেদের মতে এই রোগটির হেতু হলো—কোনো বিশিষ্ট দ্রব্য খেলে বা স্পর্শ করলে রসবহ স্রোত স্ফীত হয়, যার জন্য শরীরের বিভিন্ন স্থানে বাহিরে এবং আভ্যন্তরে শোথের সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে কাঁচা পানিফল যতদিন পাওয়া যায়, সে কয়টা দিন কাঁচা খাওয়াই ভাল, তারপর শুকনো পানিফলের শাঁসকে গুড়ো করে গমের আটার সঙ্গে মিশিয়ে রুটি করে খেলে এটার প্রবণতা চলে যায়।
৬. যৌন মিলনে অতৃপ্তি: যাকে বলে ‘ফুললো আর মরলো, সেইরকম। তৃপ্তি কারুরই হলো না; এই যে অসহায় অবস্থা, এক্ষেত্রে কাঁচা পানিফল বেঁটে অল্প চিনি মিশিয়ে লপসি করে খাওয়া; এর দ্বারা ঐ অসুবিধেটা চলে যাবে।
৭. মূত্ররোধে: অম্ল, অজীর্ণ ও পেটের বায়ুতে অনেক সময় প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেল, সেক্ষেত্রে পানিফল বেটে মূত্রাশয় (bladder) উপরটায় প্রলেপ দিলে প্রায় ক্ষেত্রেই প্রস্রাব হয়ে যায়। তবে উপরিউক্ত কারণটির চিকিৎসা চিকিৎসকের এক্তিয়ারে।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা,৯৬-১০০।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Аимаина хикари
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।