ব্রাহ্মী এক ধরণের লতা জাতীয় উদ্ভিদ। ভিজা মাটিতে লতিয়ে লতিয়েই এ লতার বৃদ্ধি ঘটে। লতার প্রত্যেকটি গাঁট থেকে শিকড় বের হয়। কাণ্ড খুবই নরম এবং রসযুক্ত। গায়ে খুব সরু লোম থাকে, পাতা আধা ইঞ্চি বা আরও একটু বড় হতে পারে। কাণ্ডের বিপরীত দিক থেকে যুগপত্র জন্মায়। পাতার বোটা কাণ্ডের সাথে প্রায় লেগে থাকে। পাতার কিনারায় কোনো খাজ থাকে না। সামনের দিকটা গোলাকার এবং বৃন্তদেশ ডিমের মতো। পাতার শিরাগুলো অস্পষ্ট।
ফুল ফিকে নীলের আভাযুক্ত শ্বেতবর্ণ। এ লতার শিরাগুলো বেগুনী রঙের। ফুলের ওপরের পাপড়িগুলো ডিম্বাকৃতি। পুষ্পস্তবক গোলাকার ও লম্বা। বীজকোষে দু’টি আলাদা ঘর থাকে। কোষের মধ্যে অনেকগুলো বীজ থাকে। গরম বাড়ার সাথে সাথে গাছে ফুল ফোটে, পরে ফল ধরতে শুরু করে।[১]
ব্রাহ্মী লতা-র অন্যান্যনাম:
এর সংস্কৃত নাম ব্রাহ্মী, বাংলায় প্রচলিত নাম বিরমীশাক, বরমীশাক, ব্রাহ্মীশাক ও হিন্দিতে শ্বেতচামনী, ব্রহ্মী নামে পরিচিত। বোটানিক্যাল নাম Bacopa monnieri (Limm.) Pennell.. ও ফ্যামিলি Scrophulariaceae
উপকারিতা:
এই প্রজাতি স্বাদে তিক্ত, মূত্রকারক, মদবিরেচক, কামোদ্দীপক ও রক্ত পরিষ্কারক। এর পাতা ঘিয়ে ভেজে খেলে স্বরভঙ্গ, স্নায়বিক দুর্বলতা, অপস্মার রোগ ও ক্ষিপ্ততার উপশম হয়। শিশুদের বাসনালীর পীড়ায় চায়ের চামচে এক চামচ পাতার রস খাওয়ালে বমি হওয়া বন্ধ হয়ে আরাম পাওয়া যায়। এভিন্ন সাধারণ কোষ্ঠবদ্ধতায়ও এই রস হিতকর। রক্তদৃষ্টিতে, খোস-পাচড়ায়, বিরোগে ও উপদংশ রোগে ব্রাহ্মীর রস সেবনে উপকার পাওয়া যায়। ঔষধার্থ ব্যবহার্য অংশ—সমগ্র গাছ ও মূল।[২]
ব্রাহ্মী লতা-র ভেষজ ব্যবহার:
১. উন্মাদ রোগে: ব্রাহ্মী লতার পাতার রস ২০ মি.লি. কুড়-চূর্ণ ২ গ্রাম এবং মধু ২ চামচ এ তিনটি একসাথে মিশিয়ে দিনে একবার সকালের দিকে খাওয়ালে উন্মাদ রোগ প্রশমিত হয়।
২. স্বরভঙ্গ অথবা গলাভাঙ্গায়: ব্রাহ্মীর শুকনা লতা ও পাতা, বট, হরীতকী, বাসকের শিকড় এবং পিপুল এ কয়টি এক থেকে দেড় গ্রাম পরিমাণ নিয়ে একসাথে গুড়া করে তিন থেকে চার চামচ মধুর সাথে খেলে অবশ্যই নিরাময় হয়। সারা দিনে মাত্র দু’বার খেলেই গলার স্বর অনেকটা স্বাভাবিক হবে। যদি না হয়, তবে পরের দিন একইভাবে ওষুধ তৈরি করে আর একবার খেলেই স্বর স্বাভাবিক হবে।
৩. বসন্তরোগে: গায়ে গুটি বের হলেই ব্রাহ্মী লতার পাতা ও কচি ডাটা বেটে তার। রস ৬ চামচ মধুর সাথে খেলে খুব তাড়াতাড়ি সেরে যায়।
৪. স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে: ব্রাহ্মী লতার পাতা ও ডালের রস ৩০ মিলিলিটার এবং দেড় চামচ চিনি মিশিয়ে রোজ সকালে খেলে স্মৃতিশক্তি যথেষ্ট বেড়ে যায়। হাঁপানির টান উঠলে ও ব্রাহ্মী লতার শুকনা পাতা ও কাণ্ডের রস ৩০ মি.লি. তিন চামচ মধুর সাথে খাওয়ালে রোগীর শ্বাসকষ্ট অনেক কমে। এছাড়াও সকালে কিছু খাওয়ার পর ২ চা-চামচ বা ১ চা-চামচ ব্রাহ্মী শাকের রস আধ চা-চামচ গরম ঘি মিশিয়ে আধ কাপ দুধের সঙ্গে খাবেন। এইভাবে ১৫/২০ দিন খেলে যে অসুবিধে আসছিলো সেটা আর থাকবে না।
৫. পিত্ত বেশি হলে: ব্রাহ্মীর মূল দেড় থেকে দু’গ্রাম পরিমাণ সামান্য পানির সাথে খালিপেটে খেলে শরীরের অতিরিক্ত পিত্ত নাশ করে।
৬. শিশুদের কফ ও কাশিতে: ব্রাহ্মী লতার কচি ডাল ও পাতা বেটে সেটা সামান্য গরম করে শিশুদের বুকে প্রলেপ দিলে কাশি কমে যায় এবং বুকে জমে থাকা কফ বের হয়ে যায়।
৭. বাত রোগে: এ বাতটা এমন যে, ক্রমশ শরীরে অবসাদের ঝিমুনি আসে, এই অবস্থা চলতে থাকলে ব্রাহ্মীশাকের রস একটু গরম করে তা থেকে ২ চা-চামচ নিয়ে প্রত্যহ একবার অথবা ২ বার খেতে হবে এর দ্বারা শরীরটা ঝরঝরে হবে। এছাড়াও ব্রাহ্মী পাতার রস চার চামচ এবং তার অর্ধেক (দু’চামচ) তারপিন তেল একসাথে মিশিয়ে মালিশ করলে উপকার হয় ।
৮. ছোটদের সর্দি ও বুকে শ্লেম্মা বসে গেলে: ছোট ছেলে মেয়েদের বুকে সর্দি গেলে এবং নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলে, এক চামচ ব্রাহ্মী লতার রস খাওয়ালে সামান্য বমির সাথে সর্দি ও বুকের কষ্টকর শ্লেষ্ম সহজেই বের হয়ে যাবে।
৯. শিশুদের শ্লেমায়: গলার কাছে কফ আটকে প্রায় দমবন্ধ করে দিচ্ছে অর্থাৎ প্রচুর শ্লেষ্মায় হাসফাস করছে, সেক্ষেত্রে ব্রাহ্মীশাকের রস গরম করে ঠাণ্ডা হলে ঐ রসটা ২৫/৩০ ফোঁটা এক চা-চামচ দুধ মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। এব দ্বারা ওই শ্লেষ্মটা উঠে যাবে অথবা সরে যাবে, তারফলে ওই হাঁফটা কমে যাবে।
১০. মূত্রকৃচ্ছ্রতায়: যাঁরা এর সঙ্গে কোষ্ঠবদ্ধতায় ভুগছেন, তাঁরা সকালে এবং বিকালে দু’বার করে ২/৩ চা-চামচ’ক’রে ব্রাহ্মী শাকের রস খাবেন; তবে খাওয়ার সময় ৫/৬ চা-চামচ দুধ মিশিয়ে নেবেন, এর দ্বারা মূত্রকৃচ্ছ্রতাটাও কমে যাবে, দাস্তটাও পরিষ্কার হবে।
১১. শূক্রতারল্যে: এটা অস্বস্তিকর ও দুঃখকর রোগ। এটি হ’য়ে পড়লে সামলানোর জন্যে প্রত্যহ সকালের দিকে ২ চা-চামচ করে ব্রাহ্মীশাকের রস এক কাপ দুধে মিশিয়ে সপ্তাহখানেক খেলে এটাতে নিশ্চয় উপকৃত হবেন।
১২. অপস্মার বা মৃগী রোগ সারাতে: এই রোগটি নারী-পুরুষ উভয়েরই হয়, যদি জন্মসূত্রে না হয়ে থাকে, তবে যে কোন বয়সেই এ রোগ আক্রমণ করুক না সেটা উপশমিত হতে পারে যদি ব্রাহ্মীশাকের রস ২ চা-চাম একটু, গরম করে আধ কাপ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে বেশ কিছুদিন খাওয়া যায়। [১][২]
CITEMICAL COMPOSITION
Bacopa monnieri (Linn) Pennell.
Alkaloids viz., brahmine, herpestine. Bases viz., B oxalate, B: and B: chloroplatinate. Betulic acid. Hersaponin. Stigmasterol.[২]
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্র:
১. আঃ খালেক মোল্লা সম্পাদিত;লোকমান হেকিমের কবিরাজী চিকিৎসা; মণিহার বুক ডিপো, ঢাকা, অক্টোবর ২০০৯; পৃষ্ঠা ১২৮-১২৯।
২. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৪, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ৬৭-৬৯।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Vengolis
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।
আমি ঢাকার বাসায় এই শাক চাষ করতে চাই। গাছ কোথায় পাব?
ধন্যবাদ। এই প্রজাতিটি বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয় না। মাঝে মাঝে ঢাকার বাজারে অন্যান্য শাকের সাথে বা আলাদাভাবে বিক্রি হতে দেখা যায়। এছাড়া শহরতলী বা গ্রামের সব্জির জমিতে, ভিজা, স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে আপনাআপনি জন্মে। তবে উত্তরবঙ্গের গ্রামের সব্জির জমিতে আপনি এটি নিশ্চিত পাবেন।