লাউ বা কদু (বৈজ্ঞানিক নাম: Lagenaria siceraria) কিউকারবিটাসি পরিবারের লাগেনারিয়া গণের একটি বৃহৎ বর্ষজীবী সপুষ্পক বীরুৎ। এই সবজিটির আছে বহুবিধ পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা। আয়ুর্বেদ মতে, লাউ হচ্ছে মধুরস। লাউ খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। এ ছাড়া শরীর ও মস্তিষ্ককে ঠাণ্ডা রাখে। তাই আমাদের বেশি করে লাউ খাওয়া প্রয়োজন।
লাউ বা কদুর কান্ড শাখান্বিত, খাঁজযুক্তকৌণিক, রোমশ।[১] এই গাছটি বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় সর্বত্রই চাষ হয়, আমাদের নিত্য আহার্যের তরকারী হিসেবে ব্যবহারের জন্য। এই অলাবুর চলতি নাম লাউ, আবার কোনো কোনো প্রদেশে ‘কন্দু’ও বলে। এই ফল আকৃতিতে বিভিন্ন হলেও এর প্রজাতি (Species) ও গণে (Genus) কোনো পার্থক্য নেই, আবার ফল স্বাদে তিক্তও হয়, তাকে বলে ‘কটতুম্বী অথবা তিক্ত আলাবু। লাউ বা কদু সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন
লাউ এশিয়া ও আফ্রিকার জনপ্রিয় সবজি
লাউয়ের ঔষধি গুণাগুণ:
আমাদের অপেক্ষাকৃত প্রাচীন বনৌষধির গ্রন্থ ‘রাজনিঘণ্টতে গোরক্ষী ও ক্ষীরতুম্বী, এই দুই প্রকার মিষ্ট অলাবুর (লাউয়ের) উল্লেখ দেখা যায়। ঔষধার্থে লাউ বা কদুর ব্যবহার হয় মূল, পত্র, নাল, বীজ ও ফল। বৈদ্যক সম্প্রদায় লাউয়ের প্রতিটি অংশকে পৃথক, পৃথক পদ্ধতিতে কিভাবে কাজে লাগিয়েছেন সেইটাই আলোচনা করা যাক নিচে[২]
১. পিতশ্লেমাজনিত জ্বরে: তার সঙ্গে গায়ে জ্বাল, বমনেচ্ছা বা বমন বা বমি হতে থাকলে লাউটা ঝলসে নিয়ে নিংড়ে রস করে (৩ থেকে ৪ চামচ) তার সঙ্গে আধ চামচ আন্দাজ মধু মিশিয়ে খাওয়ালে গায়ের জ্বালা ও বমন বা বমনেচ্ছা চলে যাবে।
২. চোর অম্বল: কিন্তু ঢেকুর তোলাটাই তাকে ব্যতিব্যস্ত করছে, (রোগী মনে করে কেবল মাত্র তোলাটাই তার রোগ) তার সঙ্গে আবার কোষ্ঠকাঠিন্য, এ ক্ষেত্রে ঐ ঝলসে পোড় লাউয়ের রস ২ থেকে ৩ চামচ একটু মধু মিশিয়ে খেলে এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে রেহাই হয়।
৩. দাহে: কি শীত কি গ্রীষ্ম (সব ঋতুতেই) গায়ে হাত দিলেই গরম বোধ হয়, এ ক্ষেত্রে ঐভাবে তৈরী করে ২ থেকে ৩ চামচ রস কিছুদিন খেলে ওটা স্বাভাবিক হবে।
৪. অর্শবিকার: দাস্ত পরিষ্কার না হওয়ার মতো, চটচটে মল নিঃসারণ, তার সঙ্গে ২ থেকে ৪ ফোঁটা মতো, তারপর অসহ্য টনটনানি, এর উপর শৌচক্রিয়ার পরেও কিছুটা পিচ্ছিলতা থেকে যায় এ ক্ষেত্রে ঐ ঝলসা পোড়া লাউয়ের রস ও চিনি অমোঘ ঔষধ।
৫. বারবার পিপাসা: এ রোগ আসে শ্রাবণে, যায় কার্তিকের শেষে, এ ক্ষেত্রে লাউ খাওয়ার বিধি নিষেধ না মেনে ঐ ঝলসা পোড়া লাউয়ের রসে একটু, চিনি মিশিয়ে ১ গ্লাস সরবত করে কিছুদিন খেয়ে দেখুন, এ পিপাসা আর থাকবে না।
৬. পিত্তশ্লেমা বিকারে: হলুদ না মেখেও গেঞ্জিতে বগলের নিচের অংশটাই হলদের ছোপ পড়ে, গায়ের দুর্গন্ধের জন্য নিজেরই অস্বস্তি বোধ হয়। সে ক্ষেত্রে এই ঝলসা পোড়া লাউয়ের রস একটু মধু মিশিয়ে খাওয়া আর শুধু ঐ রসটা স্নানের কিছুক্ষণ পুর্বে গায়ে লাগানো। এর দ্বারাই ঐ দোষটা নষ্ট হয়।
৭. ন্যাবা বা জন্ডিস দেখা দেওয়া: এ ক্ষেত্রে লাউ আর তার পাতা ঝলসানো রস ৫ থেকে ৬ দিন খাওয়ালেই ওটা রুখে দেবে।
৮. বিদ্গধাজীর্ণ: এ রোগের লক্ষণ সকালের দিকে মুখ তেতো (তিক্ত) হওয়া, দাঁত অপরিষ্কার থাকা অর্থাৎ দীতে ছোপ ধরা এই ক্ষেত্রেও ঐ লাউ পোড়ার সরবত খেলে ঠিক হয়ে যাবে।
৯. গ্রন্থিক মলে: বৃহৎ অন্ত্রে বুলেটের মতো শক্ত মল বেরুতে চায় না, যেন প্রাণান্ত হয় আর কি, এ ক্ষেত্রে লাউয়ের ডাঁটা ছ্যাঁচা রস ৪ থেকে ৫ চামচ একটু জল মিশিয়ে কয়েকদিন খেতে হয়, এর দ্বারা ঐ অসুবিধেটা দূর হয়।
লাউয়ের বাহ্যপ্রয়োগের উপকারিতা:
১০. পায়োরিয়ায়: ঝলসা পোড়া লাউয়ের রস মুখে নিয়ে খানিকক্ষণ (১০ থেকে ১৫ মিনিট) বসে থাকতে হয় (যাকে আয়ুর্বেদের পরিভাষায় বলা হয় কবল ধারণ করা)। তারপর মুখ ধুয়ে ফেলা, এইভাবে কয়েকদিন করলে ওটা সেরে যাবে।
১১. দুষিত ক্ষতে: ঐ ধরণের রস দিয়ে ধুলে ক্ষতের দোষ-অংশটা নষ্ট হয়।
১২. মেচতায়: মুখেতে প্রায় বদ্বীপ সৃষ্টি হয়ে মুখের জন্য লোকসমাজে বেরতে কুণ্ঠা বোধ হয়; এই ক্ষেত্রে এক টুকরো লাউ ঝলসে নিয়ে ঐ জায়গায় ঘষতে হয় রোজ একবার করে। এর দ্বারা কয়েকদিনের মধ্যে ঐ মেচেতার দাগটা আর থাকে । এ ভিন্ন ছোট ছোট কালো দাগ থাকলেও সেটাও উঠে যায়।
১৩. মুখের লাবণ্যে: সব বয়সেই কার না এটাকে রাখতে ইচ্ছে করে! এর জন্যে এক টুকরো লাউকে নিয়ে রোজ মুখে ঘষতে হয়, ঐ সাদা থলথলে দিকটা। এর দ্বারা মুখের লাবণ্য ফিরে আসবে; তবে হ্যাঁ পচা ছানায় ভাল চিনি দিলেও তো ভাল সন্দেশ তৈরী হবে না।
১৪. ছুলি রোগে: এ রোগ নির্মুল হয়ে সারে না সত্যি, তবে অদৃশ্য হয়। এই জন্যেই ঝলসা পোড়া লাউ এক টুকরো নিয়ে সেইখানটায় ঘষে দিন; কয়েকদিন ঘষলেই ওটা মোটামুটি তখনকার মতো অদৃশ্য হবে। এটাতে অনেকদিন ভালো থাকতেও দেখা যায়।
১৫. ছানিতে: চোখে ছানিপড়া সবে শুরু হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে লাউফুলের সাদা পাপড়ি অংশটা নিয়ে গড়ে এক ফোঁটা করে রস যে চোখে ছানিপড়া আরম্ভ হয়েছে, সেই চোখে ১ দিন অন্তর দিলে ছানিপড়া বন্ধ হতে দেখেছি। তবে একটু, বেশি দিন প্রয়োগ করতে হয়। তবে লাউফুলটাকে অল্প গরম জলে ধুয়ে নেওয়াই উচিত আর প্রথম প্রথম ২ দিন অন্তর একদিন ব্যবহার করাটাই ভালো, তারপর ১ দিন অন্তর।
১৬. শ্বেতী: সবে শুরু, ছোট ছোট সাদা দাগ দেখা যাচ্ছে, দেরী না করে রোজ একবার করে ঐ জায়গায় লাউফুল র’গড়ে দিতে হয়। এর দ্বারা রেহাই পাওয়া যায়।[২]
লাউয়ের পুষ্টিগুণ ও রাসায়নিক গঠন: লাউয়ে রাসায়নিক গঠনে আছে (a) Saponin. এবং (b) Fatty oil viz, mixture of different fatty alcohols. এছাড়াও লাউয়ে রয়েছে অনেক পুষ্টি। এর প্রতি ১০০ গ্রামে শর্করা, আমিষ, চর্বি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-বি এবং খাদ্যশক্তি আছে যথাক্রমে ১৫.১ গ্রাম, ১.১ গ্রাম, ০.০১ গ্রাম, ২৬ মিলিগ্রাম, ০.৭ মিলিগ্রাম, ০.০৩ মিলিগ্রাম, ৪ মিলিগ্রাম এবং ৬৬ কিলোক্যালরি। লাউশাকে রয়েছে আরো বেশি পুষ্টি। এর প্রতি ১০০ গ্রামে ক্যারোটিন ৭১৯৬ মাইক্রোগ্রাম এবং ভিটামিন-সি আছে ৯০ মিলিগ্রাম করে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে শর্করা ৬.১ গ্রাম, আমিষ ২.৩ গ্রাম, চর্বি ০.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৮০ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ৩৯ কিলোক্যালরি।[৩]
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. এম অলিউর রহমান, (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৭ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৩১৭-৩১৮। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
২. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা,৬২-৬৩।
৩. নাহিদ বিন রফিক, শাকসবজির পুষ্টি ও ভেষজগুণ, কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস), http://www.ais.gov.bd/site/view/krishi_kotha_details/১৪২৪/অগ্রহায়ণ/শাকসবজির পুষ্টি ও ভেষজগুণ
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।