করলা বা উচ্ছের বহুবিধ ভেষজ গুনাগুণ, পুষ্টিমান ও উপকারিতা

করলা বা করোলা বা উচ্ছের আছে বহুবিধ ভেষজ গুনাগুণ, পুষ্টিমান ও উপকারিতা। রোগ সারাতে পটু করলা স্বাদে কটু বা তিক্ত হলে কি হবে স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপকারী। প্রাচীনকাল থেকেই করোলার তরকারি খাওয়ার প্রচলন। সুষম সন্তুলিত আহারে যেমন অম্ল, লবন, তীক্ষ্ণ কষায় আর মিষ্টি রসের প্রয়োজনীয়তা আছে তেমনই তিক্ত ও কটু রসও প্রয়োজন।

করোলা আমরা দু ধরনের দেখতে পাই যেমন বড় করোলা এবং উচ্ছে বা ছোট করোলা। অনেক সময় তরকারি রান্না করতে গিয়ে করোলার তেতো ভাব কমানোর জন্যে টুকরো করে কেটে, নুন মাখিয়ে হাত দিয়ে চটকে নিয়ে রস নিংড়ে নেওয়া হয়। করোলার ওপরকার জলও ছড়িয়ে নেওয়া হয়। এতে তেতো ভাব কমে বটে কিন্তু এইভাবে ছাল ছাড়িয়ে ও রস নিংড়ে খেলে করোলার গুণ অনেক কমে যায়। করোলার তেতোভাব কমাতে এই সব প্রক্রিয়া না করে বরঞ্চ করোলার তরকারি পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করলে, করোলা পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে আমচুর জিরে ভাজা গুঁড়া রসুন ইত্যাদি দিলে বা মশলা ভরে আস্ত পুরভরা করোলা বা কলোজি রান্না করলে তেতো ভাব কমে যায় খেতেও ভাল লাগে এবং নানা রকম মশলাপাতির সংযোগে খাদ্যগুণ আরও বেড়ে যায়।[১]

করলার পুষ্টিগুণ

করলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-সি। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রামে ১৪৫০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন ও ৬৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি আছে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ২.৫ গ্রাম, শর্করা ৪.৩ গ্রাম, চর্বি ০.১  গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৪ মিলিগ্রাম, লৌহ ১.৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.০৬ মিলিগ্রাম খাদ্যশক্তি রয়েছে ২৮ কিলোক্যালরি।[২]

সুস্থ থাকতে করলা ও উচ্ছের ব্যবহার:

১. জ্বর: জ্বর ও শরীরের কোন অংশ ফুলে ওঠায় করোলা হলো পথ্য।  

২. পেট ও ত্বকের অসুখে: করোলার তরকারি বায়ু বৃদ্ধিতে, বাতে, যকৃৎ অথাৎ লিভার ও প্লীহার (পিলে) রোগে আর ত্বকের অসুখে উপকার দেয়। বাত, পিত্ত, রক্তের দোষ, জনডিস, কৃমি ও যৌন ব্যাধি সারায়। বড় করোলা গ্যাস ও জন্ডিস সারিয়ে তোলে।

আয়ুর্বেদে ওষুধ হিসেবে করোলার বিশেষ উল্লেখ নেই কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন নিয়মিত করোলা খেলে তা পরম ওষুধের কাজ করে অনেক রোগের হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করে।

৩. ডায়বেটিস: এই রোগের রোগীদের পক্ষে করোলা খুবই ভাল অব্যর্থই বলা চলে। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে নিয়মিত করোলার রস খেলে এবং খাওয়া-দাওয়ার নিয়ম মেনে চললে ডায়বেটিস (মধুমেহ) সারবেই।

আরো পড়ুন:  ফুটি বা বাঙ্গি বা বাঙ্গী বা বাঙির কয়েকটি বহুমুখী ঔষধি গুনাগুণ

এছাড়া তেতো বের না করে ফেলে করোলার তরকারি, চচ্চড়ি, করলার ভাতে, বেগুন দিয়ে করোলা ভাজা প্রভৃতি নিয়ম করে ভাত-রুটির সঙ্গে খেলেও এই অসুখে উপকার পাওয়া যায়।

৪. হজম বৃদ্ধি: করোলা শীতল, তাড়াতাড়ি হজম হয়, শরীরের ভেতরে জমে থাকা মল বের করে দেয়, স্বাদে তিক্ত, খেলে বায়ুর সৃষ্টি হয় না। উচ্ছেতে আছে  করোলার মতোই গুণকারক। উচ্ছের আর একটি বিশেষ গুণ হলো এই তরকারি খেলে খিদে বেড়ে যায় এবং উচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি হজমও  হয়ে যায়। বড় করোলার চেয়ে ছোট ছোট উচ্ছেই বেশি উপকারী।

করোলার অন্যান্য অংশের ব্যবহার:

সুস্থ থাকতে করোলা পাতা, ফুল, বীজ এবং করোলা চুর্ণ ব্যবহার করা হয়। করলার একেকটি অংশে থাকে একেক রোগ প্রতিকারের উপাদান। নিয়ম মেনে খেলে ভালো উপকার পাওয়া যাবে।

পাতা:

১. করোলার পাতা মূত্র বৃদ্ধি করে, জ্বর সারায় কৃমি নাশ করে। ওষুধ হিসেবে কারোলা পাতারও অনেক গুণ আছে।

২. বিখ্যাত প্রাচীন বৈদ্য সুশ্রতের মতে করোলার পাতা জোলাপের কাজ করে এবং প্রয়োজনে বমিও করায়।

৩. পিত্তের প্রকোপ দূর করবার জন্যে পিত্তের বিষ যদি বমির ও মলের সাহায্যে বের করে দিতে হয় তাহলে সেসব ক্ষেত্রে করোলার পাতার রস নুন মিশিয়ে খাওয়ালে বমন ও মলত্যাগ হয়ে যায়।

৪. ম্যালেরিয়ায় করোলা পাতার রস শরীরে লাগালে এবং সাড়ে তিনটি করোলার পাতা ও সাড়ে তিনটি আস্ত গোলমরিচ একসঙ্গে পিষে নিয়ম করে খেলে উপকার পাওয়া যায়।

৫. করোলার পাতা পিষে রস বের করে প্রথমে কিছুদিন ২ চা চামচ করে এবং তারপরে কিছুদিন ৪ চা চামচ করে নিয়মিত খেলে পুরনো ম্যালেরিয়া এবং এই রোগের জন্যে পিলে ও লিভার বেড়ে যাওয়া, পেটে যদি জল জমা শুরু হয়ে থাকে তাও সারে।

৬. এই রস নিয়মিত খেলে দু-একবার মলত্যাগ হয়, প্রস্রাব পরিষ্কার হয়, খিদে বাড়ে, খাবার হজম হয়, শরীরে রক্ত বৃদ্ধি হয়। শরীরের সব দোষ প্রস্রাব ও মলত্যাগের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে যায়।

৭. করোলা পাতার রসে একটু হলুদ মিশে খাওয়ালে হাম, জলবসন্ত ও বসন্ত রোগে উপকার পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন:  কাঁকরোল লতা-র বিভিন্ন ঔষধি গুণাগুণ

৮. দশ চা চামচ করোলা পাতার রসে একটু হিং মিশিয়ে খাওয়ালে প্রস্রাব পরিষ্কার হয়ে যায়। কোনো কারণে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেলে এটা ওষুধ হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

৯. করোলা পাতা বা করলার রস এক চা চামচ নিয়ে তাতে অল্প চিনি মিশিয়ে নিয়মিত খেলে অর্শ ও অর্শ থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। একটু গরম জলে করলা পাতার রস মিশিয়ে প্রতিদিন খেলে কৃমি সারে।

১০. করলা পাতার রস মালিশ শুষ্ক ত্বকের পক্ষে এবং ত্বকের রোগের পক্ষে হিতকর।

১১. আগুনে পোড়া ঘায়ের ওপর করলা পাতার রস লাগালে উপকার পাওয়া যায়।

ফুল:

১২. করোলার ফুল বা পাতা ঘিয়ে ভেজে বা কাঁচাই নুন মিশিয়ে খেলে অম্লপিত্তের জন্যে যদি ভাত খাওয়ার পরই বমি হয়ে যায় তাহলে সেটারও নিবারণ হবে।

১৩. করোলার বীজেরও গুণ আছে। তিনটি করোলার বিচি ও তিনটি গোলমরিচ একসঙ্গে অল্প জল দিয়ে পিষে খাওয়ালে বাচ্চাদের বমি বন্ধ হয়।

অন্যান্য অংশ:

১৪. করোলা চূর্ণের প্রয়োগ কচি করোলা টুকরা করে কেটে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে মিহি করে পিষে নিতে হবে। চার মাস ধরে সকালে ও সন্ধ্যেবেলায় নিয়মিত দু চা চামচ করে এই চুর্ণ খেলে ডায়বেটিস নিশ্চয় সারবে। সেইসঙ্গে অবশ্য ডায়বেটিসের খাওয়া-দাওয়ায়ও বিধি নিষেধ মেনে চলতে হবে। এইভাবে করোলা-চুর্ণ খেলে প্রস্রাবের সঙ্গে শর্করা বা চিনি বেরোনো একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে।

১৫. করলার শেকড় বা মূল পিষে নিয়ে চুলকুনি বা ছোট ছোট ফুসকুড়িতে প্রলেপ লাগালে তা সেরে যায়।

আয়ুর্বেদের মতে উচ্ছে,  জ্বর সারায়। পিত্ত, কৃমি ও কফ নাশ করে। খিদে বাড়ায়, মলত্যাগ করায়, অরুচি নাশ করে। করলা উত্তেজক। কফ, বায়ু ও পিত্ত দূর করে। রক্তের দোষ, জন্ডিস (নেবা রোগ), কৃমি রোগেরও ডায়বেটিসের উপশম করে। জ্বরের পরে যে দুর্বলতা করলা খেলে তা দূর হয়। উচ্ছের বীজ খেলে বসন্ত রোগের সংক্রমণের ভয় থাকে না। করলার ফুল রক্তপিত্তের পক্ষে উপকারী।

আয়ুর্বেদ মতে করলার গুণও উচ্ছের মতোই। হাকিমি বা ইউনানি মতেও করলা বায়ু ও কফ নাশ।  স্নায়ুমণ্ডল সবল করে, রতিশক্তি বৃদ্ধি করে, বীর্যবৃদ্ধি করে, কৃমি নাশ করে। বাত, গেঁটে বাত, জনডিস, পিলের ও লিভারের অসুখ ডায়বেটিসের পক্ষে উপকারী। পাকস্থলী সবল ও সঙ্কুচিত করে, শরীরের ভেতরের (কিডনি ও গলব্লাডার) পাথর বের করে দেয়। করলা পাতার জল ও হলুদের রস এক সঙ্গে মিশিয়ে খেলে হামজ্বর, ফোড়া ও বসন্ত রোগে আরোগ্য পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন:  তেলাকুচা বাংলাদেশ ভারতের সুলভ ঔষধি লতা

চিকিৎকদের মতে,  করলা পাতার রস ও বীজের শাঁস কৃমি নাশ করে। পাতার রসের সঙ্গে নুন মিশিয়ে খেলে ভাল ফল পাওয়া যায়। করলা শরীরের বল বৃদ্ধি করে। নানা রকমের বাত সায়ায় পিলে ও লিভারের অসুখে করলা পথ্য। করলা পাতার রস জ্বর সারায়। শুকনা পাতার প্রলেপ লাগালে ক্ষত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়।

বৈজ্ঞানিক মতেও, করোলা পিত্তনাশক, কৃমি নাশ করে, মূত্রের পরিমাণ বাড়ায়। কারলা পাতার রস জোলাপের কাজ করে এবং প্রয়োজনে বর্মন করলায় ভিটামিন ‘এ’ বেশি মাত্রায় আছে এবং ভিটামিন ‘সি’ অল্প মাত্রায় আছে। লোহা আর ফসফরাস আছে। উচ্ছেতে বড় করলার চেয়ে বেশি লোহা আছে। লিভার আর রক্তের জন্যে এর প্রয়োজন খুবই বেশি। ফসফরাস প্রধানত হাড়, দাঁত, মস্তিষ্ক ভাল রাখে।

প্রাকৃতিক চিকিৎসকের মতেও, করলায় আছে রক্ত শোধন করবার গুণ। লিভার ও পিলের রোগে উপকারী। প্রচুর প্রস্রাব করিয়ে শরীরের জমা দৃষিত পদার্থ বের করে দেয়। কোষ্ঠ কাঠিন্যে লাভদায়ক। জনডিস সারিয়ে তোলে। পেটের কৃমি নষ্ট করে। শরীরের পুষ্টি বৃদ্ধি করে। শরীর গরম রাখে। প্রতিদিন নিয়ম করে করলা খেলে জ্বর ও হাম-বসন্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

তথ্যসূত্রঃ

১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা,৯৭-১০০।

২. নাহিদ বিন রফিক, শাকসবজির পুষ্টি ও ভেষজগুণ, তারিখহীন, কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস), http://www.ais.gov.bd/site/view/krishi_kotha_details/১৪২৪/অগ্রহায়ণ/শাকসবজির পুষ্টি ও ভেষজগুণ

Leave a Comment

error: Content is protected !!