আল্লামা মহম্মদ ইকবাল ছিলেন একজন মুসলিম লেখক, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ

আল্লামা মহম্মদ ইকবাল বা স্যার আল্লামা ইকবাল (Sir Allama Muhammad Iqbal; ৯ নভেম্বর, ১৮৭৭- ২১ এপ্রিল, ১৯৩৮) ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার একজন মুসলিম লেখক, দার্শনিক, এবং রাজনীতিবিদ, যার উর্দু ভাষার কবিতাগুলোকে অনেকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বলে মনে করেছেন। ইকবালের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আদর্শের কল্পনাশক্তি ব্রিটিশ শাসিত দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদেরকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলনে প্ররোচিত করে। ইকবাল প্রাচ্যের রাষ্ট্রতাত্ত্বিক হিসেবে দার্শনিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সম্প্রদায়ের সমানাধিকারের বিরোধী ছিলেন।[১]  

মির্জা গালিবের গজল ইকবালকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর কাব্য ও সঙ্গীতসাধনায় একাধারে সর্বেশ্বরবাদী মরমিয়া মানসিকতা ও গভীর স্বদেশানুরাগ ফুটে ওঠে। আইন ব্যবসায়ে তিনি সাফল্য অর্জন করেন। উর্দু ও ফারসি ভাষায় রচিত তাঁর বহু কাব্যগ্রহের মধ্যে বাঙ্গেদরা (১৯২৪) ও জাভেদ নামা (১৯৩২) উল্লেখযোগ্য।[২] মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য, শক্তি ও স্বাধীনতার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ইকবালের ঐকান্তিক প্রয়াসের জন্য তাঁকে পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের ভাবজনক বলে আখ্যায়িত করা হতো।

ব্যক্তিগত জীবনে ইকবাল

ইকবালের জন্ম পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে। ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়ার সময়ে আরবি পণ্ডিত আর এ নিকলসনের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯০৮ সালে মিউনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকবার তাঁর ‘পারস্যে তত্ত্ববিদ্যার বিকাশ’ বা ‘ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পারসিয়া’ শীর্ষক গবেষণার জন্য ডক্টর অব ফিলসফি উপাধি অর্জন করেন। লাহোর সরকারি কলেজে মুহাম্মাদ ইকবাল কিছুকাল অধ্যাপনা করেন।

১৯২৭ সালে তিনি পাঞ্জাব আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ থেকে বুঝা যায় যে, তিনি কেবল জ্ঞান এবং গবেষণার ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনেও বিশেষ সক্রিয় ছিলেন। ১৯৩০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ সংগঠনের বার্ষিক অধিবেশনে মুহাম্মদ ইকবাল সভাপতিত্ব করেন। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁর সাহিত্যকীর্তির জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ ‘নাইট’ খেতাবে ভূষিত করেন। এরপর থেকে তিনি স্যার মুহাম্মাদ ইকবাল নামেই সর্বত্র পরিচিত হন। স্যার মুহাম্মাদ ইকবাল ২১ এপ্রিল, ১৯৩৮ সালে লাহোরে পরলোকগমন করেন।

ইকবালের রাজনৈতিক প্রভাব

ইকবালের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রক্ষমতার পিছনে কাজ করে এক দিব্যতন্ত্রী পরম সত্তা এবং তার জন্যে তিনি ইসলাম ধর্মের আদর্শ তুলে ধরেন, যাতে ব্যক্তিগত জীবনধারা, রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকর্ম ও ধর্মীয় অনুশাসন সমুদয় এক সুরে বাঁধা থাকে। রাজনীতিকে ধর্ম থেকে তিনি পৃথকভাবে দেখতেন না। তাঁর মতে ধর্ম নিছক ব্যক্তিগত আচরণীয় বিষয়মাত্র নয়, ধর্ম ও রাজনীতি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত।[২]

ইকবালের মতে সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি ও অর্থনীতির একটি থেকে অপরটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যায় না। ঐহিক অথবা পারত্রিক বলে স্বতন্ত্র কিছু নেই। ইসলামি রাষ্ট্রবিধি ছাড়াও এ বিষয়ে তিনি প্লেটোর চিন্তার কথা উল্লেখ করেন। তবে তিনি দিব্যতন্ত্রী রাষ্ট্রের নামে স্বেচ্ছাচারী শাসনকর্তাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে মানার বিরোধী ছিলেন। তাঁর ‘আসরার-ই-খুদী’ কাব্যগ্রন্থের মূলকথা হলো যে জগতে সকল বস্তু ও প্রাণী স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলে। ব্যক্তিত্বকে যে যতটা সুদৃঢ় ও শক্তিসম্পন্ন করতে পেরেছে, সৃষ্টিতে সে ততই স্থিতিবান হয়েছে এবং তার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।[২]

আল্লামা ইকবাল সর্বপ্রকার শোষণের বিরোধী ছিলেন। শ্রমিক ও কৃষকদের অসন্তোষজনিত ন্যায্য দাবিদাওয়াকে তিনি সমর্থন করতেন এবং পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মানুষের অনিবার্য বিপ্লব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। কিন্তু তিনি কোনওদিন সমাজতন্ত্রী হননি। কোরানের বাণীর নিরিখে তিনি সবকিছুর বিচার করতেন এবং বস্তুবাদী সমস্ত সমাজতন্ত্রী চিন্তাভাবনাকে পরিহার করে চলতেন। ইকবাল চাইতেন মানুষে-মানুষে সহৃদয় সমতাবোধ গড়ে তুলতে। তবে সেটা মার্কসীয় অর্থনৈতিক সমতা নয়। তা হলেও পুঁজিবাদের তিনি কড়া সমালোচক ছিলেন।

ইসলামী রাজনীতির পুনরুজ্জীবনে ইকবাল

অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদী থেকে তিনি ক্রমে ইসলামি নবজাগরণের পুরোধার ভূমিকা গ্রহণ করেন। ইসলামি স্বাতন্ত্র্যবোধ তাঁর মনে প্রবল হয়ে ওঠে। তাঁর দৃষ্টিতে ইসলামে জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বলে কিছু নেই, ইসলাম হলো একটি জাতিসংঘ; ইসলামে জাতপাত বর্ণ ও বিত্ত নির্বিশেষে সবাই সমান। তিনি অখণ্ড ভারতের বিরোধী ছিলেন, এই কারণে যে প্রথমত তাতে হিন্দুশক্তি মাথা চাড়া দেবে এবং দ্বিতীয়ত দেশপ্রেমিকতার ফলে বিশ্ব মুসলিম একাত্মবোধে বিভেদ সৃষ্টি করবে।[২]

ইকবাল অনুভব করেন যে ভারতে মুসলমানদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের জন্যে পৃথক একটি রাষ্ট্র গঠনের উপর। তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির একাত্মতার বিরোধী যাবতীয় সমন্বয়কারী মতাদর্শকে ইকবাল সমর্থন করতেন না। তিনি দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ‘কমিউন্যাল অ্যাওয়ার্ড’-কে স্বাগত জানান। ত্রিশের দশকের গোড়ায় উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রদেশগুলির সংযুক্তির মাধ্যমে একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের তিনি প্রস্তাব করেন। ১৯২৮ খ্রি মোতিলাল নেহরুর সভাপতিত্বে গঠিত সর্বদলীয় কমিটির কাছে ইকবাল অনুরূপ একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন; সেটি নাকচ হয়ে যায়।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত মুসলিম লিগের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন যে ব্রিটিশ গণতান্ত্রিক ধারায় ভারতে একটি অখণ্ড রাষ্ট্র গড়ে উঠলে গৃহযুদ্ধ হবে অনিবার্য। তবে তাঁর কল্পিত স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র ভারতীয় রাষ্ট্র-সমবায়ের (confederation) সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়ে তাঁর আপত্তি ছিল না। সেটা ছিল ভারতের মধ্যে একটি মুসলিম ভারত গঠনের প্রস্তাব।

মুহাম্মাদ ইকবালের দার্শনিক চিন্তাধারাও মুসলমানদের উন্নতির উপায়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। তাঁর মতে মুসলমানের মুক্তির পথ হচ্ছে (১) ইসলামের বিধানের প্রতি আনুগত্য পোষণ, (২) আত্মসংযম, (৩) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ অর্থাৎ নবীর উপর বিশ্বাস স্থাপন। মানুষের মুক্তির উপায় আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন হলেও ইকবাল কিসমত বা পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যের তত্ত্ব গ্রহণ করতে চান নি। মানুষের ভাগ্য নির্ধারণে ব্যক্তির নিজের স্বাধীনতাও কম নয়। ইকবালের চিন্তাধারায় পারস্যের বিখ্যাত সুফী কবি জালালউদ্দীন রুমী, জার্মান দার্শনিক নিৎসে এবং ফরাসী দার্শনিক বার্গসঁর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ইকবালের ‘আসরারই খুদী’র মধ্যে তাঁর দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। বিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ। কিন্তু আল্লাহ এক নির্দিষ্ট সময়ে যে বিশ্বের সমস্ত ভবিষ্যৎ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সৃষ্টি করে দিয়েছেন, একথা ভাবা যায় না। আল্লাহ বিশ্বের ভূত-ভবিষ্যতের স্রষ্টা ও দ্রষ্টা তাঁর মূলগত সম্ভাবনার ভিত্তিতে; তাঁর প্রতিটি বাস্তব সৃষ্টির ভিত্তিতে নয়। অন্য কথায় আল্লাহ বিশ্ব সৃষ্টির কাজ সম্পূর্ণ করেছেন, একথা ঠিক নয়। আল্লাহ বিশ্বকে সৃষ্টি করে চলেছেন। আল্লাহর বান্দা মানুষও কেবল ক্রীড়নক নয়। মানুষও আল্লাহর প্রবহমান সৃষ্টিকার্যের সক্রিয় অংশীদার। এ তত্ত্বের মধ্যে বার্গসঁর ক্রিয়েটিভ ইভোল্যুশন এর প্রভাব স্পষ্ট।[৩]

ইকবালের সাহিত্যকর্ম

জীবনের প্রথম দিকে দেশপ্রেম-মুলক বহু কাব্য রচনা করেন। ইকবালের প্রধান দার্শনিক রচনা হিসাবে তাঁর ‘দি রিকন্সট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম’ গ্রন্থ পরিচিত। এই গ্রন্থে কবি বলেছেন, সামাজিক ক্ষেত্রে মুক্তি এবং অগ্রগতির জন্য ইসলামকে অবশ্যই গোঁড়ামি এবং অতীতের অবাস্তক শেকল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। এক কালের বিধান অপর কালের মানুষের বিচারের উর্ধে্ব হতে পারে না। বর্তমানের মুসলমানকে অতীতের বিধান বিচার করে বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে অগ্রসর হওয়ার পথ নির্ণয় করতে হবে। এরূপ তত্ত্বে ইকবালের অগ্রসর বা প্রগতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। ইকবালের অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে ‘রামুজে বেখুদী’ এবং ‘জাবিদনামা’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘জাবিদনামাকে’ তাঁর প্রধান কাব্যিক সৃষ্টি বলে মনে করা হয়।[৩]

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত তারানে হিন্দ কাব্যে ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা’ গানটি যখন রচিত হয় তখন তাঁর মনে সম্প্রদায়গত স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রবেশ করেনি। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর মনে ইসলামি আবেগ ও বিশ্ব ইসলামি ঐক্যচিন্তা সঞ্চারিত হয়।

ইকবাল তাঁর সাধনা ও জ্ঞানচর্চা করেন প্রধানত উর্দূ ও ফারসী ভাষায়। তাঁর কাব্যের প্রধান সুর ও বিষয় হচ্ছে মুসলমানদের হারানো অতীত ঐশ্বর্য্য এবং ঐতিহ্যের স্মৃতি এবং বর্তমান হতোদ্যম মুসলমানের প্রতি নব জাগরণের উদাত্ত আহবান। ইকবালকে তাই মুসলিম পুনর্জাগরণের কবি বলে আখ্যায়িত করা হয়।

দ্র. ইসলামি রাষ্ট্র

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, “আল্লামা মহম্মদ ইকবাল খ্যাতনামা উর্দু কবি, রাষ্ট্রতাত্ত্বিক ও দার্শনিক” রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/a-m-iqbal/
২. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৪২-৪৪
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৩৯-২৪০।

রচনাকাল: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, নেত্রকোনা বাংলাদেশ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!