এ্যাডলফ হিটলার ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ এবং পার্টির নেতা

এ্যাডলফ হিটলার বা আডলফ হিটলার (ইংরেজি: Adolf Hitler; ২০ এপ্রিল ১৮৮৯ – ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫) ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ এবং নাজি বা নাৎসি পার্টির নেতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে হিটলারের বিরোধী সমাজতান্ত্রিক পার্টি ছিল জার্মানীর কমিউনিস্ট পার্টি। জার্মান রাইখকে বলা হত পার্লামেন্ট। হিটলারের পার্টি রাইখে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে দায়ী করে কমিউনিস্টদের ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তার করতে থাকে।

দ্বিতীয় যুদ্ধের সময়ে হিটলারের আসল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করা। এই উদ্দেশ্যে ইউরোপের অন্যান্য দেশ আক্রমণ করার পরে ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সর্বগ্রাসীভাবে আক্রমণ করে। সোভয়েত ইউনিয়নের নেতা স্ট্যালিনের নেতৃত্বে আমরণ প্রতিরোধ করতে থাকে। হিটলারের বাহিনী মস্কো ঘেরাও করে ফেললেও মস্কো দখল করতে ব্যর্থ হয়। সোভিয়েত সৈন্য পাল্টা আক্রমণ করে ফ্যাসিবাদী বাহিনী পরাজিত করে বার্লিন পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে মিত্রপক্ষের রুজভেল্ট এবং ইংল্যাণ্ডের নেতা উইনস্টোন চার্চিলের মিলিত সভায় হিটলারের বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। সংক্ষেপে এটাই হচ্ছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাহিনী।[১]

প্রেক্ষাপট

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে চারদিক থেকে ধেয়ে আসা নিষেধাজ্ঞার বাণ আর অবরােধের পর অবরােধ জার্মানিকে কোণঠাসা করে রাখে। আশৈশব উন্নত ও শক্তিশালী জার্মানির স্বপ্ন দেখা যুবক অ্যাডলফ হিটলারের উত্থান একটি পর্যায়ে এসে পুরাে বিশ্বকে আবার উত্তপ্ত করবে এমন আশঙ্কা করেছিলেন অনেক তাত্ত্বিক। জীবনের প্রতি পদক্ষেপে নিষ্পেষিত, নিগৃহীত, নির্যাতিত হওয়া জার্মান যুবকের প্রতিচ্ছবি হিটলার শৈশব থেকেই বেড়ে ওঠেন তীব্র ইহুদি বিদ্বেষ নিয়ে। জার্মান পরিবারগুলাের হতশ্রী দশার পাশাপাশি তাদের সম্পদেই ইহুদিদের আয়েশ তাকে ক্ষিপ্ত করে তােলে। তিনি পুঁজিপতি ইহুদি আর তাদের তােষণকারীদের জব্দ করার জন্য উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদী আদর্শে গড়ে তােলেন নাৎসি দল। পরে এ দলটির ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে নতুন দিনের পথে পা বাড়ায় জার্মানি। যে নতুন নিয়ে ভালাে-মন্দ যত তর্কই থাকুক না কোন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর কারণ হিসেবে হিটলারের উত্থান ইতিহাসানুক্রমে অনেক গুরুত্বের দাবিদার।[২]

হিটলার নাৎসি বাহিনীর প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। ১৯৩৩-৩৪ সালের মধ্যে নাৎসিরা পুরাে জার্মানির উপর তাদের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে তারা পরিস্থিতির দায় মেনে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করে। পাশাপাশি তারা শুরু থেকেই ভার্সাই চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে একের পর এক তার শর্ত ভঙ্গ করতে থাকে। ইহুদি পুঁজিপতিদের সম্পদ সরকারি হুকুমে বাজেয়াপ্ত করা শুরু করে নাৎসি সরকার। এদিকে নতুন উদ্যোমে পুনর্গঠন শুরু হয় জার্মান সামরিক বাহিনীর। হিটলার ঘােষণা করেন কোনাে মনেই নাৎসিরা দুর্বল জার্মানিকে দেখতে চায় না। তাদের দলের মূলমন্ত্র হচ্ছে এমন এক জার্মানি প্রতিষ্ঠা করা যার সামনে সবাই সম্মানে মাথা নােয়াবে। দেশের অভ্যন্তরে নাৎসিদের সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়ায় সব কথার শেষ কথা। জার্মানির বিরুদ্ধে অবস্থানরত দেশগুলােকে শায়েস্তা করার নানা আয়ােজন চলতে থাকে পুরােদমে। শক্তিশালী সেনা ও নৌবাহিনী তৈরির পাশাপাশি ঢেলে সাজানাে হয় বিমান বাহিনীকেও। নতুন প্রযুক্তির বিভিন্ন বিমান সংযুক্ত করে পুরাে আধুনিক একটি বাহিনীতে রূপ দেয়া হয় তাদের। ধীরে ধীরে সমরসজ্জা আরাে শক্তিশালী হয়ে ওঠার এক পর্যায়ে যুদ্ধের হুঙ্কার দিয়ে বসে জার্মানি।

আরো পড়ুন:  সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ঊনবিংশ কংগ্রেসে প্রদত্ত ভাষণ

বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ও হিটলারের শেষ জীবন

লুফটওয়াফ তথা জার্মান বিমান বাহিনী প্রধান মার্শাল গােয়েরিংয়ের চিঠি থেকেই বােঝা যায় জার্মানির ভাগ্য ইতােমধ্যে নির্ধারিত। কিন্তু তাতে দমবার পাত্র ছিলেন না হিটলার। তিনি এ টেলিগ্রামের জবাবে মার্শাল গােয়েরিংকে বরং গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। গােয়েরিং ২৫ এপ্রিল ভােরে গ্রেফতার হলে সেদিন একটি বােমা নিক্ষিপ্ত হয় জার্মান চ্যান্সেলর হাউসে এসে। জেনারেল রিটার ফন গ্রেইম ও নারী টেস্ট পাইলট হানা রিচ গিয়ে দেখা করেন হিটলারের সাথে। হিটলার গােয়েরিংয়ের পদাধিষ্ঠিত করেন আহত ফন গ্রেইমকে যিনি পরপর তিন দিন বাংকারে বিশ্রাম নিতে বাধ্য হন। এর মধ্যেই এসএসের কমান্ডার হেইনরিখ হিমলার একই সাথে মিত্রবাহিনীর সাথে আলােচনা এবং পশ্চিমে জেনারেল আইসেন হাওয়ারের কাছে জার্মান বাহিনী আত্মসমপর্ণের প্রস্তাব দেন। হিটলার হিমলারের প্রতিনিধি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারমেন ফেজেলিয়ানকে সাথে সাথে গুলি করে হত্যা করেন। 

হিটলার নিশ্চিত পরাজয় জেনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন আর যাই হােক তিনি মিত্রবাহিনীর কাছে অন্তত আত্মসমর্পণ করবেন না। এক্ষেত্রে আত্মহননই হয় তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা এবং এক গৌরমময় পরিণতি। আর তাই হিটলারকে না পেয়ে মিত্রবাহিনীর কাছে জার্মানির আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর করেন জেনারেল আলফ্রেড জোডল। প্রথমে ৪ মে ব্রিটিশ ফিল্ড মার্শাল মন্টেগােমারি হল্যান্ড, উত্তর-পশ্চিম জার্মানি ডেনমার্কে অবস্থানরত জার্মান সৈন্যদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৪৫ সালের ৭ মে জেনারেল বােহনি নরওয়েতে সৈন্যদের আত্মসমর্পণের কথা বলেন। এদিকে পূর্ব রণাঙ্গনে জেনারেল ফার্ডিনান্দ শােরনারের নেতৃত্বাধীন জার্মান সৈন্য আত্মসমর্পণে রাজি হয়নি। হিটলার ৩০ এপ্রিল তাকে জার্মান বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ পদে ভূষিত করেছিলেন। তারপরেও ১৯৪৫ সালের ৮ মে সব রণাঙ্গন থেকে থমকে যেতে হয়ে জার্মান বাহিনীকে। এসময় আত্মসমর্পণ না করে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত শােরনার অস্ট্রিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। 

জীবনের শেষ দিনগুলােতে জার্মান নেতা হিটলার বার্লিনেই ছিলেন। সেখান থেকে তার পালিয়ে যাওয়ার কোনাে ইচ্ছে ছিল না। তিনি নিজেই বলেছেন অন্তত যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার মত কাপুরুষ অ্যাডলফ হিটলার নয়; তার কাছে যুদ্ধই জীবন, যুদ্ধই সর্বজনীন এবং যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী জার্মান শ্রেষ্ঠত্বের মহান লড়াই। তিনি ভেবেছিলেন কোনােভাবে সােভিয়েত ইউনিয়নকে পদানত করা গেলে পুরাে বিশ্বই অন্তত একবার জার্মানির সামনে মাথা নােয়াতে বাধ্য হবে। তবে প্রাকৃতিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে রুশরা জয়লাভ করে যুদ্ধ, জীবনের শেষ দেখতে পান অ্যাডলফ হিটলার। পূর্ব প্রশিয়ার রাসটেনবুর্গ থেকে একটি ব্যর্থ আক্রমণে কোনােক্রমে প্রাণে বেঁচে যান হিটলার। এরপর তিনি অবস্থান নেন বার্লিনের এক ভূগর্ভস্থ বাংকারে। ১৬ জানুয়ারি বাংকারে প্রবেশ থেকে শুরু করে তার মৃত্যু পর্যন্ত একটি বারের জন্যও বাইরে আসার সুযােগ হয়নি হিটলারের। অনেক শক্তিশালী বােমার আঘাতে বাংকারটির কোনাে ক্ষতি হয়নি বললেই চলে। পাশাপাশি সেখানে পর্যাপ্ত রসদের যােগানও ছিল। রুশ সৈন্যরা চারদিক থেকে বাংকারটা ঘিরে ফেলছে জানতে পেরে ২২-২৩ এপ্রিল শীর্ষস্থানীয় জার্মান অফিসাররা সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তবে হিটলার সেখানে অবিচল থেকে যান সেই বাংকারে। এই বাংকারেই বিয়ে করার পর ৩০ এপ্রিল স্ত্রী ইভা ব্রাউনসহ আত্মহত্যা করেন হিটলার। ফুয়েরার বাংকার নামে পরিচিত এ স্থান মাটির প্রায় ৫৫ ফুট নিচে অবস্থিত। প্রায় ৪ মিটার কংক্রিকেটের আস্তরণযুক্ত এ স্থান প্রায় ৩ হাজার বর্গফুট এলাকাজুড়ে অবস্থিত। জাপানের আত্মসমর্পণকে মনে করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ের ঘটনা। 

আরো পড়ুন:  ভিদকুন কুইসলিং ছিলেন নরওয়ের ফ্যাসিবাদী নেতা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কুখ্যাত ভার্সাই চুক্তি যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথ করে দেয় তেমনি বিচারের নামে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল ছিল আরেকটি প্রহসনের নামান্তর। বিজয়ী শক্তি সুযােগ পেলে সবদিক থেকে পরাজিত শক্তির ওপর চড়াও হয় এ ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল তার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। যুদ্ধাপরাধের দায়ে যে ব্রিটিশরা জার্মানদের বিচারের সম্মুখীন করতে থাকে। তারাই ভারতবর্ষ ও আফ্রিকায় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। অন্যদিকে মানবতাবিরােধী অপরাধ বলতে গেলে এক জাপানের হিরােশিমা-নাগাসাকিতে বােমা নিক্ষেপ করে মিত্রবাহিনীর তরফে যুক্তরাষ্ট্র যে অপরাধ করেছিল তার বিচার করে সাধ্য কার। সেদিক থেকে ধরতে গেলে নাজি জাতীয়তাবাদী যােদ্ধাদের বিচার প্রহসন বৈ কিছুই নয়। এক্ষেত্রে অনেক ইতিহাসবিদ সরাসরি বলেই দিয়েছেন এক্ষেত্রে জার্মানি পরাজিত হয়েছে বলে বিচার হয়েছে তাদের, ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের নামে হত্যা করা হয়েছে অগণিত কুশলী জার্মান সেনা নায়ককে। এদিকে মিত্রবাহিনী যদি পরাজিত হত তবে লন্ডন কিংবা মস্কোর রাস্তায় তেমনি তাদের অনেক বীর সেনানীর লাশ বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে ঝুললে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৯৯।
২. মো. আদনান আরিফ সালিম, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস, [Pdf]. বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জানুয়ারি ২০১৯. সানজিদা মুস্তাফিজ ও সুমা কর্মকার. সম্পা. পৃষ্ঠা ৭২-৭৭, ৮৫; Retrieved from http://www.ebookbou.edu.bd/wp/OS/hsc4_2.php#hsc2855

Leave a Comment

error: Content is protected !!